লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হলেও ২০২০ সালে চায়ের উৎপাদন কমেছে
কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বাংলাদেশ ২০২০ সালের চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে। তবে ২০১৯ সালের তুলনায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
চা বোর্ড জানায়, গত বছর দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাত কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার কেজি। ১৬৭টি ছোট বড় চা বাগান মিলে ২০২০ সালে চা উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার কেজি।
বিপরীতে বাংলাদেশ ২০১৯ সালে চা চাষের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন করে। উৎপাদিত হয় ৯৬ দশমিক ০৭ মিলিয়ন কেজি বা ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি।
চা বোর্ডের হিসেব বলছে, পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে চা উৎপাদন কমেছে ৯৬ লাখ ৭৫ হাজার কেজি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে চা বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, হোটেল, রেস্তোঁরা বা চায়ের দোকানে ভিড় কমে যাওয়ার কারণে গত বছর চায়ের চাহিদা প্রায় ১০-১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্যও বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চায়ের উৎপাদন ১০ শতাংশ ব্যাহত হয়েছিল।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জহিরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, করোনার মধ্যেও দেশের সকল চা বাগানের কার্যক্রম বেশ স্বাভাবিক ছিল। যার কারণে উৎপাদনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিধি মেনে চা নিলাম কেন্দ্র চালু রাখা, সঠিক সময়ে ভর্তুকি মূল্যে সার বিতরণ, বাগানে কঠোরভাবে কোভিড প্রটোকল নিশ্চিতকরণ, চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, রেশন এবং স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণের ফলে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।
তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতিতেও উৎপাদনের এ ধারাবাহিকতা থেকে এটাই বোঝা যায় যে যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দেশের চা শিল্প উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম।
এদিকে লন্ডনভিত্তিক 'ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি' প্রকাশিত ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নবম। তাদের হিসাবে বিশ্বের মোট চায়ের ২ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে।
একটানা কয়েক বছর ধরেই দশম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত শতাব্দীর শেষে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম, ১৯৮৯ সালে ছিল ১২তম।
সংস্থাটির এক হিসেবে, চা উৎপাদনে এখন শীর্ষে রয়েছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত।
উত্তরবঙ্গে নতুন রেকর্ড
২০২০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারীর সমতলের ১০টি চা বাগান ও ৭ সহস্রাধিক ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে মোট ১ কোটি ৩ লক্ষ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।
এই চা বাগানসমূহ থেকে ২০২০ সালে ৫ কোটি ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৬ কেজি সবুজ চা পাতা উত্তোলন করা হয়েছে। আর বিগত বছরের তুলনায় এ বছর ১,৪৮৯.৮৯ একর চা আবাদী বৃদ্ধি পেয়েছে ও ৭.১১ লক্ষ কেজি চা বেশি উৎপন্ন হয়েছে।
পঞ্চগড়ের বাংলাদেশ চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধবতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন টিবিএসকে বলেন, সমতল ভূমিতে চা চাষের জন্য পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা। দিন দিন উত্তরাঞ্চলে চা চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চা চাষ সম্প্রসারণের জন্য চাষিদের বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। চাষিদের স্বল্পমূল্যে উন্নত জাতের চারা সরবরাহ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এ আঞ্চলিক কার্যালয়ে একটি পেস্ট ম্যানেজমেন্ট ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে চা চাষিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, চাষের নানান রোগবালাই ও পোকা দমনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ বছর ক্ষুদ্র চাষিরা তাঁদের বাগানের উৎপাদিত কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় তাঁরা চা চাষে উৎসাহিত হয়েছে।
চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মনে করেন, উত্তরবঙ্গে চা চাষীদের 'ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলে'র মাধ্যমে চা আবাদ বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের ফলে চা বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
চা শিল্পের বাণিজ্যের সঙ্গে থাকা জড়িত থাকা সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশিদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের ফলে এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষই চা পান করে। এ মুহূর্তে এ খাতে বাণিজ্য প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকার।
বাংলাদেশী চা সংসদ-মহাসচিব এম শাহ আলম টিবিএসকে জানান, দেশে চায়ের ভোগ বেড়েছে। আশির দশকে দেশে যে চা উৎপাদন হতো তার ৮০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে যেত। বর্তমানে যা উৎপাদন হয় তার ৯৫ থেকে ৯৬ শতাংশই দেশের বাজারের জন্য লাগে।
তিনি বলেন, তবে এখন রপ্তানি যেমন হচ্ছে, তেমন আমদানিও হচ্ছে। আমদানির কারণ, কেউ উন্নত মানের চা এনে দেশি চায়ের সঙ্গে বাজারজাত করে। আবার কেউ দাম কম হওয়ায় আমদানি করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ও চা বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে চা উৎপাদন ছিল তিন কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার কেজি। আর ২০১৯ সালে উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি। অর্থাৎ চার দশকে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ।
কুলাউড়ার গাজীপুর চা বাগানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক শেখ কাজল মাহমুদ জানান, তাদের বাগানগুলোতে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে এসে চায়ের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছ ১২ শতাংশ। ১২ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে যথাক্রমে ২০১৯ এ চা উৎপাদিত হয় ১১.৯৬ লাখ কেজি এবং ২০২০ এ ১০.৪৭ লাখ কেজি।
তবে আবহাওয়া খারাপ হলেও বছরের মধ্যভাগ থেকে চা বান্ধব হওয়ায় সেই সুযোগে কোন কোন বাগান রেকর্ড উৎপাদন বছর ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে আরো বেশী উৎপাদন করেছে। তাদের একটি নাহার চা বাগান।
নাহার চা বাগানের ব্যবস্থাপক পীযুষ কান্তি জানান, বালিশিরা ভ্যালিতে মোট ৩২ টি বাগান আছে তার মধ্যে আমাদের বাগানসহ ৩টি বাগান চা উৎপাদনের রেকর্ড ইয়ার ২০১৯ সাল থেকেও বেশী উৎপাদন করেছে।
অক্টোবরের বৃষ্টিও চায়ের উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক ছিল বলে তিনি জানান।
এদিকে বাংলাদেশ চা বোর্ডের বিপনন কর্মকর্তা আহসান হাবিব টিবিএসকে জানান, ২০২০-২১ নিলাম বর্ষে (এপ্রিল ২০২০ থেকে জানুয়ারী ২০২১ পর্যন্ত) চট্টগ্রামে ৩৪ টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে এতে ১৮৮.০৮ টাকা কেজি ধরে ৭ কোটি ২ লাখ ৯০ হাজার কেজি বিক্রি হয়েছে এবং শ্রীমঙ্গলে ১৫টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে এতে ১৭১.৭৮ টাকা কেজি দরে ৭ লাখ ৯৫ হাজার কেজি চা বিক্রি হয়েছে।
২০১৯-২০ (এপ্রিল ২০১৯ থেকে মার্চ ২০২০) নিলাম বর্ষে চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলে মোট ৪৪টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয় এতে ১৭৬.০৮ টাকা দরে ৯ কোটি ৪৩ লক্ষ কেজি চা বিক্রি হয়।
টি প্লান্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিপিটিএবি) সদস্য সচিব জহর তরফদার বলেন, ২০২০ সালে শ্রীমঙ্গল নিলাম কেন্দ্রে করোনার শুরুতে গ্রাহকের উপস্থিতি খুব কম ছিল। তাই নিলাম অনুষ্ঠান নিয়ে আমরা সমস্যায় ছিলাম এবং চা বিক্রিও কমেছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু লকডাউন তুলে নেওয়ার পর আস্তে আস্তে গ্রাহকের হার বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে নিলামে আগের থেকে অনেক বেশি চা বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা বেড়েছে বলে অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপকভাবে চা বিক্রি হচ্ছে।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের সময় দেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ১৫০টি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা বছরে ৯ কোটি কেজি। ২০১০ সাল থেকে এই চাহিদা পূরণ করতে চা আমদানি শুরু হয়। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ এক কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি হয়।