জাতীয়ভিত্তিক প্রযুক্তিগত চাহিদা নির্ণয় জরিপ
আজ থেকে ঠিক একশো দশ বছর আগে ১৯১০ সালের চৈত্রমাসের একটা স্মৃতিচারণ দিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যাক। উড়িষ্যায় কটক কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন যোগেশচন্দ্র রায় নামের একজন বাঙালি অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও সাহিত্য, ও ইতিহাস চর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য পরবর্তীকালে তিনি 'বিদ্যানিধি' উপাধিপ্রাপ্ত হন।
বাংলাভাষায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ১৮৮৬ সালে পদার্থ, প্রাকৃতিক ভূগোল ও রসায়নের বোধগম্য পাঠ্যপুস্তক লেখাটা তাঁর একটা উল্লেখযোগ্য কাজ। নিজস্ব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেই বইগুলো যথাসময়ে পুরনো এবং অচল হয়ে গেছে; কিন্তু বাংলাভাষায় বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনেকগুলো মৌলিক পরিভাষা প্রবর্তন করার কৃতিত্বটি তাঁর অম্লান হয়ে আছে। প্রসঙ্গত তাঁর প্রবর্তিত পরিভাষাগুলোর মাঝে অন্যতম হলো 'মৌলিক পদার্থ'। বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে শুধু তাই তাঁর নামটি মেলে না, মেলে বাংলা ভাষা চর্চার ইতিহাস রচনা করতে গেলেও। কিন্তু ভাষার সাথে তাঁর এই সম্পর্কটি তৈরি হলো কীভাবে?
একদিনে যে না, তাঁর 'আত্মচরিত' পাঠে সেটার অজস্র উদাহরণ মিলবে। তারই একটা উদাহরণ নিচের এই স্মৃতিচারণ:
"পড়ছি, লিখছি, হয়তো কখনো আনমনে দক্ষিণ দিকে জানালা দিয়ে দেখছি। একদিন দেখি বেগুন গাছে কলসী কলসী জল ঢালছে। বালি মাটি, জল দাঁড়াচ্ছে না। বেগুন গাছগুলা আশুদ* (সম্ভবত যোগেশচন্দ্র এখানে কৌতুকের ছলে অশ্বথ গাছের কথা বলেছেন, অশ্বথকে কোথাও কোথাও এই নামে ডাকা হয়) গাছের মত বড় হয়েছিল, কিন্তু ফলত না। আরও দেখি বুঢ়া কুয়ার দুপাশে দুপা দিয়ে পিঠ মাথা নীচু করে কুয়া হতে জল তুলছে। কলসীটি ছোট হলেও সাত আটসের জল ধরত। আমার যেন হঠাৎ নিদ্রা ভঙ্গ হল। কুয়া হতে কলসী করে জল তুলতে হাজার বার দেখে থাকব, কিন্তু কখনও ভাবিনি মানুষের পিঠ মাথা নীচু করে জল তুলতে হয়, এই অবস্থায় বলবান মানুষকেও কলসী কলসী জল তুলতে হলে সে কতক্ষণ পারবে... আমার আর পড়াশুনায় মন বসল না।"
এক বৃদ্ধ উড়িয়া চাষার শ্রম লাঘবে একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের এই আকূল হওয়াই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে বায়ুকল (ওই 'বুঢ়া' যার নামটি রেখেছিলেন 'পবনচক্র') নির্মাণের প্রেরণা: "এমন কোন যন্ত্র চাই, যাতে মানুষের পূর্ণ সামর্থ্য জল তুলবে লাগবে। নীচু হয়ে শরীরের ভারও বইতে হবে না।"
বস্তুত যান্ত্রিক শক্তির প্রধান কাজটি হলো পেশী শক্তির ওপর মানুষের নির্ভরতা কমানো, তার কাজকে আরও দক্ষ করা। মানুষ যেন শরীরের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বাড়তি কাজ সহজে করতে পারে, সময়ের সাশ্রয় ঘটাতে পারে, বিশ্রাম ও বিনোদনের সুযোগ পায়- সেটাই যান্ত্রিক দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্য।
আজকেও যখন আমরা বাংলাদেশের বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে যাই, মানুষের শ্রমের বিপুল অপচয় আর শরীরের ক্লেশ লক্ষ্য না করাটা কঠিন হয়ে পরে। শুধু কিন্তু যান্ত্রিক শক্তির দক্ষতাবৃদ্ধি না, আজকের যুগে প্রযুক্তির এই ব্যবহারটি রসায়ন, জৈব ও এবং এমনকি প্রকৃতির নানান আন্তসম্পর্ক বিষয়ক জ্ঞান আহরণ ও উৎপাদনের বিকাশে তার প্রয়োগের বেলায়ও প্রযোজ্য। বলতে গেলে, একদিকে এই প্রযুক্তির ব্যবহারহীনতা এবং অন্যদিকে প্রযুক্তির বিচারবুদ্ধিহীন ব্যবহার, উভয়েই আমাদের জনজীবনকে পিছিয়ে রাখছে। বহুক্ষেত্রে বরং দ্বিতীয়টাই বেশি ভয়াবহ, কেননা তা অবাধে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস ও প্রাণের অস্তিত্ব ও উৎপাদনকেই বিপন্ন করার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
এইসব বিবেচনাতে প্রায়ই মনে হয় বাংলাদেশে যথাযথ একটা দেশব্যাপী জনগণের প্রযুক্তিগত চাহিদার জরিপ চালনা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। এই চাহিদা সর্বদাই ছিল, এবং নিয়মিত বিরতিতে তেমন একটা কাজ রাষ্ট্রের দিক থেকে বারংবার পরিচালনা করাটাই স্বাভাবিক হবার কথার। কারণ সময়ের সাথে সাথেই এই চাহিদাটি বদলাতে থাকে। কিন্তু সেটা আদৌ কখনো না হওয়াতে একদিকে কাজটা জটিল ও কঠিন হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত ভাবে নানান অগ্রগতি ও পশ্চাৎগতি একক কোনো জাতীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজটিকেও এলোমেলো ও কঠিন করে তুলেছে।
২.
খুবই আকর্ষণীয় একটা মত এই যে, বিজ্ঞান ও গণিতের আসল সৌন্দর্য হলো তার উপকারহীনতায়, প্রয়োগের জগতের সাথে তার দূরত্বে। গণিতবিদ গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি যেমন তার 'অ্যাপোলজি অব আ ম্যাথমেটিশিয়ান' গ্রন্থে বারংবার ঘোষণা করেছেন, গণিতের সেই অংশগুলোই সুন্দর, যেগুলো কোনো কাজে লাগে না। ফলিত গণিত কিংবা পদার্থবিদ্যা তাঁর কাছে তুচ্ছ, স্থুল এবং অনাকর্ষণীয়।
আচার্য সত্যেন বোসও তাঁর স্মৃতিকথায় বিমূর্ত গণিতের আনন্দের কথা লিখেছেন, বলেছেন, কোনো কাজে আসবে ভেবে তা তিনি ভাবতেন না। কিন্তু আজকে যা উপকার-নিরপেক্ষ বিমূর্ত তত্ত্ব, যাকে বলছেন হার্ডি বিশুদ্ধ গণিত, কাল হয়তো তা-ই কোনো বাস্তব কাজে লেগে যাওয়া ফলিত বিদ্যা। এমনকি হার্ডির বিশুদ্ধ, ভালো-মন্দের সাথে সংশ্লিষ্টতাহীন গণিতও পরবর্তীকালে বংশগতিবিদ্যার মতো প্রায়োগিক বিদ্যার রহস্য উন্মোচনসহ আরও বহু ফলিত কাজকর্মে প্রযুক্ত হয়েছে। বোসের গণিতের বেলাতেও এই শিক্ষাটি সমানভাবে খাটে। তবু তাদের কথার সৌন্দর্যগত সারবত্তা নিয়ে সন্দেহ করবার উপায় নেই, তারা বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার আনন্দেই থাকতে চেয়েছেন, প্রয়োগ নিয়ে অনেক সময়েই ভাবেননি।
প্রয়োগবিমুখ গণিত ও বিজ্ঞান চর্চার এই দার্শনিক উপলদ্ধির গভীরতা সম্পর্কে মুগ্ধতা রেখেও আমাদের ওই বাস্তবেই বারবার ফিরতে হয়। বাস্তব জীবনে আমাদের ফসল ফলাতে হয়, তাই খাবার জোটে। কখনো এমনকি যুদ্ধও করতে হয়। হার্ডিরই আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ বন্ধু জন এডেনসর লিটলউড তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নানান যুদ্ধাস্ত্রের গাণিতিক চাহিদা মেটাতে রীতিমতো কেমব্রিজের অধ্যাপনা ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন উৎসাহ ভরে।
হার্ডি তাঁর প্রিয়তম বন্ধুর এই কাজকে কখনো নিতে পারেননি। তবুও আমাদের পার্থিব জগতের সকল প্রয়োজন মেটাতেই- হোক তা ভালো কিংবা মন্দ- প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। শুধু তাই না, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের উপযুক্ত পরিবেশটা সৃষ্টিতেও ফলিত বিজ্ঞানের করবার মতো অনেক কিছু আছে। সত্যেন বোসের সমপ্রতিভা নিয়েই যে বালক আজ হয়তো শিশুশ্রমে যুক্ত, তার সাথে পদার্থবিদ্যার যোগসূত্র ঘটাতে হলে যেমন প্রয়োজন রাজনৈতিক বাস্তবতার বদল, তেমনি প্রয়োজন উৎপাদনের জায়গাগুলোতেও বহুরকম গণমুখী প্রযুক্তির প্রয়োগ। একইসাথে প্রয়োজন অপপ্রয়োগগুলোকে রুখে দেওয়াও, কেননা কায়েমী ক্ষমতার হাতে কুক্ষিগত থেকে দাপুটে মানুষদের প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে প্রায়ই দানবের চেহারা নিয়েই বহু মানুষের জীবনকে ধ্বংস করছে। সমাজে প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তার এবং অপপ্রয়োগ নিয়ন্ত্রণের বাস্তব গুরুত্ব নিয়ে না ভেবে আমরা থাকি কী করে!
৩.
বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবহনের জন্য যান্ত্রিক শক্তির চাহিদা দিয়েই আলাপটা শুরু করা যেতে পারে। বিশেষ করে গত কয়েক দশকজুড়ে নানান আকারের তিন চাকার বাহন, যান্ত্রিক নৌকা এবং আরও কিছু বাহনে নানান রকম যান্ত্রিক মোটর যুক্ত করে গ্রামাঞ্চলে পরিবহনের ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব এনেছেন গ্রামীণ কারিগর শ্রেণি। গত বিশ বছরে এর গতিকে আরও ত্বরান্বিত করেছে চীন থেকে আসা ছোট ছোট মোটর, এবং রিকশাকেও একটা যান্ত্রিক শক্তি দিয়েছে। গ্রামীণ পরিবহনে এটা আমূল পরিবর্তন এনেছে, কৃষকের অল্প পরিমানে মালামাল হাটে তুলে কিংবা নারীদের দূরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে- নসিমন, করিমন, আলম সাধু, ভটভটি এবং ইত্যাদি নানান নামের বাহনগুলো ছিল সেই পরিবর্তনের বাহক। কিন্তু বাংলাদেশে এই পরিবহনগুলোর সংখ্যা কত, কত মানুষ এর সাথে সম্পর্কিত কর্মসংসথানে যুক্ত আছেন, সমাজসম্পর্ক ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী, সে বিষয়ে খুব ভালো কোনো গবেষণা চোখে পড়েনি।
একটা জরিপে দেখেছিলাম, এদের সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ, মানে সোজাসুজিই বলা যায় উৎপাদন-পরিচালনা-বিপনন-চালক-সারাই ইত্যাদি সূত্রে লাখ পচিশেকের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান এরা তৈরি করছে।
কিন্তু গণমাধ্যম সূত্রে এদের প্রচলিত ভাবমূর্তি হলো, বাহনগুলো বেআইনি, এর চালকরা বেপরোয়া, এর প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে এই বাহনগুলো প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটায়। অর্থাৎ এ সম্পর্কিত নেতিবাচক অংশগুলো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের পরিবহনগত কত বিপুল চাহিদা এরা মিটিয়ে এসেছে তিন দশকের বেশি সময় ধরে, সেটা আমরা প্রায়ই খেয়াল করি না; কেননা এদের নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ প্রায় দেখতে পাবেন না।
গ্রামীণ জনগণের পরিবহনগত চাহিদাটি তো একটি বাস্তব সত্য। সেই চাহিদার জরিপটা কাদের করার কথা? সেই চাহিদা মেটাতে আমরা আমদানি নির্ভর হব, নাকি সেই চাহিদার সম্যক উপলব্ধির ভিত্তিতে বহু আগেই দেশীয় গাড়ি ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনের বন্দোবস্ত নেওয়ার কথা? তেমন কিছুর খবর আমরা দেখতে পাই না, শুধু ওই গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে দেখা পাই দুর্ঘটনার শিকার পঙ্গু মানুষজনের, যাদের অস্তিত্ব এই বাহনগুলোর বিরুদ্ধে একটা বিজ্ঞাপন হিসেবেই কাজ করে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর রূপান্তরের ইতিহাসে তার যথাযথ স্থানটি কী, তা অনির্দিষ্টই থেকে গেল।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি অদৃশ্য, সেটা হলো গ্রামীণ কারিগরদের এই প্রকৌশলচর্চায় সত্যিকারের প্রকৌশল বিদ্যা যারা জানেন, তাদের অংশগ্রহণ। এইসব গাড়িকে নিরাপদ করতে যদি এর গতি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা আধুনিক করতে হয়, এর কাঠামোতে যদি বদল করে দুর্ঘটনা কমানো যায়, এর উপকরণে বদল করে যদি এর ঝাঁকুনি কিংবা অস্বস্তি রোধ করা যায়, এদের জন্য আলাদা রাস্তা বরাদ্দ করা যায়, তাহলে গ্রামীণ জনসাধারণের চাহিদা মেটার পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যাও বহুগুণ হ্রাস পেতো। এ বিষয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা রীতিমতো লজ্জা পাবার মতো। একদিন এক উচ্চশিক্ষিত বন্ধু বলেই বসলেন, ব্যাটারি-রিকশা তো বিদ্যুতের অপচয় করে! বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রিকশা যদি তার যা লক্ষ্য, অর্থাৎ পরিবহন, সেটা করতে পারে, মালামাল বা যাত্রী বহন করতে পারে, মোটরগাড়ি, ট্রাক বা বাসের চাইতে বেশি যান্ত্রিক দক্ষতা নিয়ে, কম শক্তি (বিদ্যুৎ কিংবা তেল) খরচ করে, তাহলে সেটা অপচয় কী করে হয়?
আসলে এইখানে সঙ্কটটা দৃষ্টিভঙ্গির, দরিদ্র মানুষের প্রযুক্তির চাহিদাকে আমরা আসলে প্রায়ই চাহিদা বলেই স্বীকার করতে চাই না। কেননা আমাদের মনোজগতেই আছে, তারা কায়িক শ্রমে নিজেদের যান্ত্রিক চাহিদার অভাব মেটাবে। কেবল একজন সুহৃদ প্রকৌশলী মাহবুব সুমনকে দেখেছি রিকশা ও গ্রামীণ এইসব পরিবহনের সর্বোচ্চ গতি কমিয়ে এনে, চাকার আকৃতি ছোট এবং মোটা করে, পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা করে এই দুর্ঘটনা যে একদম কমিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে সরব হতে। খোঁজখবর নিয়ে রিকশা নিয়ে একজন বিদেশি রব গ্যালাহার এর একটা প্রামান্য গবেষণাগ্রন্থ 'The Rickshaws of Bangladesh'-এ দেখতে পেলাম অতি আধুনিক, নিরাপদ এবং কর্মদক্ষ রিকশার বহু মডেল বিদেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু আগেই তৈরি করা হয়েছে।
উন্নত প্রযুক্তির বিদেশিদের তা তেমন কাজে লাগে না, আমাদের লাগতে পারত। সেই শিক্ষাগুলোকে আমরা নসিমন-করিমনেও প্রয়োগ করতে পারতাম। কিন্তু সরকারী নীতি যেহেতু এই কোটি কোটি মানুষের জীবনকে বদলে দেওয়া গাড়িগুলোকে চিরস্থায়ী বেআইনি বানিয়ে রেখে ভারতীয় ও চীনা পরিবহনের ব্যবসার বিস্তার, ফলে এইসব গবেষণার ওই ইংরেজিভাষায় গবেষণাগ্রন্থেই চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। অথচ, গ্রামীণ এই পরিবহনগুলোর অদৃশ্য হবার কথা ছিল দেশেই আরও উন্নত প্রযুক্তির যানবাহন বিষয়ে গবেষণা, নির্মাণ ও বিপননের মাধ্যমে, ক্রমরূপান্তরের যে প্রক্রিয়াটা চীন-জাপান-কোরিয়া সর্বত্রই ঘটেছে তাদের ইতিহাসের এক একটা পর্বে।
শিক্ষক-গবেষক নোভা আহমেদের সূত্রে ভিন্ন রকমের একটা সম্ভাবনার অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেল, সেটাও এমন একটি জাতীয় ভিত্তিক প্রযুক্তিগত চাহিদা নির্ধারণের আলোচনায় খুবই প্রাসঙ্গিক। হাওর অঞ্চলের একটা বৈশিষ্ট্য হলো আকস্মিক ঢল। একদিকে এটা হাওরের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের অংশ, অন্যদিকে এই আকস্মিক ঢলের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাটা বিপুল। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস পেলেও হাওরবাসীরা হয়তো সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বেশ কিছুটা কমিয়ে আনতে পারতেন। তো, তারা ৬ জন গবেষক মিলে একটা সমন্বিত পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন, যেখানে সনাতন বন্যা পূর্বাভাস পদ্ধতির বদলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে একটা কার্যকর, বেশ জটিল কিন্তু সস্তা ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া যাবে, সেটাকে নিয়মিত উন্নতও করা যাবে।
হাওরের প্রসঙ্গেই বলা দরকার, সেখানকার বন্যা নিরোধ, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতির নামে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, সেটা কল্পনাতীত। অথচ অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত সেখানকার প্রকৃতির মৌল চরিত্র যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রেখেই এমন সব গবেষণায় যাতে বাংলাদেশের এই বিপুল সম্পদভাণ্ডারের মৎস্য, শস্য, প্রাণীজ সম্পদ ও জলসম্পদের সরবরাহ যেন ফুরিয়ে না যায় অপরিকল্পিত অবকাঠামো আর দখলদারিত্বে।
নোভা আহমেদের এই গবেষণা আমাদের এই ইঙ্গিত দেয় যে, ভৌগোলিক, জীবতাত্ত্বিক এবং কাঠামোগত গবেষণার পাশাপাশি এমনকি তথ্যপ্রযুক্তিরও কত তাৎপর্য থাকতে পারে জনজীবনের উন্নয়নে। রিসার্চগেটে এই সম্পর্কিত পেপারটি পাঠক পাবেন (লিঙ্ক t.ly/Rg13), কিন্তু এর কোন প্রয়োগ কী দেশে হয়েছে? মর্মান্তিক বিষয় বরং এটাও যে, ''সোনাবন্ধু' নামকরণ করা এই বন্যা পূর্বাভাস-প্রযুক্তিটি সম্পর্কে বাংলাতে কিছু খুঁজেই পেলাম না অন্তর্জালে। একটা উপযুক্ত সম্ভাবনা যা লক্ষ লক্ষ মানুষের উপকারে আসতে পারতো, তা কেবল একটা তত্ত্বগত বিষয় হিসেবেই থেকে যাবে হয়তো আরও বহুদিন। প্রযুক্তির কার্যকর হওয়াটা তাই শুধু বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় না, অনেকাংশে সমাজবিজ্ঞানেরও আওতায় পরে।
৪.
এমনিভাবে অনেকগুলো অত্যাবশ্যকীয় প্রযুক্তির প্রয়োগের সাথে দেশের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণের গভীর সম্পর্ক আছে। এই রকম একটা বিষয় হলো কৃষিতে সারের ব্যবহার। ২০২০ সালে সারে সরকারী ভর্তুকি ছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। গত এক যুগে ৭৪ হাজার কোটি টাকা সারে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে! সংখ্যাগুলো বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। এটা রাতারাতি একদিনে তুলে দিতে না বললেও এই বিপুল ভর্তুকি দেয়া সারের প্রয়োগের এবং অপ্রয়োগের মাত্রা, অপচয় বা যথার্থতা, দীর্ঘমেয়াদে আমাদের কৃষির ওপর এর ভূমিকা, সারের ভর্তুকিতে কৃষকের আর্থিক লাভ হচ্ছে না বনিকের আর্থিক লাভ হচ্ছে, তা নিয়ে কোন জাতীয় ভিত্তিক সমন্বিত গবেষণার দাবি করাটা কি অযৌক্তিক? কেননা আমাদেরকে ফসলের উৎপাদন হ্রাস না করেই-- এমনকি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করেও-- সারের এই্ বিপুল ভর্তুকির বিকল্প উদ্ভাবন করতেই হবে।
অথচ দেখুন, বাংলাদেশে নগরগুলোতে জৈববর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রায় শূন্যের কোঠায়, যার যথাযথ ব্যবহার ময়লাকে সারে পরিণত করে আমদানীকৃত এই সারের বিপুল চাহিদা বহুলাংশে কমিয়ে দিতে পারতো। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে নগরের এই বিপুল আবর্জনা আসলে গ্রামের জমি থেকে আসা পুষ্টিরই একটা রূপভেদ মাত্র। জমি থেকে গাছ ফসল ফলাতে যে পুষ্টিটি গ্রহণ করে, তার বড় অংশটারই ক্ষতিপূরণ করা যায় উচ্ছিষ্ট জৈবউপাদান এবং মলমূত্র জমিকে ফিরিয়ে দিয়ে। অন্যথায় কৃষিজমি পুষ্টির অভাবের শিকার হয়, নগরগুলো পরিণত হয় ময়লার ভাগারে। বর্জ্য এবং সারের ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণা, আইনপ্রণয়ন, এর সুবিবেচনাপ্রসূত ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করে ফেলাটা যে কোন দেশপ্রেমিক সরকারের অত্যাবশ্যকীয় কাজ হবার কথা। এইভাবে যে কোন গবাদিপশু-হাঁস-মুরগির খামারকে সুলভ ঋণ দিয়ে হলেও একক বা যৌথভাবে বায়োগ্যাসের প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধ্য করা, এবং তা দিয়ে একদিকে জ্বালানি অন্যদিকে নিরাপদ সারের যোগান পাওয়াটা খুব কঠিন হবার কথা ছিল না। একইভাবে, পৌরসভা বা নগরকর্তৃপক্ষের জন্যও বাধ্যতামূলক হবার কথা ছিল জৈববস্তুর প্রক্রিয়াজাতকরণ। সারের ভর্তুকিটা একদিনে তুলে দেয়া সম্ভব না, তবে কার্যকর গবেষণা ও উপযুক্ত জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সঙ্গতিপূর্ণ আইন কাঠামো ও আর্থিক প্রণোদনা সারের এই বিপুল আমদানী বা উৎপাদনকে ক্রমান্বয়ে একদমই কমিয়ে আনতে পারতো। কিন্তু এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতিতে আসলে রক্ষা করা হচ্ছে সারের আমদানীকারকদের স্বার্থ; প্রভাবকের ভূমিকা রাখছে নীতিনির্ধারণী আমলাদের প্রযুক্তির জগতের সাথে সংশ্লিষ্টতাহীনতা ও অজ্ঞতা, এবং সম্ভবত লাভের ভাগও। প্রতি বছরের এই ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি একবারে না কমিয়েও ধারাবাহিকভাবে জৈবসার ও বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্রমবর্ধমান ভর্তুকির ব্যবস্থা করে নিশ্চয়ই ৯ বছরে ক্রমান্বয়ে রাসয়নিক সারের ব্যবহারকে ন্যূনতম এবং যেসব ক্ষেত্রে আপাতত কোন বিকল্প নেই, কেবল সেগুলোতে সীমিত করা সম্ভব।
এই কথাগুলো রাসয়নিক বিষের ব্যবহারের বেলাতেও কী প্রযোজ্য নয়? কীটনাশকের বহু বিকল্প প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই বাজারে আছে। প্রয়োজন আরও বহু গবেষণার, সত্যি। কিন্তু সবার আগে দরকার গবেষণাগুলো যেন বাস্তবে প্রযুক্ত হওয়াটাকে প্রণোদনা দেয়া হয়, কখনো কখনো বাধ্যতামূলক করা হয়। গবেষক তাহলেই উৎসাহিত হবেন নতুন প্রযুক্তির সন্ধান করতে। ফলে যেখানেই নিরাপদ ও প্রাকৃতিক বিকল্প প্রযুক্তি সহজলভ্য ও কার্যকর হবে, সেখানেই রাসয়নিক বিষটিকে পারলে এক্ষুণি নিষিদ্ধ করা, না হলে অন্তত সেগুলোর ওপর কর চাপানো এবং ব্যবহারকে বিধিনিষেধের আওতায় নিয়ে আসাটা দরকার।পানি সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় হ্রাস ও মান রক্ষা করার গবেষণাও অগ্রাধিকার দাবি করে। একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম তিনি ইংল্যান্ডে পিএইচডি করার সময় দেখেছেন সেখানে বহু গবেষক ধান চাষে পানির ব্যবহার কমানো নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষণা আসলে গত একশো বছর ধরে চলছে, এবং ক্রমান্বয়ে সেগুলোতে বাস্তব কিছু সাফল্যও এসেছে। সদ্য প্রয়াত ভূগোলবিদ হিউ ব্রামার (বাংলাদেশের ভৌগোলিক গঠন নিয়ে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ, যার অন্যতম দুঃখ ছিল ভৌগোলিক জ্ঞানকে আমাদের দেশে ইতিবাচক প্রযুক্তিগুলোর প্রয়োগ ও উদ্ভাবনে কদাচ ব্যবহার করা হয়) তাঁর 'Bangladesh: Landscapes, Soil Fertility and Climate Change' নামের প্রামাণ্য গ্রন্থটিতে আর্সেনিকের বিষচক্র থেকে রেহাই পেতে ধান চাষে কম পানি ব্যবহার করবার নতুন প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের ওপর দারুণ গুরুত্বারোপ করেছেন। সেগুলো ওই সুপারিশেই থেকে গিয়েছে।
তারপরও এটা স্বীকার করতেই হবে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রগুলোর মাঝে কৃষিক্ষেত্রেই সবচাইতে বেশি এগিয়ে আছে। তবু এটা না বলে পারা যায় না যে, এই গবেষণার প্রয়োগের বেলাতে প্রত্যক্ষ মুনাফা আনে এমন প্রযুক্তিগুলোই মাঠ পর্যায়ে দ্রুত বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় এবং সামষ্টিক উন্নয়নে যে প্রযুক্তিগুলো জরুরি, কিংবা যেগুলো সার ব্যবসায়ী, কীটনাশক ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আঘাত করবে, সেগুলোর প্রয়োগ যথাসম্ভব ধীরগতিতে হচ্ছে। সরকারী আগ্রহের চাইতে মানুষের সচেতনতা সেসব ক্ষেত্রে বরং কিছুটা ভূমিকা রেখেছে।
বহুক্ষেত্রে কৃষক কিংবা কারিগর এমনকি তার চাহিদা সম্পর্কে সচেতন নাও থাকতে পারেন, যেটা শুরুর উদাহরণটিতে ওই উড়িয়া 'বূঢ়া'র বেলায় খাটে। বহুক্ষেত্রে সমস্যা নিয়ে সচেতন হলেও বিকল্পটি সম্পর্কে তার জানা নেই, সমাধান সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। এই জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তির মানুষদের সাথে কৃষকের কিংবা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের সাথে তুলনামূলক অধিকতর যোগাযোগ। গ্রামীণ নারীরা যেভাবে বসে রান্না করেন, তা তাদের স্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ বিকল্প প্রযুক্তি উপস্থিত, আরও গবেষণারও সুযোগ রয়েছে। এইরকম জনস্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রগুলোতে আসলে স্থানীয় প্রশাসনের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত অমুক অমুক ক্ষেত্রে অত দিনে এই এই বিষয়ে সাফল্য দেখাতে হবে। গ্রামীন বাসগৃহের সামগ্রিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অজস্র রকমের গবেষনা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবের সুযোগ রয়েছে। কৃষিযন্ত্রপাতির একরকম বিকাশ বাংলাদেশে ঘটেছে, এটা সত্যি। তাতে সরকারের ভূমিকা ও অংশগ্রহণ অতি সামান্য। কিন্তু গবেষণার পেশাদারিত্ব ও আধুনকি কৃৎকৌশলের সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে স্থানীয় পর্যায়ের এই যন্ত্রগুলোও শক্তির অপচয় সর্বোচ্চ মাত্রায় কমিয়ে আনতে সক্ষম হয় না, নতুন যন্ত্রপ্রকৌশল, ধাতু ও উপাদানগত বিদ্যাগুলোর অভাবে। এই খাতগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের করবার মত অনেক কিছুই ছিল। কৃষি পর্যায়ে নানান রকম পরীক্ষানিরীক্ষার সুবিধাও বহুমাত্রিকভাবে বৃদ্ধি করা দরকার। মাটির গুনাগুন পরীক্ষা আগের চাইতে এখন কিছুটা সহজ হয়েছে, কিন্তু খামারীদের কাছ থেকে শুনেছি দুধে নানান রকম রাসয়নিকের উপস্থিতি পরীক্ষা করতে এত বেশি টাকা লাগে যে ছোট খামারীরা নিরুৎসাহিত হন।
এই ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা আসলে হলো কৃষির মুনাফাহীনতা। প্রযুক্তির বাজার হিসেবে কৃষক তখনই দেখা দেবেন, যখন কৃষিতে লাভ আসবে এমন হারে যে, তিনি পেশীশক্তি বা সস্তা রাসয়নিকের বিকল্প হিসেবে নতুনতর প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে সমর্থ হবেন। মুনাফার হার বাড়লেই কেবল শিক্ষিত তরুণ শ্রেণিও আরও বেশি হারে কৃষিতে আসবেন, যারা প্রযুক্তির বিষয়ে তুলনামূলকভাবে কৌতূহলী ও উদার।
এই তরুণরা হয়তো রাজনৈতিকভাবেও নতুন সময়ের উপযুক্ত করে তাদের দাবিগুলোকে তুলতে পারবেন, সংগঠিত করতে পারবেন, সংঘঠিতভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন। সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও অংশ হতে পারে অজস্র লাগসই প্রযুক্তির বিকাশ কিংবা ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত প্রযুক্তির প্রয়োগ।
কৃষিপণ্যের বিপুল অপচয়ের কথাই তোলা যাক না কেন! এই ঋতুতে যারাই গ্রামাঞ্চলে গিয়েছেন, দেখতে পেয়েছেন টমেটো, মূলা, কপি, সীম সহ বহু ফসল কৃষকরা মাঠ থেকেই তোলেনইনি। কারণ সেগুলো উত্তোলন, বাজারজাতকরণ এসবের খরচ বিক্রয়মূল্যের চাইতে বেশি। ফলে লোকসানকে আরও গুরুভার করবার চাইতে মাঠের ফসল মাঠেই পচিয়ে ফেলা। অথচ এগুলোর একটা বড় অংশকে আধুনিক ও সস্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুকিয়ে বা প্রক্রিয়াজাত করে অন্য ঋতুতে ব্যবহার করা যায়। এভাবে সংরক্ষিত খাবার অন্য ঋতুতে আমিষ, খাদ্যপ্রাণ ও শ্বেতসার ও শর্করার গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। এ ধরনের ফসলগুলোর তালিকা করা, সেগুলোর নিরাপদ সংরক্ষণের প্রযুক্তি কৃষকের মাঝে জনপ্রিয় করা এবং আরও নতুন উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু তার জন্যও চাই একটি প্রযুক্তিগত চাহিদা জরিপ: দেশব্যাপী, বছরব্যাপী কোন কোন ফসলের বিপুল অপচয় ঘটে এবং সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করার বেলায় সম্ভাব্য কী কী ভূমিকা নেয়া যেতে পারে। এমনটা ঘটলে ভরা মৌসুমে দাম কমে যাওয়াতে কৃষক ফসল বিনষ্ট না করে আক্রার মৌসুমে তা বিক্রি করে বাজারে তার অবস্থানকে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী করতে পারতেন।
৫.
ফলিত বিজ্ঞানের সাথে জনসমাজের সম্পর্ক দুইভাবে হয়। একটা মুনাফার তাগিদে, অন্যটি বিজ্ঞানীর সহমর্মিতার শক্তিতে। দুয়ের কোনটিই মিথ্যা নয়। আপাত দৃষ্টিতে মুনাফার তাগিদকে অনেক শক্তিশালী মানবিক তাড়না বলে মনে হলেও রাষ্ট্র ও সমাজে যদি তাকে লাগাম পড়াবার কোন বন্দোবস্ত না থাকে, গোটা সমাজ বিপন্ন করতে পারে সে, প্রযুক্তি দেশ জোড়া মানবিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। মাত্র মাস দুয়েক আগে নভেম্বরে পত্রিকায় পড়লাম টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে কারখানার বর্জ্যের কারণে বিপুল পরিমান জমির ফসল বিনষ্ট হবার কথা। একই কথা শুনলাম কুমিল্লায়, সেখানকার ইপিডেজ থেকে স্থানীয় খালে বিষাক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার ফলে স্থানীয় মানুষজনের দুর্বিষহ দশা। সাভার এলাকাতে এমন সংবাদ প্রায় নৈমত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
খুব দূরের, অচেনা কৃষকের সমস্যা? অথচ এই খাদ্যই শেষ পর্যন্ত বাজার ঘুরে আমাদের পাতেই আসে। এই প্রকৃতি বিপন্ন হলে আমরা কেউই রক্ষা পাবো না। শেষ পর্যন্ত সকলেই আমরা এই বৃহৎ প্রকৃতিরই অংশ। কাকতালীয়ভাবে টাঙ্গাইলের সংবাদটা পড়ার ঠিক চারদিন পর একজন ভদ্রলোককে দেখলাম ফোনে আলাপ করছেন স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে দেনদরবার করে সংবাদ বন্ধ করা যায় কি না; ক্ষতিপূরণও যাতে যথাসম্ভব কম দিয়ে পারা যায়, তার জন্য কী করা যায়, তেমনটা চেষ্টা-চরিত্র করছেন। এজন্য টাকা পয়সাও কিছু তিনি খরচ করতে রাজি আছেন।
এই ধরনের দূষণের সংবাদে কিন্তু যে চিত্রটি আমরা পাই, সেটা থেকে একাধিক বাস্তবতা উঠে আসে। প্রথমত যে একটা বিষয় প্রথমে স্থিরনিশ্চিত করতে হবে, সেটা হলো মাটি-পানি-বায়ূর প্রাকৃতিক দূষণ কোন কারখানা করতে পারবে না। এই কারখানাগুলো সেই শর্ত মেনেই স্থাপিত হয়েছে। স্থানীয় জনগণের কারখানার দূষণের শিকার হবার এইসব ঘটনাতে প্রযুক্তির সঙ্কটের চাইতে অনেক বেশি উপস্থিত আইনের কার্যকর না হওয়ার সঙ্কট, দূষণকারীদের শক্তিমত্তা ও যোগাযোগের বিপরীতে জগণের অসংগঠিত ও অসহায়ত্বের সঙ্কট, তথ্যহীনতার সঙ্কট। দ্বিতীয়ত যে বিষয়গুলো দেখা দরকার, সেটা হলো কারখানার এই দূ্ষণ বন্ধ করার, বাতাস- পানিকে শোধন করবার বিকল্প প্রযুক্তি আমরা কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, গবেষণাগারগুলোতে উদ্ভাবন করতে পারবো না? সেগুলোর প্রয়োগ কেন পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না?
যোগেশচন্দ্র রায় বা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মত মানুষেরা তাদের গবেষক ও উদ্ভাবক জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন প্রযুক্তির সাথে জীবনের এই সম্পর্ক নির্মাণে। রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সহযোগিতা তাঁরা পাননি, বরং তাদের লক্ষ্য ছিল উপনিবেশিক রাষ্ট্রের বাণিজ্য ও করনীতি যেভাবে দেশীয় শিল্পকারখানাকে ধ্বংস করছে, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেষ্টা। আজকে তো আমাদের নিজেদের রাষ্ট্র, কিন্তু এই রাষ্ট্রের ভূমিকা কতখানি আলাদা এই সব ক্ষেত্রে? সত্যি যে, এই কাজটা আর একজন দুই জন বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদের পক্ষে সেইভাবে করাটা সম্ভব না। তবুও জাতীয় ভিত্তিকে অঞ্চল, পেশা ও আরও নানা বৈচিত্র ভেদে গোটা বাংলাদেশের একটা প্রযুক্তিগত জনচাহিদা নির্ণয় করা গেলে ভবিষ্যতের গবেষক ও উদ্ভাবকরা সেখান থেকে নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে পারতেন। একইসাথে জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় ভবিষ্যতে এই চাহিদা মেটাবার জন্য নিয়োজিত গবেষকদের উৎসাহিত ও পুরস্কৃত করবার বন্দোবস্তও থাকা প্রয়োজন, প্রয়োজন সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির বন্দোবস্ত।
এই প্রসঙ্গে একটা হাল আমলের গল্প দিয়েই আজকের আলাপটার শেষভাগে যাওয়া যাক। একাত্তর টিভিতে ২৩ এপ্রিল, ২০২০ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাবেরা গুলনাহার একটা টকশোতে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত কিট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, '(অ্যানটিজেন টেস্ট) কখনো পিসিআর এর সমান হতে পারবে না, কখনোই না, গোটা বিশ্ব চলছে পিসিআর টেস্ট। র্যাপিড টেস্টটা তো চলছে না।' পিসিআর-অ্যানটিজেন/অ্যানটিবডি বিতর্কে আর না যাই, সরকারের অনুৎসাহে এই গবেষণা বিফলে গেছে, ড. বিজন শীলের মত কৃতী গবেষককে দেশত্যাগে একরকম বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু ড. জাফরুল্লাহ এর উত্তরে গুলনাহারকে যা বলেছিলেন, সেটা প্রযুক্তিবিদ্যাগত পরনির্ভরশীলতা ও চিন্তাহীনতার সাথে উপনিবেশিক মনের যে সম্পর্ক, সেটার কোন ইতিহাস লেখা হলে সেখানে উদ্ধৃত হবার মত। জাফরুল্লাহ উত্তরে বললেন: "একটা সময় মনে করতো সাদা সাহেবরাই সবচাইতে উন্নত। এখানে গুলনাহারের মত একজন মহিলা বিজ্ঞানী হবেন সেটাও আমাদের দেশে অনেক স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু আজকে আপনার মত বিজ্ঞানী আছে। এবং আরও অনেকেই আছেন... আজকে পর্যন্ত পিসিআর পদ্ধতিই প্রধান। এটার বিকল্প কিছু নাই। কিন্তু না থাকলেও আজকের পৃথিবীতে এর চিন্তা শুরু হয়েছে, হয়তো আমরাই এর অগ্রপথিক।"
গণস্বাস্থ্যকিটের যে আবিস্কারটা আমাদের বহু ধাপ এগিয়ে নিতে পারতো আত্মবিশ্বাসে আর অনুপ্রেরণায়, কিংবা তার ব্যর্থতা থাকলেও সেগুলো শুধরে উন্নত করবার চেষ্টা আমরা করতে পারতাম, সেটাকে রীতিমত কসরত করেই বন্ধ করা হলো। সেটা তো রাষ্ট্রীয় নীতি। কিন্তু গুল নাহারের মতই এই যে, যা নাই, তা কখনো হবে না, এই দৃষ্টিভঙ্গিটা নিজেও একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এর চাইতে বড় শেকল আর নাই। জনগণের উপযুক্ত প্রযুক্তি নির্মাণে, কিংবা প্রযুক্তির অপপ্রয়োগ থেকে মানুষকে রক্ষায় গবেষক ও বিজ্ঞানীদের ভাববার বহুক্ষেত্র প্রতিদিন উন্মোচিত হচ্ছে। প্রকৌশলী, রসায়বিদ, কৃষিবিদ, স্থপতি প্রভৃতি বিজ্ঞানের খাতগুলো শুধু নয়, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মানুষদেরও এবিষয়ে প্রভূত মনোযোগ দেয়া দরকার। এটা সব সময়ে বিরাট তহবিল আর দালানকোঠার বিষয় না। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেই একটা আলোচনায় বলতে শুনেছিলাম যুগান্তকারী পেনিসিলিন আবিষ্কারের সময়ে গবেষণাগারটির আসবাবপত্রও ঠিকমত ছিল না; সাহস আর সৃজনশীলতাও জরুরি। আজকে প্রতিবছর বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করা ওরস্যালাইনের প্রযুক্তিটি ১৯৬৮ সালে চূড়ান্ত হবার পর দশ বছরেরও বেশি কাগুজে বাস্তবতা হিসেবে ছিল, কেউ স্বপ্ন দেখেনি সেটাকে গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। গণস্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮১ সালে এই কাজটা করে, সুলভমূল্যে মোড়কজাত খাবারস্যালাইন বাজারজাত করার মধ্য দিয়ে। বাকিটা ইতিহাস।
প্রযুক্তিটাকে মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য উপযোগী করতে তাই নিছক প্রযুক্তির জ্ঞান যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন তাই সমাজ বিষয়েও বাস্তব জ্ঞানের। আরও প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে জনগণের প্রযুক্তিগত চাহিদার একটা জরিপ (এমনকি একটা উপজেলা বা অঞ্চল ভিত্তিক একটা পরীক্ষামূলক জরিপও চালানো যেতে পারে কাজটার জটিলতা ও সম্ভাবনা বোঝার জন্য)। সেটা যদি করা যায়, এমনকি মানুষের প্রযুক্তিগত চাহিদার একটা রূপরেখাও আমরা তৈরি করতে পারি, তা মেটাবার উপযুক্ত একটা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবেশও নির্মাণের স্বপ্ন দেখা ও দেখানোটাও যুগন্ধর বিজ্ঞানী/প্রযুক্তিবিদের দায়িত্বের মাঝেই এসে পরে।
- লেখক: প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক