স্পাই থ্রিলারের গুরু
শুধু কি গোয়েন্দা উপন্যাস-- তিনি কি বিংশ শতকের সেরা লেখকদের একজন নন? শুধু গদ্যের কথাই যদি বলি, এমন মিষ্টি ও সম্মোহনী ইংরেজি গদ্য ক'জন লিখেছেন? এমন মানবিক ও সচেতন লেখক ক'জন আছেন?
'আমাদের ক্ষমতার কোনো সীমা নেই তবুও আমরা ক্ষুধার্ত শিশুকে একটু খাবার এবং একটু থাকার জায়গা দিতে পারি না। আমাদের জ্ঞান অপরিমেয় আর আমরা সেই জ্ঞান দিয়ে অস্ত্র বানাই যা আমাদের ধ্বংস করে। আমরা জীবনের প্রান্তদেশে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে বাস করি। নিজেদের ভেতরের অন্ধকারের আতঙ্কে আমরা সন্ত্রস্ত। আমরা ক্ষতি করেছি, দুর্নীতিগ্রস্ত করেছি, ধ্বংস করেছি; আমরা ভুল করেছি এবং প্রতারিত হয়েছি।' জোর দিয়ে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে এমন কথা জন লে কারে-ই বলতে পারেন।
১২ ডিসেম্বর ২০২০ তার মৃত্যু সংবাদ শুনে ব্রাজিলের সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখক পাওলো কোয়েলো লিখলেন, 'জন লে কারে, আপনি শুধু মহান লেখক নন, আপনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। আপনার নতুন বাড়ি উপভোগ করুন। রেষ্ট ইন পিস।'
তার শেষ দিককার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা: আমরা কমিউনিজমকে পরাস্ত করেছি, এখন ক্যাপিটালিজমকে পরাস্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
স্টিফেন কিং-এর কাছে তিনি হচ্ছেন 'লিটারেরি জায়ান্ট'এবং 'হিউম্যানিটারিয়ান স্পিরিট। মার্গারেট অ্যাটউড বলেছেন তার চরিত্র জর্জ স্মাইলি হচ্ছেন মধ্য বিংশ শতককে জানার চাবিকাঠি। স্টিফেন ফ্রাই লিখেছেন, তার চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ-আনন্দ দিয়েছেন এমন কোনো সমকালীন লেখকের নাম তিনি মনে করতে পারছেন না।
ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত কর্মকান্ড ও জনগণকে শোনানো ভাষ্যের বৈপরীত্যের মধ্যেই যে রাষ্ট্রীয় সঙ্কট জন লেকারে তা যথার্থই সনাক্ত করেছেন ।
সালমান রুশদীর দ্য স্যাটানিক ভার্সেস যখন প্রকাশিত হলো জন লে কারে ক্ষেপে গেলেন, বললেন, একটি মহান ধর্মকে অপদস্ত করার ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার কারও নেই। বিনা শাস্তিতে বিনা জবাবদিহিতে কেউ পার পেতে পারেন না।
২০০৩ সালের জানুয়ারি, যুক্তরাষ্ট্র আর দু'মাস পরই ইরাক আক্রমণ করবে। জন লে কারে তখনই দ্য টাইমস-এ লিখলেন যুক্তরাষ্ট্র পাগল হয়ে গেছে। জর্জ বুশের প্রস্তুতি দেখে তিনি লিখলেন, এটা ম্যাকার্থিবাদের চেয়ে খারাপ হবে, বে অ পিগস যুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর হবে, এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও বিধ্বংসী হবে। তিনি ট্রাম্প পুতিন এবং বরিস জনসনের নিন্দা করেছেন। ফ্যাসিবাদি প্রবণতার উত্থান তিনি লক্ষ্য করেছেন। তিনি নিজের রাজনীতিকে মনে করেছেন 'কমপ্যাশনেট কনজার্ভেটিজম'।
জন লে কারে
ডেভিড জন মুর কর্নওয়েলের জন্ম ১৯ অক্টোবর ১৯৩৯ ইংল্যান্ডের ডরসেট-এ। বাবা রোনাল্ড টমাস আর্চিবন্ড কর্নওয়েল, রনি হিসেবে পরিচিত এবং কুখ্যাত। মা অলিভ মুর কর্নওয়েল। গ্ল্যাসি নামে তিনি পরিচিত। তার বাবা রনি একজন পেশাগত প্রতারক, অপরাধী, কিঞ্চিত শিক্ষিত, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, বেপরোয়া এবং বেহিসেবি, উদ্ভট রুচির মানুষ। বীমা প্রতারনা ও জালিয়াতি ধরা পড়ে জেল খাটেন। বাবা ও ছেলের সম্পর্ক কখনোই সুস্থ্ ছিল না। তবে রনি ছেলেকে তার লেখার একটি চরিত্র পেতে অজ্ঞাতে সাহায্য করেছেন। তার একাধিক উপন্যাসে রনি কোনো না কোনো মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন। রনির বেহিসেবিপনার একটি দৃষ্টান্ত: ১৯৪৮ সালে তিনি জন ব্রাডম্যানসহ গোটা অষ্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিমকে তার ইংলিশ কান্ট্রিহাউসে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এ ধরনের নিমন্ত্রণ বিপুল বিত্তশালীদেরই মানায়।
দুর্ভাগ্য তার, মা বরং আরো দূরের মানুষ। মাকে তার চেনার সুযোগ হয়নি। তার বয়স যখন পাঁচ বছর গ্ল্যাসি ছেলেকে পরিত্যাগ করে চলে যান। তার বয়স যখন ২১ বছর বাবার সাথে সাক্ষাৎ হলেও সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর তিনি শেষ কৃত্যের খরচ পাঠিয়েছেন কিন্তু নিজে উপস্থিত থাকেননি।
পরিস্থিতি তাকে ভিন্ন মানুষ বানিয়েছে। কেবল ছদ্মনাম গ্রহণ করে কর্নওয়েল থেকে জন লা কারে হওয়াই নয়, তিনি নিজের জীবনটাকেই প্রতারনা দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, মিথ্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, বেড়ে উঠেছেন মিথ্যের ভেতর, জীবিকার জন্য প্রশিক্ষিত হয়েছেন মিথ্যে বলার ছলাকলা দিয়ে, আর চর্চা করেছেন উপন্যাসের, তাও মিথ্যে। তিনি গল্পের স্রষ্টা, নিজের বহুবিধ চরিত্রের উন্মোচন করেছেন, যদি সত্যিকারের চরিত্রের অস্তিত্ব থেকে থাকে তা অনালোকিতই রয়ে গেছে।
কৌতুহলের বিষয়, যে জীবনই তারা ধারণ করুন না কেনো রনির সন্তানরা খ্যাতিমান হয়েছেন। ডেভিডের বড় ভাই টনি কাউন্টি ক্রিকেটার এবং বিজ্ঞাপন অফিসের বড় নির্বাহী; তার সৎ বোন শার্লট কর্নওয়েল অভিনেত্রী এবং সৎ ভাই রুপার্ট কর্নওয়েল ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার ওয়াশিংটনের ব্যুরো চিফ। তার মায়ের ভাই অ্যালেক গ্ল্যাসি লিবারেল দল থেকে নির্বাচিত এমপি।
তার পড়াশোনার শুরু বার্কশায়ারে সেইন্ট অ্যান্ড্রুজ স্কুলে; কিন্তু শেরবর্ন পাবলিক স্কুলে এসে কঠোর শৃঙ্খলার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেন না। সুইজারল্যান্ডে বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দু'বছর জার্মান ভাষা শিখলেন। ১৯ বছর বয়সে ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটে চাকরি পেলেন, তার পদায়ন হলো মিত্রবাহিনীর দখলাধীন অস্ট্রিয়ায়। তিনি হয়ে উঠলেন জার্মান ইংরেজি দোভাষী। যারা দুই জার্মানির মধ্যকার লৌহ যবনিকা পেরিয়ে চলে আসতে সক্ষম হন তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন।
ক্যাম্পাস থেকেই গোয়েন্দা
১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে অক্সফোর্ডের লিঙ্কন কলেজে ভর্তি হলেন্ তখনও তিনি চাকরিই করছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সার্ভিস এমআই ১৫-এর হয়ে, তার কাজ ছিল: বাম ভাবাপন্ন শিক্ষার্থীদের উপর নজরদারি করা, তাদের কেউ সোভিয়েত এজেন্ট কিনা খোঁজ-খবর রাখছেন। ১৯৫৪ সালে বাবার মৃত্যু হলে তিনি অক্সফোর্ড ছেড়ে মিলফিল্ড প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন। এক বছর পর আবার অক্সফোর্ডে ফিরে আধুনিক ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি পেলেন। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ দু'বছর ইটন কলেজে জার্মান ও ফরাসির শিক্ষক হলেন। ১৯৫৮ সালে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে এমআই ১৫-এর পুরোদস্তর স্পাই হয়ে গেলেন। হাতে এল বহু গোপনীয় দলির দস্তাবেজ। অবাক হয়ে দেখলেন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সত্য আর গোয়েন্দার সত্য এক নয়, কখনো সম্পূর্ণ বিপরীত। এর মধ্যেই লিখলেন প্রথম উপন্যাস কল ফর দ্য ডেথ। বদলি হলেন এম-সিক্সটিন ফরেন ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসে। তার পদায়ন হলো সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে জার্মানিতে, ব্রিটেনের বন দূতাবাসে; তারপর পলিটিক্যাল কনসাল হিসেবে হামবুর্গ বদলি হলেন। আরো দুটো উপন্যাস প্রকাশিত হলো : এ মার্ডার অব কোয়ালিটি ১৯৬২ এবং দ্য স্পাই হু কেইম ইন ফ্রম দ্যা কোল্ড ১৯৬৩।
দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড, এই উপন্যাস ১৯৬৩ সালের বেস্ট সেলার, এই বই নিয়ে সেকালের শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক গ্রাহাম গ্রিন বলেছেন যে এটিই তার পড়া সর্বোৎকৃষ্ট স্পাই স্টোরি। কেজিবি এবং ব্রিটিশ ডাবল এজেন্ট কিম ফিলবির বিশ্বাসঘাতকতার খেসারত দিতে তাকে চাকরি ছাড়তে হলো। তিনি তাকে বিশ্বাস করেছিলেন। এই ফিলবি উঠে এসেছেন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তার টিঙ্কার টেইলর সোলজার স্পাই উপন্যাসে।
তিনি লেখালেখিতে নৈঃসঙ্গ ও গোপনীয়তা ভালোবাসেন, সে জন্য তিনি সাহিত্য উৎসব করেন না। সাক্ষাৎকার দেওয়া থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেন। 'একটা সময় ছিল যখন কোনো কোনো রাতে আমি ভাবতাম আমি কখনও কোনো সাক্ষাৎকার দেবো না।'
'গোয়েন্দাগিরি জন্মের পর থেকেই আমার উপর আরোপিত হয়েছিল, যেমন করে সমুদ্র আরোপিত হয়েছে সি এস ফরেষ্টারের উপর কিংবা ভারত হয়েছে পল স্কটের উপর।'
জন লে কারে রূপালি পর্দায়
জন লে কারে নিজেই যেখানে এসপায়োনেজ গুরু, তার হাতে সেরা স্পাই উপন্যাস লিখিত হবে, এটাই তো প্রত্যাশিত।
তার প্রথম গ্রন্থ কল ফর দ্য ডেড প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। মাঝখানে রয়েছে : এ মার্ডার অব কোয়ালিটি ১৯৬২, দ্য স্পাই হু কেইম ইন ফ্রম দ্যা কোল্ড ১৯৬৩, দ্য লুকিং গ্লাস ওয়ার ১৯৬৫, টিঙ্কার টেইলর সোলজার স্পাই ১৯৭৪, দ্য অনারেবল স্কুলবয় ১৯৭৭, স্মাইলিস পিপল ১৯৭৯, দ্য রাশিয়া হাউস ১৯৮৯, দ্য সিক্রেট পিলগ্রিম ১৯৯০, এ লেগাসি অব স্পাইস ২০১৭, দ্য ইনকনগ্রুয়াস স্পাই ১৯৬৪, দ্য কোয়েস্ট ফর কার্লা ১৯৮২, দ্য নাইভ অ্যান্ড সেন্টিমেন্টাল লাভার ১৯৭১, এ পার্ফেক্ট স্পাই ১৯৮৬, এ স্মল টাউন ইন জার্মানি ১৯৮৬, দ্য লিটল ড্রামার গার্ল ১৯৮৬, দ্যা নাইট ম্যানেজার ১৯৯৩, আওয়ার গেইম ১৯৯৫, দ্য টেইলর অব পানামা ১৯৯৬, সিঙ্গল অ্যান্ড সিঙ্গল ১৯৯২, দ্য কনস্ট্যান্ট গার্ডনার ২০০১, অ্যাবসল্যুট ফ্রেন্ডস ২০০৩, দ্য মিশন সঙ ২০০৬, এ মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান ২০০৮, আওয়ার কাইন্ড অব ট্রেইটর ২০১০, এ ডেলিকেট ট্রুথ ২০১৩। তার আত্মজীবনী : দ্য পিজিয়ন টানেল : স্টোরিস ফ্রম মাই লাইফ।
জন লে কারে ১২ ডিসেম্বর ২০২০ প্রয়াত হন।
জন লে কারের নিজের কথা
১৯৯৭ সালে প্যারিস রিভিউর জন্য জর্জ প্লিম্পটনের নেয়া সাক্ষাৎকার থেকে জন লে কারের কিছু কথা উদ্ধৃত করছি। 'আমি সম্পূর্ণ বইশূন্য একটি বাড়িতে বেড়ে উঠি। আমার বাবা গর্ব করে বলতেন জীবনে কখনও একটি বই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েননি। এমনকি আমার বাবার নারীদের কাউকে বই পড়তে দেখিনি। কেবল একটি বই বাদে পড়াশোনার জন্য সম্পূর্ণভাবে স্কুল শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। আমি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলাম সেখানকার একজন নার্স আমাকে দ্য উইন্ড অব দ্য উইলোজ বইটি পড়ে শুনিয়েছেন। আমার প্রথম দিককার লেখকদের মধ্যে রয়েছেন সমারমেট মম, বীরত্বপূর্ণ ইংরেজি গল্পে লেখক ও হেনরি, পিটার চেনি; এবং ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ আমার কাছে আরও ছিলেন বিস্ময়কর ও মহান আর্থার কোনান ডয়েল। আমি সানন্দে ডিকেন্স পড়েছি এবং পড়েছি জর্জ বার্নার্ড শ এবং জন গলসওয়ার্দি এবং সতর্কতার সাথে পড়েছি সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ লেখক আর্থার কোয়েশলার, আদ্রে জিদ এবং আলবেয়র কামু। কিন্তু আমি যখন কৈশোরের শেষ দিকে তখন আমার পাঠের বড় বিস্ফোরণ ঘটে, জার্মান সাহিত্য আমাকে পেয়ে বসে। এখন আমার কাছে মনে হয় আমি জীবন্ত সব জার্মান সাহিত্য তখনই পড়ে ফেলি। সম্ভবত আমি ইংরেজি সাহিত্যের চেয়ে বেশি পড়েছি জার্মান সাহিত্য। এখন আমার আনন্দ উনবিংশ শতকের সাহিত্যিকদের নিয়ে: বালজাক, ডিকেন্স এবং অন্যরা।
সমকালীন লেখকদের সবই মার্কেস থেকে শুরু করে সহসা উঠে আসা নতুন লেখকের দল বিশেষ করে বেরিল ব্যাইনব্রিজের সব লেখা। দুটো বইয়ের মাঝখানের সময়টাতে আমি সবচেয়ে বেশি পড়ি। যখন লিখি খুব কমই ফিকশন পড়া হয়। আমি ইটনে মূলত জার্মান ভাষা ও সাহিত্য পড়িয়েছি। তবে যে কোনো শিক্ষককেই এমন মানের ছাত্রদের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। বহু বিচিত্র বিষয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে-- সালভাদর দালির প্রথম দিককার পেইন্টিং থেকে শুরু করে ভ্রমরা কেমন করে উড়ে সবই। ইটন হচ্ছেন এসবের চূড়ান্ত, লেখক হিসেবে আমার জন্য এসব ভালোই ছিল। সেখানে ইংরেজ উচ্চ বিত্তের সবচেয়ে ভালোটা এবং সবচেয়ে মন্দটা দেখার সুযোগ রয়েছে। ভালো ছেলেগুলো মেধাবী, শিক্ষককে তটস্ত করে তোলে, তার জ্ঞানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যায়। সবচেয়ে খারাপ ছাত্রগুলো তাদের অপরাধপ্রবণ মনের একটা স্পষ্ট ধারনা দেয়। সবকিছু মিলিয়ে ইটনের সময়টা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার প্রথম দিনকার একটি উপন্যাস এ মার্ডার অব কোয়ালিটির প্রেক্ষাপট এমন একটা স্কুল, ইটনের মতোই।
নাম বদলে তিনি জন লি কারে হলেন কেমন করে? তার নাম তো ডেভিড জন মুর কর্নওয়েল।
'আমি যখন লিখতে শুরু করি আমাকে ভদ্রভাবে বলা হতো এ হচ্ছে ফরেন সার্ভেন্ট। আমি আমার চাকরিদাতার কাছে গেলাম এবং বললাম আমি একটি উপন্যাস লিখেছি। তারা পড়লেন এবং জানালেন এর প্রকাশে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এমনকি যদি প্রজাপতি নিয়েও বই লিখি তাহলেও আমাকে একটি ছদ্মনাম গ্রহণ করতে হবে। আমি আামার প্রকাশক ভিক্টর গঞ্জালেস-এর কাছে গেলাম, তিনি জন্মসূত্রে পোলিশ। তিনি আমাকে বললেন, ভালো একটা অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন নাম পছন্দ করো একই ধ্বনির। তিনি চাঙ্ক স্মিথ ধরনের নামের পরামর্শ দিলেন্। আমার সহজাত বিনয়ে চাঙ্ক স্মিথ হতেই রাজি হলাম। তারপর স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত করতে থাকে, মিথ্যে আমাকে পেয়ে বসে। আমাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে এমন অদ্ভুত নাম কেনো নিয়েছি। তখন লেখকের কল্পনা শক্তি আমাকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করেছে। আমি বলতে থাকি বাসের উপরে বসে বাট্রেসা ব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছি, নিচে দর্জির দোকানের দিকে তাকাচ্ছি। তখন আমার কাপড় কেনার দিকে ঝোঁক ছিল, আমাকে জার্মানির বন এ কূটনৈতিক হতে হবে, একটা দর্জির দোকানের উপর চোখ পড়ল কী যেন লা কারে নাম। বহু বছর আমার সে জবাব সকলকে সন্তুষ্ট করল। কিন্তু বয়সের সাথে মিথ্যে টিকে থাকে না। আজকাল সত্য বলার এক আতঙ্কজনক চাপের মধ্যে থাকি। আসল সত্য হচ্ছে কেন এই নামটা নিয়েছি জানি না।
রুশ গোয়েন্দা কেজিবি চেনা: লে কারে বললেন ১৯৮৭ পর্যন্ত খুব সোজা ছিল, ভালো করে ইংরেজি বলতে পারে।
ইয়াসির আরাফাতের সাথে
'শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ আমি উড়োজাহাজে বৈরুত এলাম এবং ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন কমোডোর হোটেলে চেক ইন করলাম। এই হোটেল সাংবাদিক, গুপ্তচর এবং এ ধরনের অনেককে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত আমার গবেষনা ই্জরায়েলই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি ইজরায়েলি স্পেশাল ফোর্সের সাথে দিন কাটিয়েছি, তাদের চমৎকার অফিসে বসেছি; ইজরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনীর বর্তমান ও প্রাক্তন প্রধানদের সাথে কথা বলেছি।
কিন্তু এখন তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের অফিস বৈরুতের একটি বিদ্ধস্ত সড়কে সিমেন্টভর্তি ঢেউ টিনের ব্যারেলের পেছনে। ট্রিগারে হাত রাখা সশস্ত্র প্রহরী ডিঙ্গিয়ে আধো অন্ধকার ওয়েটিং রুমে এসে বসলেন। এক হাতে পিস্তল, অন্য হাতে কালাশনিকভ নিয়ে পিএলওর একজন প্রতিনিধি তাকে জিজ্ঞেস করলেন :
তুমি পত্রিকার জন্য লিখ?
আংশিক। আংশিক আমার বইয়ের জন্য, আমি লিখছি
তুমি কি মানব প্রাণী বিজ্ঞানী?
আমি ঔপন্যাসিক।
তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
তার দিনের পর দিন রাতের পর রাত হোটেলেই কাটতে থাকে। তিনি দেয়ালে বুলেটের ছিদ্র গুনেন। এক রাতে তিনি কমোডর হোটেলের বায়ুশূন্য ডাইনিং রুমে দশ ইঞ্চি লম্বা স্প্রিঙ রোল খাচ্ছেন। একজন ওয়েটার এসে উত্তেজনা নিয়ে তার কানে ফিস ফিস করে বলল, 'আমাদের চেয়ারম্যান তোমার সাথে দেখা করবেন।'
ইয়াসির আরাফাত
তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন হোটেল গ্রুপের চেয়ারম্যান। তারপর ওয়েটারকে অনুসরণ কর বিভিন্ন স্তরে সশস্ত্র পাহারা ডিঙ্গিয়ে একটি ভলভোতে উঠলেন, বাইরে তখন বৃষ্টি। বৈরুতের কোনো একটি রাস্তায় তাকে নামিয়ে গাড়িটি যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। হঠাৎ রাস্তার পাশের একটি দরজার খুলে গেল। ভবনটি বাইরে থেকে গুলিতে ঝাঝরা। মারাত্মক অস্ত্রসজ্জিত মাঝখান দিয়ে দুই দফা সিঁড়ি পেরিয়ে একটি কার্পেটের উপর অবতরণ করলেন, সেখান থেকে এগিয়ে ডিজইনফেকটেন্ট-এর গন্ধযুক্ত একটি লিফট। প্রচন্ড ঝাকি দিয়ে পুরো আমলের লিফট থামে, সামনে এল আকৃতির একটি কক্ষ। ভেতরে নারী-পুরুষ যোদ্ধা, ভেতরে কেউই ধূমপান করছে না। ইয়াসির আরাফাত ধুমপান পছন্দ করতেন না। তাদের একজন জন লে কারের পিঠে আদুরে চাপড় দিতে শুরু করল। এল আকৃতির ছোট বাহুর একটি ডেস্কে ইয়াসির আরাফাত, সাদা কিফিয়া ও খাকি শার্ট পরনে। তিনি তার অতিথির দিকে চোখ তুলে তাকাবার ফুরসৎ পাচ্ছেন না, তাকে প্রচুর কাগজপত্র সই করতে হচ্ছে। এমনকি যখন তার বাম পাশের সিংহাসন সদৃশ কাঠের চেয়ারে তিনি বসলেন, তখনও নজর দিতে পারেননি। তারপর কিছু নাটকীয় পরিস্থিতির বর্ণনা। আরাফাত দু'হাতে আকড়ে তাকে আলিঙ্গন করলেন। তিন আনন্দে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। 'মিস্টার ডেভিড তুমি আমার সাথে দেখা করতে কেন এলে?'
একই রকম উঁচু জোরে জবাব দিলেন, 'মিস্টার চেয়ারম্যান, আমি ফিলিস্তিনের হৃৎপিন্ডে আমার হাতে রাখতে এসেছি।'
আরাফাত তার হাত টেনে খাকি শার্টের উপর দিয়ে নিজের বুকের বাম পাশে রাখলেন। বললেন, 'মিস্টার ডেভিড, এটা এখানে," পুনরায় উচ্চারন করলেন, 'এটা এখানে।' তার পশমী দাড়িতে জনসন বেবি পাউডারের গন্ধ। তিনি বললেন, তোমার যা ইচ্ছে তা দেখতে পারো। একজন ফিলিস্তিনি পরপর দু'দিন এক বিছানায় ঘুমোবার সুযোগ পায় না। তিনি আরো বললেন, যা দেখবে শুধু সত্যটাই লিখবে, সত্যটাই বলবে। সত্যই ফিলিস্তিনকে মুক্তি দেবে। যত ফিলিস্তিনির সাথে তোমার দেখা হবে সবাই সত্যি কথা বলবে।
ডেভিড কর্ণওয়েল ওরফে জন লে কারে নভেম্বর সন্ধ্যায় ইয়াসির আরাফাতের সাথে ফিলিস্তিনি বিপ্লবের সতেরতম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ছিলেন। উদযাপনের বিস্ফোরণ ছিল সে দিন। ফিলিস্তিনি নেতা দু'আঙ্গুল তুলে বিজয়ের প্রতীক দেখিয়েছেন। বছরের শেষ দিন নিউ ইয়ার্সে ইভ-এ আরাফাত তাকে নিয়ে গেলেন ফিলিস্তিনি শহীদদের এতিম সন্তানদের জন্য তৈরি করা একটি স্কুলে।
আট মাস পর বৈরুতে ইজরায়েলি হামলার পর আরাফাত ও তার হাই কমান্ডকে লেবানন সরকার বের করে দিল, তাদের গ্রহণ করল তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট হাবিব বরগুইবার সরকার। এক সপ্তাহ পর জন লে কারে তাদের দেখতে সেখানে গেলেন। ইয়াসির আরাফাত সেদিন দেখা দেননি কিংবা দেখা দিতে চাননি।
(এই এপিসোডটি লেখকের স্মৃতিকথা থেকে সংক্ষেপিত।)
২০০১ স্ত্রী জেইন-এর সাথে বার্লিনে জন লে কারে
লেখালেখির টিপস
টিপ নম্বর ১ : আমি পারতপক্ষে বিশেষণ ব্যবহার করি না। বিশেষণের কাজটা ক্রিয়াপদ দিয়ে সারতে চেষ্টা করি।
টিপ নম্বর ২ : সফরে বেরোলে নোট বই হাতে রাখতেন। নতুন জায়গার দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ সবই তার নোট বইতে টুকে নিতেন।
টিপ নম্বর ৩: আলফ্রেড হিচককের দেওয়া একটা টিপ নিজের জন্য গ্রহণ করেছিলেন, বোমাটা বিছানার নিচে রাখুন।' আসল গল্পটা তাড়াহুড়ো করে শুরুতেই না বলে যতটা দেরিতে সম্ভব বলুন।
টিপ নম্বর ৪ : গল্পের শেষটা যেন ঝাপসা না হয়। পাঠককে একটি স্পষ্ট যুক্তিসঙ্গত ধারনা নিয়ে বইটি শেষ করতে হবে।
টিপ নম্বর ৫: সকাল সাড়ে সাতটায় লিখতে শুরু করতে হবে।
এমআই-১৫-এ চাকরি করার সময় এভাবেই দিনটা শুরু করতেন।
আত্মজীবনীমূলক রচনায় জন লে কার লিখেছেন :
লেখক হিসেবে আপনি যদি আগেভাগে সাফল্য পেয়ে যান, দ্য স্পাই হু কেইম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড উপন্যাসে আমার বেলায় যেমন ঘটেছে, জীবনে সাফল্যের আগে ও পরে, উত্থান ও পতন সবই ঘটতেই পারে। সার্চ লাইট আাপনার উপর পড়ার পর আগের বইগুলোর দিকে তাকাবেন, দেখবেন এগুলোই আপনার অপাপবিদ্ধতা-ইননোসেন্স থেকে সৃষ্টি। এর পরের বইগুলোকে বিষন্ন সময়ের মনে হবে. বিচারাধীন মানুষের প্রয়াস। সমালোচকরা চিৎকার করবে লেখক খুব কঠিন চেষ্টা করছেন'-- আমি আসলে কখনোই কঠিন চেষ্টা করিনি। আমার সাফল্য আমার শ্রেষ্ঠটা ভেতর থেকে টেনে এনেছি-- আমার সেই শ্রেষ্ঠ যতো ভালো বা যতো মন্দ হোক না কেন।
আমি দৌড়ের উপর লিখতে ভালোবাসি। আমার নোট বইতে টুকছি যখন হাঁটছি, যখন ট্রেনে যখন ক্যাফেতে আমার এসব লুণ্ঠিত দ্রব্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাড়ির দিকে ছুটি। হ্যাম্পস্টিড পার্কে ছড়ানো গাছের আড়ালে একটি বেঞ্চে বসি। এই গাছগুলো অন্য গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি টুকটাক লিখতে থাকি। আসলে এটুকুই আমার হাতে কলমে লেখা। ঔদ্ধত্য মনে হতে পারে, আমি আমার শতাব্দী প্রাচীন সাধারণ টাইপ রাইটারে লেখাটা পছন্দ করি। আমার ভেতরের লুপ্ত গ্রাফিক আর্টিস্ট শব্দ আঁকতে ভালোবাসে।