ইবুক ছাপাবইকে মার দেবেই
অ্যামাজনের ধাক্কা পৃথিবীর সব বড় বড় বইয়ের দোকানেও লেগেছে।
২০০১ সালে অ্যামাজন প্রথম লাভের মুখ দেখে। এখন অ্যামাজনের কর্মচারির সংখ্যা ৭ লক্ষ ৯৮ হাজার। আর ২০২১ সালে জেফ বেজোস পৃথিবীর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ধনী, সম্পদের পরিমাণ ১৮২ বিলিয়ন ডলার। তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাটিও অনেক খরিদ্দারকে টেক্কা মেরে কিনে নিয়েছেন। তিনি বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন সনাতন প্রকাশনা জগতকে।
ইবই ছাপা-বইকে মার দেবেই। ছাপা বই সাড়ে পাঁচশত বছর রাজত্ব করেছে, আর কতো?
কেন ই-বইয়ের জন্য পক্ষপাত বেড়েই যাবে, আমরা যারা প্রযুক্তির সড়কে পা রাখতে পারবো না পিছিয়েই পড়বো, তার কিছু কারণ জানলে বরং ভালো। আমাদের পছন্দকে যৌক্তিক করে তুলবে।
১. ইবুক হচ্ছে গ্রিন বুক (লিবিয়ার মুয়ামের গাদ্দাফির গ্রিন বুক নয়)- পরিবেশ বান্ধব বই। বইয়ের কাগজ উৎপাদনের জন্য একটি গাছও কাটতে হবে না।
২. বাসায় বই রাখার কোনো জায়গা নাথাকলেও সমস্যা নেই। ইবুক নিজের জায়গা করে নেবে।
৩. ঘরে বসে তাৎক্ষণিক ই-বুকের সরবরাহ নেওয়া যাবে। বইপত্র আমদানী-রফতানির আইন কানুন ও প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করা যাবে। ৷
৪. বইয়ের জন্য গাড়ি ভাড়া দিয়ে দোকানে-দোকানে ও লাইব্রেরিতে ও লাইব্রেরিতে ছুটোছুটি করতে হবে না।
৫. ফটোকপি করা স্ক্যান করা এসব ঝামেলা পোহাতে হবে না।
৬. ইবুক গুদামজাত করার জন্য গুদামঘর লাগে না, বড় দোকান লাগে না। ব্যবহারের জন্য বিশাল লাইব্রেরি লাগে না। ল্যাপটপ কি রিডিং ডিভাইসে হাজার বই সঞ্চিত রাখা যায়।
৭. বাসে ট্রেনে প্লেনে স্টিমারে কোর্ট কাচারিতে যেকোনো জায়গায় পড়া সম্ভব।
৮. অতি সহজে বহন করা যায়। শত মেট্রিক টন ওজনের বইও ই-বুক হিসেবে অনায়াসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক দেশ থেকে অন্যদেশে নিয়ে যাওয়া যায়।
৯. ইবুক পরিবহনে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হবার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
১০. ইবুক বাজারজাত করার সময় মেগা স্টোরের যেকোনো পণ্যের মতো বোনাস দেওয়া যায়। মূল্যমানের ওপর পয়েন্ট দেওয়া যায়। পয়েন্ট ঠিক টাকার মতোই আরো বই কিনতে সুযোগ করে দেয়।
১১. ইবুক লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে জ্ঞানের আরো জানালা খুলে দেয়।
১২. ইবুকে পাতা উল্টে উল্টে খোঁজার দরকার হয় না, সার্চ দিয়েই নির্দিষ্ট বিষয় বের করা যায়।
১৩. ইবুক পাঠাতে, আনাতে প্যাকেজিং করাতে হয় না, শিপিং খরচও নেই।
১৪. কাগজে ছাপা অবস্থায় পড়তে চাইলে কোনো সমস্যা নেই, কেবল প্রিন্টার থাকলেই হলো। ইবুক থেকে কমান্ড দিয়ে মুদ্রিত পাতা পাওয়া সম্ভব।
১৫. ইবুক আরামে পড়ার জন্য ফন্ট সাইজ ছোট-বড় সোজা-ইটালিক যেমন ইচ্ছে করা যায়।
১৬. ইবুকের বিপণন ও বিতরণ অত্যন্ত সহজ। শুধু দরকার ব্যবহারকারীর ভালো নেটওয়ার্ট।
১৭. ইবুক বৈষম্য দূর করে। কসমোপলিটান সিটিতে হোক কি অজপাড়া গাঁয়ে- ইবুকে সবার প্রবেশাধিকার সমান।
১৮. কম্পিউটারের সামনে যেহেতু আপনাকে অনেকক্ষণ থাকতেই হচ্ছে, আর একটি উইন্ডো খুলে একই সঙ্গে আপনার প্রিয় লেখকের বইটিও পড়তে পারেন।
১৯. খেতে খেতে শুতে শুনে যেকোনো সময় যেকোনো অবস্থায় ইবুক পড়তে পারেন।
২০. ভুলবশত মূল্যবান বইটি কোথাও হারিয়ে ফেলার কিংবা লোপাট হতে দেবার সুযোগও নেই।
২১. আইপ্যাড, আইফোন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করে বই পড়া যায়।
২২. বইয়ের প্যাসেজ সার্চ করা, স্কিমিং করা ইবুকে খুব সহজ হয়ে গেছে। হাইলাইট করা ও আংশিক অনুবাদ করাও সহজ ব্যাপার।
২৩. মিটিং, কনফারেন্স বিরক্তিকর বক্তৃতা- এসব এড়াতে ইবুক শ্রেষ্ঠ সহায়ক।
২৪. ইবুক পড়ার জন্য সন্ধ্যা কিংবা রাতের ভূমিকা নেই। অন্ধকারেও বিষয় ভিত্তিক পাঠ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
২৫. একহাতে নিয়ে পড়া চালিয়ে যেতে পারেন।
২৬. পৃষ্ঠা ভেঙে রাখার কোনো দরকার হবে না।
২৭. ডিকশনারি কেনার দরকার নেই। কম্পিউটারে কিংবা রিডিং ডিভাইসে ডিকশনারি থাকছেই।
২৮. ইবুক যদি কষ্ট করে না পড়তে চান তাহলে অডিও অপশনে গিয়ে শুনুন, অন্যকেউ পড়ে শোনাবে; ভিডিও দেখতে পারেন।
২৯. চব্বিশ ঘণ্টার যেকোনো সময় ইবুক কিনতে পারেন; যেকোনো দিন, যেকোনো মাস, যেকোনো বছর- কোনো ছুটি নেই ইবুক শপে।
৩০. ইবুকের দাম ছাপা বইয়ের সিকিভাগেরই কম।
৩১. উঁইপোকার সাধ্য নেই ইবুকে কামড় বসায়।
ই-রিডার: পাঠের স্বাচ্ছন্দ
ইবুক পড়ার কাজটা সহজ ও স্বাচ্ছন্দের করতেই ইরিডার ডিভাইস তৈরি করা হয়েছে। ২০১৫ সালে ২০ মিলিয়ন ইরিডার বিক্রি হয়েছে; ২০১৬ সালে পৃথিবীতে যত বই বিক্রি হয়েছে তার ২৩ ভাগ ইবুক। বইয়ের বাজারে ইবুকের শেয়ার বেড়েই চলেছে। ২০০৪ সালে প্রথম ইরিডার সোনি লিব্রি বাজারে আসে।
একসঙ্গে হাজার হাজার বই বহন করা যায়, পছন্দের বইটি পড়া, কিংবা অন লাইন লাইব্রেরিতে প্রবেশাধিকার নিয়ে সেখানকার পছন্দের বইটি পড়ার জন্য ইরিডার সবচেয়ে উপযোগী ডিভাইস, একবার চার্জ করলে সাতদিন চলে যায়, ট্যাবলেট কিংবা ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনে পড়ার চেয়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ দেয় ইরিডার। ২০২০ ও ২০২১ সালের সেরা রিডিং ডিভাইস একটি তালিকা দেওয়া হচ্ছে :
১. অ্যামাজন কিল্ডল পেপারহোয়াইট (১০ম প্রজন্ম)
২. কোবো ক্লারা এইচডি, এইচ ২০
৩. অনিক্স বুক নোট এয়ার
৪. অ্যামাজন কিল্ডল কিডস এডিশন
৫. অ্যামাজন কিন্ডল ওয়েসিস
৬. বার্নস অ্যান্ড নোবল লুক গ্লোলাইট থ্রি
৭. কোবো ফর্মা
৮. কোবো লিব্রা
৯. অনিক্স বুক্স (বিভিন্ন সংস্করণ)
১০. পকেট বুক (বিভিন্ন সংস্করণ)
১১. টলিনো (বিভিন্ন সংস্করণ)
ইরিডার বাজার ছেয়ে ফেলার পর ছাপা বই, ছাপা ম্যাগাজিন ও ছাপা জার্নালের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় আরো বেড়ে গেছে। ইরিডারের সাথে সহায়ক পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ওভারড্রাইভ কিংবা হুপলার মতো অ্যাপস ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে লাইব্রেরির কনটেন্ট নামিয়ে আনা যায়।
ইবুক
ইবুক সেন্সরশিপকে পাত্তা দেয় না। কনফুসিয়াসের অ্যানালেক্টস, এরিস্টোফেনেস-এর লাইসিসট্রাটা, ওভিদের আর্স অ্যামোরাটা, হথর্নের স্কারলেট লেটার, ওয়াল্ট হুইটম্যানের লিভস অব গ্রাস, তলস্তরের ক্রুতজার সোনাটা, মার্ক টোয়েনের টম সয়্যার ও হাকলবারি ফিন, জেমস জয়েসের ইউলিসিস, এবং আরো বিখ্যাত সব বই সেন্সরের শিকার হয়েছে, বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ইবুক পাঠককে লেখকের অখন্ড লেখাটি পড়ার সুযোগ করে দেয়।
ইবুক প্রযুক্তি যে কোনো আগ্রহী ব্যক্তিকে লেখক হবার এবং তার বই ইবুক হিসেবে প্রচার করার সুযোগ করে দেয়। লেখক বড় কর্পোরেট প্রকাশককে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পারেন।
ছাপা বইয়ের ভ্রান্তি সংশোধনের জন্য যেমন সংস্করণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়, ইবুকের বেলায় কাজটা তাৎক্ষণিক করা যায়। সংশোধন সংযোজন বিয়োজন পরিমার্জন সবই করা যায়-- যখন ইচ্ছে তখন।
পড়তে ইচ্ছে না করলে ইরিডারের সাথে লিসনিং ডিভাইস যুক্ত করে শোনাও যায়।
যে কোনো সময় যে কোনো অবস্থায় প্রিন্টার পোর্টের সাথে সংযুক্ত করে প্রয়োজনীয় অংশের প্রিন্ট আউটও নেওয়া যায়।
মাইকেল হার্টের গুটেনবার্গ প্রজেক্টকে ধন্যবাদ এ পর্যন্ত বিনে পয়সায় প্রায় সত্তর হাজার বই ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সকলের কাছে সহজলভ্য করে দিয়েছেন। গুটেনবার্গ প্রজেক্টে আরো বই আসছে; এমন আরে প্রজেক্টও হচ্ছে।
মূল বই অক্ষত রেখে যথেষ্ট দাগাদাগি করা যায় পাশে নোট লেখা যায়। হাইপারলিঙ্ক ক্লিক করে ইবুকের সূত্র পরীক্ষা করা যায়, গবেষণাকর্ম অবাধে চালানো যায়।
দৃষ্টিসংকট কিংবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধিত্বের পাঠের সহায়তায় ফন্টের আকার ও আলো প্রয়োজনমত বাড়ানো যায়।
ইবুক তাৎক্ষণিকভাবে আরাধ্য প্রাপকের কাছে পাঠিয়ে তার মতামত, পরামর্শ গ্রহণ করে পান্ডুলিপি সংশোধন করা যায়। ইবুক যত বেশি প্রচারিত হয় তা সেই বইয়ের ছাপা সংস্করণের বিক্রিও বাড়িয়ে দেয়।
আগুন দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ভষ্মীভূত করা যায়। ইলাইব্রেরি ফায়ার প্রুফ; ব্যাক-আপ থাকলে ডিভাইস ক্রাশ করলেও সমস্যা নেই।
ইবুক নীরব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাক ও লেখার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে।
ইবই পড়ার আরও লাভ
ইবই পড়া টাকা বাঁচায়, বই পড়াকে বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে ব্যয় বহুল বিনোদন লিপ্ত হবার প্রয়োজন হয় না; বেঁচে যাওয়া টাকায় আরো বই কেনা যায়, সেসব বই পড়তে পড়তে আরো বেশি বাড়তি ব্যয় থেকে রেহাই মেলে। বই পড়া মানুষের অনেক দক্ষতা সৃষ্টি হওয়া ছোটখাট কাজের জন্য ঠিকাদার, মজুরের পিছনে টাকা ঢালতে হয় না।
বিস্ময় বাড়ায়
বইপড়া মানুষ নিত্যই নতুন কিছু খুঁজে পায়, তাতে আবিষ্কারের বিস্ময় ও আনন্দ উপভোগ করতে পারে যে কোনো অজানা বিষয় জানতে পারাটাই সে পাঠকের জন্য আবিষ্কার।
জীবন বদলে দেয়
বইয়ের একটি তথ্য একটি শব্দ একটি বাক্য মানুষের জীবনক এতোটাই প্রভাবিত করতে পারে যে পাঠক তার এতোদিনকার লালিত জীবনের ধারাটাই বদলে ফেলে; ভ্রান্তি, ভুল বা স্থবির চিন্তা, মন্দ জীবনদর্শন এসব থেকে বেরিয়ে এসে নতুন জীবন শুরু করে দিতে পারে।
কথা বলতে শেখায়
যে কোনো আলোচনায়, সভায় নিজেকে স্বতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ করে তোলায় সবচেয়ে সহজ পন্থাটি হচ্ছে সনাতন কথার বাইরে নতুন কিছু বলা কিংবা সনাতন বিষয় নতুনভাবে উপস্থাপন করে। বইয়ের পাঠকই একাজটা সাফল্যের সাথে করতে পারে।
বিজ্ঞানমনস্ক করে
প্রযুক্তিসহায়ক পাঠ স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ইরিডার, বিভিন্ন সফটওয়ারের ব্যবহার পাঠককে আরো অনুসন্ধিৎসু, বিজ্ঞানমনস্ক এবং ই-লিটারেট করে তোলে
ইবই বার্ধক্যবান্ধব
বই পড়া বুড়ো দ্রুত তার শৈশব ও যৌবনের স্মৃতির সাথে বইয়ের পরিস্থিতির মিল খুঁজে আনন্দ ও উত্তেজনা পেতে পারেন। বইপড়া মানুষের স্মৃতিভ্রংশ হবার প্রবণতা কম থাকে। পাঠ প্রতিনিয়ত ব্রেইন ফাংশনকে রিফ্রেশ করে। ইনসমনিয়া সামলে উঠতে বই সাহায্য করে, তবে ইলেকট্রনিক বই কতোটা করে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ইলেক্ট্রনিক ফরম্যাটে কম্পিউটার, পিসি, ম্যাক, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন কিংবা যেকোনো ধরনের রিডিং ডিভাইসের স্ক্রিনই আপনার সামনে উপহার দেবে শ্রেষ্ঠ সব ধ্রুপদ গ্রন্থ কিংবা বেস্ট সেলার্স লিস্ট থেকে যেকোনো বই। প্রয়োজনীয় বইটি একবার ডাউনলোড করে নিলে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকার দরকার নেই। আপনি অফলাইন থাকতে পারেন। চাইলে প্রিন্ট বাটনে আঙুল ছুঁইয়ে ঘরের প্রিন্টার থেকে ছেপেও নিতে পারেন। অবশ্য আগামী দিনগুলো কাগজছাড়া অফিসের, পাঠাগারগুলো কাগজহীন বইয়ের।
এমনকি সুইসাইড নোট লেখার জন্যও কাগজের প্রয়োজন নেই। সামাজিক গণমাধ্যমে আত্মহত্যার বিষয়টি জানিয়ে দিন, মুহূর্তেই জেনে যাবে আপনার বিশ্ব।
পাদটীকা:
১. আপনার ই-বুকে মাংসের ঝোল লাগার সম্ভাবনা নেই; কাজেই একহাতে ইবুক নিয়ে অন্যহাতে দেদার খানাপিনা করতে পারেন।
পাদটীকা
২. যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, কুপি আর হ্যারিকেনের দিন ফিরে আসে, নিশ্চিত থাকতে পারেন যারা ছাপা-বইভক্ত তাদেরও দিন ফিরে আসবে।