যে গণহত্যা যুক্তরাষ্ট্র বিস্মৃত হয়েছে, বাংলাদেশ যা কোনো দিন ভুলতে পারেনি
''আমাদের সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার দমনের চেষ্টা ঠেকাতে ব্যর্থ। গণহত্যার নিন্দা জানাতেও ব্যর্থ হয়েছে। বিপরীতে আমাদের সরকার যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বেশিরভাগ মানুষ আগামীতে তাকে নৈতিক দেওলিয়াত্ব বলেই মনে করবেন''- আর্চার ব্লাড, মার্কিন কূটনীতিক (সময়: ৬ এপ্রিল,১৯৭১)
২৫শে মার্চের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের দুই সপ্তাহ পর ব্লাড এভাবেই তার পর্যবেক্ষণ কূটনৈতিক মাধ্যমে ওয়াশিংটনে পাঠান। ওই গণহত্যা বাংলাদেশের জন্ম দেয়। ব্লাড ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় নিযুক্ত শেষ মার্কিন কনসাল জেনারেল।
মার্কিন জনতা রুয়ান্ডার গণহত্যা, নাৎসিদের হাতে হলোকাস্টের ইতিহাস বা যুগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেখানে সংগঠিত নির্মমতা সম্পর্কে বেশ ভালোই জানে। কিন্তু, ৪৫ বছর আগে বাংলাদেশে হওয়া গণহত্যা সম্পর্কে অশিকাংশেই জানেন না। যারা জানতেন তাদেরও আর স্মরণে নেই, বা কখনোই তা বিবেকে গুরুত্ব পায়নি। অথচ অনুমান করা হয় কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ ঝরেছে এই হত্যাযজ্ঞে।
সিরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে বা আলেপ্পোতে যারা অবরুদ্ধ হয়ে আছেন তাদের সহায়তায় আমেরিকার সাহায্য পাঠানো উচিৎ কিনা- তা নিয়ে তুমূল বিতর্ক চলেছে ২০১৬ সালে। একারণেই, অতীতের গণহত্যা সমূহের কালে যুক্তরাষ্ট্র কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সে সম্পর্কে বোঝাপড়া আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
সেই আলোকেই আমরা ফিরে দেখব ১৯৭১ এর ঘটনা। এই ইতিহাসের সূত্রপাত ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়। জন্ম নেয় দুই স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের। হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্র দুটি। কিন্তু, মানচিত্রের ভাগযোগে পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে দূরত্ব দাঁড়ায় ১ হাজার মাইলের বেশি ভারতীয় স্থল সীমানা।
শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্যও প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। ভারত থেকে আসা অভিজাত অভিবাসী মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ আশ্রয় নেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তাদের হাতেই আসে অর্থনীতি আর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশটি।
উভয় অঞ্চলের উন্নয়ন ও ব্যবসায় এই প্রভাব ছিল লক্ষ্যণীয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল নাগাদ পাকিস্তানের মোট শিল্প বিনিয়োগের ২৫ শতাংশ পায় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। আমদানির ৩০ শতাংশ আসে এই অঞ্চলের জন্য। অথচ মোট রপ্তানিতে অবদান ছিল ৫৯ শতাংশ। পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজাতরা তাদের পূর্বাঞ্চলীয় দেশবাসীকে সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে নিম্ন শ্রেণির মনে করতেন।
এমন মনোভাব থেকেই মূল জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালান তারা। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উর্দুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অনেক আনুষ্ঠানিক। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো উর্দুই জানতেন অনেকে। একারণেই, উর্দুর রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ প্রথম বুঝতে পারে তাদের স্বার্থকে এই শাসকশ্রেণি অবজ্ঞাই করে যাবে।
জন-অসন্তোষ আরো তীব্র রূপ দেয় এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ১৯৭০ সালে আঘাত হানা এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে কমপক্ষে ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যথেষ্ট সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেরি করে পশ্চিম পাকিস্তান দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসে, কিন্তু সেটাও ছিল একেবারেই অপর্যাপ্ত।
ফরাসী সাংবাদিক পল ড্রাইফাঁস এ পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, 'পশ্চিম পাকিস্তানের আচরণ ছিল আহ্লাদে নষ্ট হয়ে যাওয়া সন্তানের মতো। কোনো অনাহূত মাথামোটা অতিথির মতো সে সব ভালো খাবার খেয়েদেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শুধু পাতের উচ্ছিষ্ট আর এঁটোকাঁটা অবশিষ্ট রেখেছে।'
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সামনে এই শোষণের জবাব দেওয়ার গণতান্ত্রিক সুযোগ আসে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান তার স্বাধীনতার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। তবে পূর্বসূরিদের মতোই এই নির্বাচনের শর্ত বেঁধে দেন পশ্চিম পাকিস্তানে মার্শাল ল' জারির প্রধান কুশলী এবং প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। ভোটার স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ আরোপ করে জানান, নির্বাচনের ফলের চাইতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখতে ন্যূনতম গণতন্ত্রের সাজানো এই নাটক অতীতেও অবতারণা করা হয়।
তারপরও, এ নির্বাচনে ১৬২টি আসনে জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিরা। পশ্চিমারা পায় ১৩৮টি আসন। পূর্বাংশে ২ কোটি জনসংখ্যা বেশি থাকাই ব্যবধানের কারণ। অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে তারা ভিন্ন সংস্কৃতির শাসকদের প্রতি তাদের অসন্তোষ তুলে ধরেন।
পশ্চিম পাকিস্তানে পড়া অধিকাংশ ভোট আবার নানা দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু, পুর্বাংশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একক দল হিসেবে সিংহভাগ আসন পায় আওয়ামী লীগ। বাঙ্গালী জাতির এ বিস্ময়কর নেতা স্বায়ত্তশাসন চেয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
নির্বাচনের ফলাফলে বিস্মিত হয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা একে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম অধিবেশন আহ্বানে গড়িমসি করার পাশাপাশি আবারও সামরিক আইন জারি করেন ইয়াহিয়া খান। এই ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে দাবাননের মতো বিক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পশ্চিমা শাসকদের সঙ্গে অসহযোগিতার আন্দোলন ঘোষণা করেন মুজিবুর রহমান।
সমঝোতার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তারা একটি সমঝোতায় উপনীত হতে চলেছেন এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছিল।
কিন্তু, ২৫ মার্চ রাতে হঠাত করেই মুজিবুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একইসঙ্গে, বিগত কয়েক মাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানে গোপনে আনা ৬০-৮০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট। বেসামরিক বাঙ্গালী নাগরিক হত্যায় আসলে ওই আলোচনা ছলনা ছিল মাত্র। ২৫ মার্চের তাণ্ডবে সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কত মানুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়, তার নির্দিষ্ট সংখ্যাটি রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। তবে কমপক্ষে ৫ লাখ থেকে ৩০ লাখের বেশি মানুষ নারকীয়তার শিকার হয়েছেন, বলছিলেন হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের এশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো লিসা কার্টিস।
কার্টিসের মতে, 'প্রকৃত সংখ্যা যাই হোক, বাঙ্গালীদের নির্মুলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই সংঘাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যে বর্বরতা দেখিয়েছে তার কোনো তুলনা হয় না।'
৩০ লাখ সংখ্যাটি সর্বপ্রথম ছাপা হয় সোভিয়েত সংবাদপত্র প্রাভদা'য়। নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক উপ-সম্পাদকীয়তে বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান একথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি জানান, প্রাভদায় সংবাদটি প্রকাশের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে সোভিয়েত জনতাকে জানানো। সরকারের পররাষ্ট্রনীতি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা, যাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে জন-সমর্থন লাভ করা যায়।
নয় মাস ধরে চলা এই গণহত্যার মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গুপ্তচর সংস্থা- সিআইএ প্রথম একটি হিসাব দেয়। কিন্তু, অতি-সংরক্ষিত ওই হিসাবে মাত্র ২ লাখ বাংলাদেশিকে হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
সিআইএ প্রতিবেদনে বলা হয়, সকল পক্ষই নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে। সশস্ত্র কিছু বাঙ্গালী গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যেও সংঘাতে জড়ায় (এখানে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে উল্লেখ করা হয়), তবে এটা পরিষ্কার যে পাকিস্তানী সেনারাই সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রও ছিল। কারণ, ওই সময়ে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র।
মে মাসে ভারতে প্রায় ১৫ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নেয়, নভেম্বরে সেই সংখ্যা প্রায় এক কোটিতে গিয়ে ঠেকে।
যুদ্ধ শেষে ধর্ষিত নারীদের গর্ভপাতের অপারেশন করাতে জাতিসংঘ অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিসকে ঢাকায় নিয়ে আসে। তার অনুমান ২ থেকে ৪ লাখ নারী ধর্ষিত হওয়ার যে সংখ্যা অনুমান করা হয় তা আসলে অনেকটাই কম।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পায় বটে, তবে এজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বিশেষ করে, ডিসেম্বরের শুরুতে যখন ভারত যুদ্ধের ঘোষণা দেয় তখন গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চরম আকার ধারণ করে। গেরিলা যুদ্ধ এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলত আক্রমণে ১৬ ডিসেম্বর ৯০ হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করার পর রক্তরঞ্জিত স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশ। চারিদিকে তখন শুধুই ধ্বংসের ছাপ। আর বিশ্ব রাজনীতির কূটচালে নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সঙ্কটে কোনো ভূমিকা রাখেনি। কূটনীতিক ব্লাড সেকথাই তুলে ধরেছেন।
ওই সময় ব্লাড এবং ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং উভয়েই প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের মদদ দেওয়া বন্ধের আহ্বান জানান। কিন্তু, তাদের পরামর্শ সরাসরি উপেক্ষা করা হয় বলে ব্লাড তার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন।
- সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন