ব্যাংকে রেখে আপনি কি টাকা খোয়াচ্ছেন?
ধারাবাহিকভাবে কম সুদহার প্রবর্তনে স্বস্তিতে নেই আমানতকারীরা। গত এক বছর ধরেই এ অবস্থা। ফলে সঞ্চিত অর্থের উপর বাড়তি কিছু লাভের আশা যারা করেছিলেন তাদের আশাভঙ্গ হয়। যেমন; বেশিরভাগ সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাবে এখন বার্ষিক পাঁচ শতাংশের চাইতেও কম মুনাফা দেওয়া হচ্ছে।
দেশের আর্থিকখাতের নিয়ামক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সঞ্চয়ী সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ নির্ধারণ করাতেই এ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। একবছরের বেশি মেয়াদে সুদ সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশ। তবে গ্রাহকেরা বেশির ভাগ এক বছর মেয়াদি আমানত রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সাল জুড়ে সঞ্চয়ী সুদের হার কমানো হয়েছে। জানুয়ারিতে এ হার ছিল ৫.৬৯ শতাংশ, যা অক্টোবরে নামিয়ে আনা হয় ৪.৭৩ শতাংশে। এই অবস্থায় আমানতকারীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ থেকে কার্যত কোনো লাভই পাচ্ছেন না।
সঞ্চয় প্রবৃদ্ধির প্রকৃত সূচক হচ্ছে প্রকৃত সুদহার; যা মূলত মূল্যস্ফীতি হারের বিপরীতে সমন্বয় করে দেওয়া ন্যূনতম সুদহার। এই সুদহারটি যদি মূল্যস্ফীতির চাইতে কম হয়- তাহলে আমানতকারীর সঞ্চয় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পরে পূর্বের ক্রয় সক্ষমতা হারায়।
অক্টোবরের শেষ নাগাদ বিগত ১২ মাসের মূল্যস্ফীতি হার ছিল ৫.৭৭ শতাংশ, যার বিপরীতে সঞ্চয়ী সুদহার ছিল ৪.৭১ শতাংশ। এর মানে অক্টোবরে প্রকৃত সুদহার ছিল মাত্র ১.০৪ শতাংশ।
তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় যার অর্থ দাঁড়ায়; কেউ যদি ১,০০০ টাকা স্থায়ী সঞ্চয়ী হিসাবে রাখেন, তাহলে তিনি তার বিপরীতে ৪৭.৩ টাকা মুনাফা পাবেন। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে, তার আমানতের ক্রয়-ক্ষমতা নেমে দাঁড়াবে ৫৭.৭০ টাকায়।
ফলে তার মোট সঞ্চয় এখন ১০৪৭.৩ টাকা হলেও, তার অর্থের প্রকৃত বাজারমূল্য দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৯৯০ টাকা! যা সঞ্চয় পূর্ব সময়ের চাইতেও কম!
অর্থাৎ, সঞ্চয়ে কম মুনাফা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমানতের প্রকৃত মূল্য কমেছে ১ শতাংশের বেশি!
তার উপর যদি আবার সঞ্চয়ে নির্ধারিত ১৫ শতাংশ কর হিসাব করা হয়, তাহলে প্রকৃত চিত্র আরও নাজুক হয়ে পড়ে।
ভালো বিকল্প কী?
এমন পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা অন্য কোনো জায়গায় অর্থ রাখবেন এটাই স্বাভাবিক। ব্যাংকিং খাত থেকে এভাবে তাদের থেকে সরে যাওয়ায় অর্থ সরবরাহে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। ফলে বেসরকারি খাতে দেখা দেবে ঋণ সঙ্কট এবং প্রবৃদ্ধির ঘাটতি।
তাছাড়া, বেসরকারি খাত থেকে সরকারের ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রহণের মধ্যে যেকোনো ধরনের নতুন তারল্য সঙ্কটে বেসরকারি খাতের ঋণ ও চাহিদায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। অর্থনীতির সংজ্ঞায় এ প্রভাবকে বলা হয় ক্রাউডিং আউট এফেক্ট।
সঞ্চয়ী সুদহার কমানো ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে, যার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র সনদ (এনএসসি)। এটি সব সময়েই ব্যাংকিং খাতের নানা পণ্যের (ঋণ প্যাকেজের) বিকল্প। এতে সহজে সহজে বিনিয়োগ করে মুনাফাও বেশি পাওয়া যায়।
সঞ্চয়পত্রের চরম বিপরীতে ব্যাংকে সঞ্চয় হারের সর্বোচ্চ মাত্রা ৬ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়, অথচ এনএসসি প্রদত্ত মুনাফা তেমন পরিবর্তন করা হয়নি।
সদ্যবিদায় নেওয়া ২০২০ সালে ম্যাচুরিটি ও স্কিমের ধরন এবং ভাঙ্গানোর সময়ের উপর নির্ভর করে সঞ্চয়পত্রের গড় সুদহার ছিল ৯ থেকে ১১.৭৬ শতাংশের মধ্যে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এটি ব্যাংক হিসাবে টাকা রাখার চাইতে বেশ ভালো বিকল্প উপায় হয়ে ওঠে।
ব্যাংক আমানতকারীর সঞ্চয় থেকেই গ্রাহককে ঋণ দিয়ে থাকে, তাই সুদহারের এ সঙ্কট মুদ্রা সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব যোগ করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্যানুসারে, ব্যাংকের আমানত হচ্ছে অর্থ সরবরাহের প্রধানতম উৎস (এম-টু)। অক্টোবরে নির্ধারিত মেয়াদে সঞ্চয়কারীরা ছিলেন মোট উৎসের (এম-টু) ৭৭.৬ শতাংশের সরবরাহক। এর মাধ্যমে ডিপোজিটে নেতিবাচক সুদহার যে তারল্যের উপর কী পরিমাণ ক্ষতিকর প্রভাব যুক্ত করতে সক্ষম, তা সহজেই অনুমেয়।
২০২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে, সকল ধরনের প্রায় ৮১ শতাংশ ডিপোজিট আসে বেসরকারি খাতের আমানত থেকে (৯৭.৭ লাখ কোটি)। বেসরকারি সকল ডিপোজিটের ৪৬ শতাংশ ছিল আবার স্থায়ী সঞ্চয় (এক ধরনের সময় নির্ধারিত বা টাইম ডিপোজিট)।
বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় আমানত আসে গৃহস্থালি খাত থেকে। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, গৃহিণী থেকে শুরু করে শিল্পপতিরা ছিলেন এসব ডিপোজিটের মালিক।
তবে নানা শ্রেণি- পেশার এসব আমানতকারীর সকলেই সুদহারের ভিত্তিতে তাদের ডিপোজিট স্কিম বেছে নেন। ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহকদের করা ৬৩.৭ লাখ কোটি টাকা ডিপোজিটের ৪৪.৪ শতাংশ ছিল ফিক্সড ডিপোজিট। আর ৩৪.৫ শতাংশ ছিল সেভিংস ডিপোজিট। (প্রথম প্রান্তিক, ২০২০)
বর্তমানে এই গ্রাহকদের করা ডিপোজিটের মাত্র ৩৪.৬ শতাংশ ছয় মাসেরও কম মেয়াদের জন্য স্থায়ী সঞ্চয় হিসাবে জমা পড়েছে। বাস্তবতা হলো; তাদের সকল ধরনের স্থায়ী আমানত এখন তিন বছরের কম ম্যাচুরিটির মেয়াদের।
বেসরকারি খাতের আমানতের মূল সঞ্চালক এ গ্রাহকেরা পূর্বে ৬.৭১ থেকে ৮.৫১ শতাংশের মতো উচ্চসুদ পেয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু, এখন নিয়ামক সংস্থার সুদহার কর্তনে ব্যাংকে হিসাবে সঞ্চয়ে অনুৎসাহিত হয়েছেন তারা। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা।
নেতিবাচক যে পরিণতি সৃষ্টি হবে?
বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারীর কারণে বিশ্বের অনেক উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশ (ইএমডিই) সুদহার কর্তন করেছে বা ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান দেনার পুনঃশ্রেণি নির্ধারণ বাতিল করেছে। এমন নীতির কারণে এসব দেশে ঋণের বোঝা বাড়বে।
বাড়তি ঋণের চাপ কমাতে নিয়মিত সুদ পরিশোধের পাশপাশি আসলও শোধ করতে হবে। দেখা দেবে, আরও বিপুল অর্থের চাহিদা, যা অর্থায়নে চক্রাকারে সরকারের তহবিল চাহিদাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকবে।
অর্থাৎ, সরকারের ঋণ গ্রহণের বাড়তি প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। বরং সুযোগ রাখতে হবে, শক্তিশালী বেসরকারি আর্থিক খাতের বিকাশে।
তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশু-হস্তক্ষেপ আসতে বাধ্য। নিয়ামক সংস্থাটি অর্থনীতিতে বাড়তি অর্থ সঞ্চালনের উদ্যোগ নিক বা সুদহার কর্তনের সিদ্ধান্ত বাতিলের পদক্ষেপ- অর্থ চাহিদা আর সরবরাহের অলঙ্ঘনীয় চক্রে ভারসাম্য ধরে রাখতে- একটা কিছু করতেই হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথম সিদ্ধান্ত নিলে, তাতে বাড়বে মুদ্রাস্ফীতির চাপ। অন্যদিকে, দ্বিতীয় পদক্ষেপে আবার দেখা দেবে সেই ক্রাউডিং আউট এফেক্ট। অর্থাৎ, গ্রাহকেরা সঞ্চয়পত্র ছেড়ে ব্যাংক সঞ্চয়মুখী হবেন। যেভাবেই হোক, সুদহার নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কটের পরিণতি ব্যাংকিং খাত এবং আমানতকারীদের-ই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে মোকাবিলা করতে হবে।
ফিরে আসা যাক বর্তমানে। ঝুঁকিতে থাকা আমানতকারীরা এখন হয় জাতীয় সঞ্চয়পত্রে নাহলে দীর্ঘমেয়াদি ফিক্সড ডিপোজিটে সামান্যতম বাড়তি সুদের আশায় অর্থ রাখার দিকে সরে যাচ্ছেন। অধিক ঝুঁকি সহ্য করার ক্ষমতা যাদের আছে তাদের অনেকেই বিনিয়োগ করছেন পুঁজিবাজারে। ২০২০ সালে পুঁজিবাজার ২১ শতাংশ মুনাফা রিটার্ন দেয়। তবে মনে রাখতে হবে, শেয়ার হলো উচ্চঝুঁকির সম্পদ, তাই এটি প্রকৃতপক্ষে সঞ্চয়পত্র বা ফিক্সড ডিপোজিটের বিকল্প হতে পারে না।
তবে, সঙ্কটের কারণে অনেক সময় নতুন সম্ভাবনাও দেখা দেয়। এক্ষেত্রেও সে সুযোগ আছে। ইতোমধ্যেই সরকারি সিক্যিউরিটিজের সুদহার নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ করে, সময় নির্ধারিত টি-বন্ড বা টি-বিল এর ক্ষেত্রে এমনটা করার চিন্তাভাবনা চলছে। বর্তমানে এসব সিক্যিউরিটিজ ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) বাজারে বিক্রি করা হয়। এগুলোর তারল্যের মতো বৈশিষ্ট্যও নেই।
নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকারি সিক্যিউরিটিজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ফলে বিনিয়োগকারীরা সেখানে এগুলো স্বতন্ত্রভাবে কেনাবেচার মাধ্যমে মুনাফা করতে পারবেন।
চলতি বছর রয়েছে দেশজুড়ে গণ-টিকাদান কর্মসুচির আশা। তার ফলে কোভিড- পূর্ব অবস্থার কাছাকাছি ঘুরে দাঁড়াতেও পারে সার্বিক অর্থনীতি। ফলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ চাহিদা তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ সুদহার সঙ্কট মোকাবিলায় চটজলদি কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে, বরং অর্থনীতির উত্তরণ সহজ ও টেকসইভাবে হয় এমনভাবে নীতি প্রণয়ন করা।