নিষিদ্ধ দ্বীপ সেন্টিনেল ও তার রহস্যময় আদিম মানুষেরা
দ্রুতগতির আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগে পৃথিবীতে এমন জায়গা খুব কমই আছে যেখানে বিচরণ করেনি নগর সভ্যতার ভ্রমণ বিলাসী মানুষেরা। এর ব্যাতিক্রম বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে থাকা রহস্যময় নিষিদ্ধ দ্বীপ সেন্টিনেল।
বহুবার চেষ্টা করেও ভারতের জলসীমায় থাকা আন্দামানের এই দ্বীপটিতে কখনো প্রবেশ করতে পারেনি প্রাচুর্যে ঘেরা আধুনিক সভ্যতার কোনো মানুষ, আর যারা ভুলক্রমে প্রবেশ করেছিল দ্বীপটিতে- তাদের বরণ করে নিতে হয়েছিল নিয়তির নির্মম পরিণতি।
ভৌগোলিক অবস্থান ও কাগজে কলমে দ্বীপটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেন্টিনেল দ্বীপের ওপর ভারতের নেই আদৌ কোনো কর্তৃত্ব। অনেকবার চেষ্টা করেও দ্বীপটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেনি স্বয়ং ভারত সরকার।
এ দ্বীপের বাসিন্দারা মোটেও সহ্য করতে পারেনা তাদের ভূমিতে বাহিরের জগতের কারো আগমন। কেউ ঢোকার চেষ্টা করলেই সম্মুখীন হতে হয় সেখানকার অধিবাসীদের তীর, ধনুক, বল্লা আর পাথরের প্রতিরোধের।
রহস্যময় এই দ্বীপের অধিবাসীরা চায় না বাইরের পৃথিবীর মানুষ তাদের রহস্য ভেদ করুক, তাদের জানুক অথবা যোগাযোগ করুক তাদের সঙ্গে। তারা বাঁচতে চায় পৃথিবীর অন্য সব মানুষের চোখের আড়ালেই। বাইরের মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি ও জানার আগ্রহকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার বছর ধরে তারা বজায় রেখেছে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য। তাদের সীমানায়, তাদের জীবনে উঁকি দেওয়ার অধিকার আজও কোনা মানুষ, জাতি বা দেশ অর্জন করতে পারেনি। তাদের মাঝেও কোনা আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি অবশিষ্ট পৃথিবী বা পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে জানার।
এই পৃথিবীর অধিবাসী হয়েও দীর্ঘ সময় ধরে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকা সেন্টিনেলদের ভূমি মূলত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অংশ। সেন্টিনেল দ্বীপের আয়তন ৭২ বর্গকিলোমিটার।
নৃতাত্ত্বিকদের মতে সেন্টিনেলিরা ৬০ হাজার বছর ধরে দ্বীপটিতে বসবাস করছে। সেই হিসেবে সেন্টিনেলির অধিবাসীরাই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন একক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী।
সেন্টিনেলিরা মূলত শিকার-নির্ভর জাতি। বন্যশুকর সামুদ্রিক মাছ, প্রাণী ও দ্বীপের উদ্ভিদই তাদের নিয়মিত খাদ্য। এখন পর্যন্ত তাদের মাঝে কৃষির উদ্ভবের কোনা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারচেয়ে আজব বিষয়, আজও আগুন জ্বালাতে শেখেনি এই দ্বীপের মানুষেরা।
নৌকা বা হেলিকপ্টার থেকে বছরের পর বছর নজর রেখে এই দ্বীপের মানুষ সম্পর্কে খুব অল্পই ধারণা করতে পেরেছেন নৃবিজ্ঞানীরা। সেন্টিনেলদের মাঝে কোনো ধর্মের আবির্ভাবের লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়নি। এদের ভাষার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টিনেলি ভাষা। আন্দামানের আদিবাসী 'ওঙ্গে'দের সঙ্গে এদের ভাষার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। কিন্তু সেন্টিনেলি ভাষা তাদের সবচেয়ে কাছের আদিবাসী ওঙ্গে'দের পক্ষেও বোঝা মুশকিল।
ধারণা করা হয় সেন্টিনেলিদের পূর্বসূরিরা ৬০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে এসেছিল এই দ্বীপে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাই সম্ভবত বিশ্বের শেষ আদিবাসী আবাসস্থল; যেখানে পৌঁছাতে পারেনি আধুনিক সভ্যতা।
আধুনিক সভ্যতার মানুষ সেন্টিনেলিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে চলেছে অনেক আগে থেকেই।
আদিম এই আদিবাসীদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮০ সালে। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল ওই দ্বীপে গিয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। আদিবাসীদের এক প্রৌঢ় দম্পতি এবং চার শিশুকে তারা তুলে নিয়ে আসেন গবেষণার জন্য।
তাদের নতুন পোশাক ও খাবার দেওয়া হয়। কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়। তবে দ্বীপ থেকে আনার পরপরই মারা যায় প্রাপ্তবয়স্ক দুজন। আর বাকি বাসিন্দাদের কিছুদিন রাখার পর কোনা তথ্য না পেয়ে তাদেরকে আবার রেখে আসা হয় সেন্টিনেলি দ্বীপে।
এই ঘটনার পর আধুনিক সমাজের প্রতি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সেন্টিনেলরা। এরপর থেকে সভ্য মানুষদের প্রতি সেন্টিনেলিজদের আক্রোশ আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
এই রহস্যময় দ্বীপ ও সেখারকার আদিবাসী গোত্র সম্পর্কে সত্তরের দশক থেকে গবেষণা শুরু করেন ত্রিলোক নাথ পন্ডিত এবং তার সহকর্মীরা। ১৯৭৩ সালে সেন্টিনেল দ্বীপের আদিবাসীদের দিয়ে গবেষণা করতে দ্বীপেতে যান টিএন পন্ডিত ও তার গবেষণা দল। গবেষণার অংশ হিসাবে সেন্টিনেলিজ আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন তারা।
দ্বীপ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে পরবর্তীতে বলেছিলেন, "সেন্টিনাল আদিবাসীদের জন্য আমরা হাঁড়িপাতিল, অনেক নারকেল এবং লোহার তৈরি যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়েছিলাম। পাশেরদ্বীপের আরেকটি গোত্রের থেকে তিনজন সদস্যকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম যাতে তারা আমাদের কাছে সেন্টিনেলির লোকজনের কথার অনুবাদ আর আচরণের ব্যাখ্যা করতে পারে।"
"কিন্তু সেন্টিনেলির আদিবাসীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধভাবে আমাদের মুখোমুখি হয়, তাদের হাতে ছিল তীর ধনুক। যেন বহিরাগতদের হাত থেকে তাদের নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য তারা সবাই প্রস্তুত ছিল।"
"হাত-পা বেঁধে রাখা একটি জীবন্ত শুকর তাদের উপহার দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটিকে তারা বর্শার সাথে বেধে ফেলে এবং পরে মাটিতে পুতে রাখে।"
১৯৬৭ সালে থেকেই ভারত সরকার সেন্টিনেলিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোক নাথ পণ্ডিত ১৯৯১ সালের ৪ জানুয়ারি দ্বীপটিতে নিজে গিয়ে সেন্টিনেলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টাও সফল হয়নি। যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে দ্বীপটির তীরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপহার যেমন, খাবার, পোশাক ইত্যাদি রেখে আসা হতো। কিন্তু তাতে প্রতিরোধের মানসিকতার কোনা পরিবর্তন হয়নি দ্বীপবাসীদের। দ্বীপের কাছে কোনা নৌকা বা উপরে কোনা হেলিকপ্টার দেখলেই তারা তীর, পাথর বা বর্শা জাতীয় অস্ত্র ছুড়ে মারত। প্রতিবারই অনুপ্রবেশকারীরা তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। যাতে মৃত্যুও হয়েছে বেশ কিছু।
২০০১ সালে দ্বীপটির ব্যাপারে আবারও তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই জরিপটি প্রয়োজনের চেয়েও অনেকটা বেশি দূর থেকে পরিচালনা করা হয়। তাই অসম্পূর্ণ সেই পরিসংখ্যানে দ্বীপটিতে মাত্র ৩৯ জন বাসিন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়।
২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে সংঘটিত ভূকম্পন ও সুনামির ফলে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বীপটি।
সুনামির পর হেলিকপ্টারে সেন্টিনেলি দ্বীপে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ভারত সরকার। সে ত্রাণ গ্রহণ করার বদলে তারা আক্রমণ চালায় ত্রাণবাহী হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে।
তবে ধারণা করা হয়, কিছুদিনের মধ্যেই দ্বীপের বাসিন্দারা সুনামির ধকল কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল কারণ সুনামির পরপরই হেলিকপ্টার থেকে দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক কাজে ব্যস্ত দেখতে পাওয়া যায়। পরিশেষে তাদের আর বিরক্ত না করারই সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার।
২০০৬ সালে সেন্টিনেল তিরন্দাজরা তাদের দ্বীপে অনুপ্রবেশকারী দুজন জেলেকে তীর মেরে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। উদ্ধার অভিযানে আসা হেলিকপ্টার থেকে হেলিকপ্টারের পাখার ঘূর্ণনে সৃষ্ট প্রবল বাতাসের তোড়ে অগভীর কবরের মাটি সরে গিয়ে ওই দুজন জেলের মৃতদেহও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেন্টিনেল তিরন্দাজরা মরদেহ উদ্ধারে আসা হেলিকপ্টারটিকেও তীর মেরে হটিয়ে দেয়। পরবর্তীতে নিরাপত্তার স্বার্থে সেন্টিনেলি দ্বীপের আশপাশের তিন মাইল এলাকার মধ্যে বাইরের মানুষের প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারতীয় সরকার।
দ্বীপবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তাদের এলাকায় প্রবেশ বেআইনি জেনেও ২০১৮ সালে মার্কিন এক ধর্মযাজক সেখানে অনুপ্রবেশ করেছিলেন। মূলত খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অভিলাষে গিয়েছিলেন নিষিদ্ধ এই দ্বীপে। মার্কিন যাজকের খুব ইচ্ছে ছিল আদিম আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করবেন। সাতাশ বছর বয়সী ধর্মযাজক জন অ্যালেন চাওকে তীর ছুড়ে হত্যা করেছিল সেন্টিনেলিরা।
সেন্টিনেলদের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের মামলা করার কোনো অধিকার না থাকায় আমেরিকান ধর্মযাজকের মৃত্যুর ব্যাপারেও কোনা পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সেন্টিনেলিদের ওপর গবেষণা করছেন এমন নৃতত্ত্ববিদরা লক্ষ্য করেছেন যে, মৃতদেহ পুঁতে দেওয়ার কয়েক দিন পরে আদিবাসীরা সেই জায়গাতে ফিরে এসে কবর খুঁড়ে সেই দেহ বের করে। তারপর মৃতদেহকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে সমুদ্রের ধারে দাঁড় করিয়ে রাখে। এ ভাবেই তারা বহিরাগতদের বার্তা দেয়; তাদের দ্বীপে প্রবেশ থেকে বিরত থাকার। বার্তা দেয় তাদের নির্জনতাকে সম্মান জানানোর।
- সূত্র: বিবিসি, ফোর্বস ও উইকিপিডিয়া