দক্ষ শিক্ষক ছাড়া দক্ষ জনবল তৈরি সম্ভব নয়
স্বাধীনতার পর থেকে একাধিকবার বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রম বদলানো হয়েছে, তবে দেশের চাকরিক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবারই।
এ সংকট নিরসনে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে নতুন পাঠ্যক্রমের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলনের লক্ষ্যে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পাঠ্যসূচির বই তৈরি ও মুদ্রণ ছাড়াও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের নতুন পদ্ধতির প্রশিক্ষণও দিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পাঠ্যক্রম বদলানোর পাশাপাশি উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত অর্থায়ন, গুণগত মূল্যায়ন পদ্ধতি ও কার্যকর পরিচালনা নিশ্চিতের লক্ষ্যেও কাজ করতে হবে সরকারকে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক মানজুর আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বর্তমানে প্রচলিত পাঠ্যক্রম ভুল মানদন্ড না হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে পাঠ্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন হয়নি। একারণেই দক্ষ লোকবলের অভাব তৈরি হয়েছে।
"বর্তমানের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করাও সরকারের ভালো উদ্যোগ। তবে প্রশিক্ষণহীন শিক্ষদের দ্বারা সরকার কীভাবে এ পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করবে তা স্পষ্ট নয়। আমাদের শিক্ষক সংখ্যায়ও স্বল্পতা আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপযুক্ত পরিবেশ ও দক্ষ পরিচালনারও অভাব আছে।" বলেন তিনি।
নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান ও আইসিটির দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের পরামর্শও দেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বহির্বিশ্ব থেকে লোক নিয়োগ দেয়া শুরু করার পর দেশে দক্ষ জনবলের অভাব আরও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপদে কাজ করার জন্য অধিক বেতনে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এ দাবির সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রাথমিক - উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রম বদলানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এর আগে ১৯৭৩, ১৯৮৪, ১৯৯৫ ও ২০১২ সালেও পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করা হয়। তবে বিগত পরিবর্তনও শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পৃথিবী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে, এর সাথে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ জনবল তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায়, দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ অন্যান্য দেশ থেকে লাখ লাখ কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট অক্টোবর ২০১৯: টারশিয়ারি এডুকেশন অ্যান্ড জব স্কিলস' শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের চাকরির প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় দক্ষতার নির্দেশনার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে।
চাকরি ক্ষেত্রে জরিপগুলোতে ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পদের ক্ষেত্রে শর্তাবলি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে চাকরিসন্ধানীরা।
৬৯ শতাংশ চাকরিদাতা জানিয়েছেন, আবেদনকারীদের মধ্যে এসব পদে কাজ করার দক্ষতার অভাব ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান এবিষয়ে বলেন, "প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের কারণেই সরকার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। বিদ্যমান কাঠামো পরিবর্তন না করলে নতুন পাঠ্যক্রমও ভালো ফল বয়ে আনবে না।"
তিনি আরও বলেন, " সরকারি কর্ম কমিশনের মতোই শিক্ষাক্ষেত্রেও শিক্ষা কর্ম কমিশন খোলার প্রস্তাবনা রেখেছিলাম আমরা ২০১০ সালেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ প্রস্তাবনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছিল। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিরোধিতা করায় এ প্রস্তাবনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। "
ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের ৫৬ শতাংশ শিক্ষকেরই নিজের প্রশ্নপত্র তৈরির দক্ষতা নেই।
বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষক আছেন। তাদের মধ্যে সাত লাখ শিক্ষক প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের, চার লাখ শিক্ষক মাধ্যমিক- উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ও এক লাখ মাদ্রাসা শিক্ষক।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবিষয়ে বলেন, "শিক্ষা পদ্ধতিতে নিরাজ্য বিরাজ করছে। নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।"
"ভালো জাতি গড়ে তুলতে ভালো শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমাদের দক্ষ শিক্ষকেরই অভাব থাকলে কীভাবে ভালো ফল আশা করতে পারি?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মো মশিউজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, আমাদের দেশে শিল্প খাতের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, কিন্তু এর সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের শিক্ষা পদ্ধতি।
"ভবিষ্যৎ বিশ্বের যে কোনো জটিল ও পরিবর্তনশীল অবস্থার জন্য ভবিষ্যত প্রজন্মকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পাঠ্যক্রম সাজানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।" বলেন তিনি।