ঘরের মাঠে পেসাররা যেন ‘সৎ’ ভাই
মুখে এক, কাজে আরেক। টেস্ট ক্রিকেটে পেসারদের নিয়ে বাংলাদেশের কোচ, নির্বাচকদের বলা কথা 'বুলি' হয়েই থেকে যায়। ঘরের মাঠে ম্যাচ হলেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয় স্পিনকে। একই পরিবারের সদস্য হয়েও পেসাররা হয়ে ওঠেন 'সৎ' ভাই।
ঘরের মাঠের সুবিধা সব দেশই নিয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য বিবেচনায় বরাবরই স্পিনারদের ওপর ভরসা করে বাংলাদেশ। কিন্তু সব সময়ই পেস আক্রমণের উন্নতি নিয়ে শোনানো হয় আশার কথা। যা প্রতিবারই 'আশার বাণী' হয়ে থেকে যায়।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও একই গল্প। চার স্পিনার ও এক পেসার নিয়ে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ। এই গল্পও অবশ্য নতুন কিছু নয়। বরং পেসার ছাড়াও বাংলাদেশের টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা আছে।
সেদিক থেকে কম পেসার খেলানোর বিষয়টি নিয়ে হাহাকার হওয়ার কথা নয়। হাহাকারটা আবু জায়েদ রাহি ও আশার বাণী নিয়ে। ডানহাতি এই পেসার টেস্টে বাংলাদেশের পেস আক্রমণের প্রধান হাতিয়ার। গত কয়েক বছর ধরে তার ওপরই ভরসা রাখা হচ্ছে। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষেও রাহির খেলার বিষয়টি ছিল অতি স্বাভাবিক। কিন্তু ৯টি টেস্ট খেলা রাহিকে না নিয়ে খেলানো হয়েছে মুস্তাফিজুর রহমানকে।
যদিও টেস্ট ক্রিকেটে হঠাৎ-ই মুস্তাফিজের অন্তর্ভুক্তি ততোটা অবাক করা বিষয়ও নয়। অবাক করার বিষয় রাহিকে একাদশের বাইরে রাখা। বরাবরই বলে আসা হয়েছে, সাদা পোশাকে দারুণ ধারাবাহিক রাহিকে নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এমনকি টেস্ট সংস্কৃতির চিন্তা করে পেসারদের তৈরি করা হবে। যে পরিকল্পনার অংশ আরেক ডানহাতি পেসার এবাদত হোসেন। আছেন খালেদ আহমেদও।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট স্কোয়াডে আছেন পাঁচ পেসার। রাহি, এবাদত ও মুস্তাফিজের সঙ্গে আছেন তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদরাও। স্কোয়াডে পাঁচ পেসার দেখে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের টেস্ট সংস্কৃতির অংশ হতে যাচ্ছে পেস আক্রমণ। যদিও সে আশা বেশি সময় টেকেনি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ চলাকালীন বিসিবির প্রধান নির্বাচক বলেছিলেন, 'আমরা ঘরের মাটিতে সব সময় যেভাবে খেলি, সেভাবেই খেলব।' এরপর প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোও একই সুরে কথা বলেন। চট্টগ্রামের উইকেটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রামের উইকেট যতটা দেখেছি, তাতে পেসারদের হুমকিস্বরূপ মনে হয়নি। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা যেন আমাদের শক্তির জায়গা অনুযায়ী খেলি।'
ঘরের মাঠে সামর্থ্য অনুযায়ী খেলা মানেই স্পিন নির্ভর বোলিং আক্রমণ। হোক প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্বাগতিক দল হওয়ার সুবিধা আদায় করতে এমন কৌশল নেওয়াতেও আপত্তি তোলার কিছু নেই।
কিন্তু দলের সঙ্গে রেখে, পরিকল্পনার কথা শুনিয়ে পেসারদের যে স্বপ্ন দেখানো হয়, সেটা বাস্তবায়ন না করার কৌশলে সাবেক থেকে শুরু করে বর্তমান অনেক ক্রিকেটারেরই আপত্তি। তাদের অনেকেরই বিশ্বাস, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা শুনিয়েও অন্য কৌশল নেওয়ায় দীর্ঘমেয়াদের জন্য ক্ষতি করা হচ্ছে পেসারদের। এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে পেসারদের কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নও অনেকের।
এমন হতে থাকলে পেসাররা টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ হারাবে বলে মনে করেন বিকেএসপির ক্রিকেট পরামর্শক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। বিসিবির সাবেক এই কোচ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির কারণে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে খেলোয়াড়দের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ওরা যখন দেখবে টেস্টে ঘরের মাঠেই খেলার কোনো সুযোগ নেই, তখন তাদের আগ্রহ কমতে পারে আরও। তখন তারা টেস্ট বাদ দিয়ে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডের দিকে বেশি মনোযোগী হবে।'
'কারণ এখানে ক্যারিয়ার ভালো হয়, আয় ভালো হয়। বাংলাদেশের খেলোয়াড় টেস্ট খেলে খুব বেশি আয় করতে পারে না। টেস্ট ক্রিকেটে বোলিংটা অনেক কষ্টকর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির থেকে। পরিশ্রম করার পর যখন সুযোগ পাবে না, তারা হতাশ হবে, নিরাশ হবে। এটার জন্য তারা টেস্ট ছাড়া অন্য ফরম্যাটে মনোযোগী হবে। এটার জন্য ভবিষ্যতে আমাদের টেস্ট উপযোগী বোলার আস্তে আস্তে কমতে থাকবে।' যোগ করেন পৌঢ় এই কোচ।