শতবর্ষী হাটে দিনে বিক্রি হয় ৬ কোটি টাকার ধান
মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষেই শতবর্ষী ধানের হাট। ভোরের আলো ফুটতেই সেই হাটের পাশে এক এক করে ভিড়তে থাকে হাওরাঞ্চল থেকে আসা ধানবোঝাই সব নৌকা। এরপর বেপারি আর চালকল মালিকদের কোলাহলে ভাঙে মেঘনাপাড়ের নিস্তব্ধতা। দুপুরে হাট ভেঙে যাওয়ার পর আবারও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে মেঘনাপাড়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটের এই চিত্র শতবছরের।
দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই হাটে ধানের মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ৬ কোটি টাকার ধান বেচাকেনা হয় বলে জানিয়েছে হাট সংশ্লিষ্টরা। আর মৌসুম ছাড়া দিনগুলোতে গড়ে বিক্রি হয় ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকার ধান। এসব ধান থেকে হওয়া চাল চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সবকটি জেলা এবং ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় সরবরাহ করেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শতবছর ধরে আশুগঞ্জ উপজেলা সদরের মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটে ধানের হাট বসছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের কেনাবেচা করে এই হাটে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে ধানের বেচাকেনা। হাটের সঠিক কোনো ইতিহাস জানা না গেলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় উৎপাদিত ধান দিয়েই হাটের যাত্রা শুরু হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই হাটই তখন কৃষকদের ধান বিক্রির অন্যতম স্থান ছিল।
ধান ব্যবসায়ী জারু মিয়া বলেন, 'আশুগঞ্জের এই হাটের কথা আমার বাপ-দাদার মুখে শুনেছি। হাটটি সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১০০ বছর আগে। পৈত্রিক ব্যবসা হিসেবে আমি নিজেও ৩০-৪০ বছর ধরে ধানের ব্যবসা করছি। প্রথম দিকে জেলার সরাইল উপজেলার আজবপুর এলাকায় হাটটি স্থানান্তরের জন্য চেষ্টা করেছিলেন সেখানকার মানুষ। কিন্তু ভিওসি ঘাটটি কৃষক ও বেপারিদের জন্য সুবিধাজনক হওয়ায় হাটটি আর স্থানান্তর হয়নি। ধীরে ধীরে হাওরাঞ্চলের কৃষক-বেপারিদের কাছে এই হাট ব্যাপক পরিচিতি লাভ করতে থাকে।'
এখন কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত ধান ভিওসি ঘাটের হাটে বেচাকেনা হয়। যদিও এখন আর এই হাটে কৃষকরা ধান নিয়ে আসেন না। কারণ অধিকাংশ বেপারি কৃষকের ধান জমিতে থাকা অবস্থাতেই কিনে নেন। আর বেপারিদের কাছ থেকে এসব ধান কিনেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চালকল মালিকরা।
মূলত প্রাচীন এই হাট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩ শতাধিক চালকলে ধানের যোগান দেয়। শুধুমাত্র আশুগঞ্জ উপজেলাতেই আছে আড়াইশ চালকল। প্রাচীন হাটের কোনো ইজারা নেই। তবে শুধু ধানের ক্রেতাদের টার্নিমনাল চার্জ হিসেবে বস্তা প্রতি ৪০ পয়সা করে দিতে হয় বিআইডব্লিউটিএ'কে।
ধানের মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ মণ ধান বেচাকেনা হয়। মৌসুমে ধানের দামও তুলনামূলক কম থাকে। তখন প্রতি মণ ধান বেচাকেনা হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে। কারণ চাহিদা অনুযায়ী হাটে ধানের সরবরাহ থাকে পর্যাপ্ত। আর মৌসুম ছাড়া দিনে বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মণ ধান।
বর্তমানে হাটে প্রতি মণ বিআর বিআর ২২ জাতের ধান ১১০০ টাকা, বিআর ২৯ জাতের ধান ১৩৭০ থেকে ১৪০০ টাকা ও বিআর ৪৯ জাতের ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
অবশ্য মাস তিনেক আগে হাটে বিআর ২২ জাতের ধান বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৮০০ টাকায়, বিআর ২৯ জাতের ধান ১০৮০ থেকে ১১০০ টাকা ও বিআর ৪৯ জাতের ধানের দাম ছিল ৯০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকা। এখন ধানের দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় বেচাকেনাও কম। কারণ ধানের দাম বাড়লেও চালের দাম বাড়েনি বলে জানিয়েছেন চালকল মালিকরা।
এছাড়া ভারত থেকে বেসরকারিভাবে ১০ লাখ টন চাল আমদানির খবরে হাটের বেচাকেনা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার মণ ধান বিক্রি হচ্ছে। মাস দুয়েক ধরে হাটে এই অবস্থা চলছে।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার বেপারি ইয়াকুব মিয়া জানান, তিনি ২০ বছর ধরে কৃষকের ধান কিনে এই হাটে বিক্রি করছেন। মাস দুয়েক ধরে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ভারত থেকে চাল আমদানির খবরে চালকল মালিকরা এখন ধান কিনতে চাইছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান তিনি।
মিজান মিয়া নামে ধানের এক আড়ৎদার জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই হাটে ধান কেনাবেচা করেন। ধান বেচাকেনার জন্য বেপারি ও আড়ৎদারদের কোনো টাকা দিতে হয় না। শুধু চালকল মালিকরা বিআইডব্লিউটিএ'কে টার্মিনাল চার্জ দিয়ে থাকে।
আশুগঞ্জ উপজেলার রজনীগন্ধা অ্যাগ্রো ফুডের সত্ত্বাধিকারী হাসান ইমরান বলেন, 'আগের কেনা ধান দিয়ে এখন গুটিকয়েক চালকল সচল রাখা হয়েছে। কারণ নতুন করে ধান কিনে চাল করতে গেলে লোকসান হয়। এছাড়া ভারত থেকে চাল আমদানির খবরে ধান ও চাল দুই বাজারই থমকে আছে। আমরা ভারতীয় চালের বাজারদর পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।'
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হেলাল সিকদার বলেন, 'আশুগঞ্জ ধানের হাটটি পূর্বাঞ্চলের ধানের সবচেয়ে বড় মোকাম। মৌসুমের সময় প্রতিদিন ৬-৭ কোটি টাকার ধান বেচাকেনা হয় হাটে। হাটের কোনো ইজারা নেই। তবে আমরা যারা ধান কিনি, তাদেরকে টার্মিনাল চার্জ হিসেবে প্রতি বস্তা ধানের জন্য বিআইডব্লিউটিএ-কে ৪০ পয়সা করে দিতে হয়।'
'এখন হাটের অবস্থা ভালো না। ধানের দাম বাড়লেও চালের দাম বাড়েনি। ফলে ৮০ শতাংশ চালকল বন্ধ রাখা হয়েছে। ভারতের চাল বাজারে আসলে আমাদের চালের দাম আরও কমবে। তখন হয়তো ধানের দাম কমতে পারে। আর ধানের দাম কমলেই আমরা আবার ধান কিনে চালকল সচল করব,' উল্লেখ করেন হেলাল সিকদার।