রেমব্রাঁ: দাসত্বের সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল জগদ্বিখ্যাত এ চিত্রশিল্পীর?
নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামের রিজকসমিউজিয়াম, বরাবরের মতোই প্রদর্শনী চলছে। তবে প্রদর্শনীর নামটাই পিলে চমকে দেওয়ার মতো: 'দাসত্ব'। চিত্রকর্ম ও নথির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডের বিত্তশালী হয়ে ওঠার পেছনে ঘৃণ্য এই প্রথার সংযোগ তুলে ধরা হয়েছে প্রদর্শনীতে।
জাদুরঘরটিতে ১৯ শতক থেকেই একটি ধাতব রিং আছে, কুকুরকে পরানোর কলার হিসেবেই পরিচিত হলেও, ধারণা করা হচ্ছে দেশটিতে দাস প্রথার প্রচলনের সময় মানুষকেই পরানো হতো এটি। এই প্রদর্শনীতে এমনই আরও অনেক নিদর্শন আছে। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, প্রদর্শনীর মধ্যিখানে ঝুলছে বিখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী রেমব্রাঁর দুটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম।
রেমব্রাঁর চিত্রকর্মের সাথে দাসপ্রথার কী সম্পর্ক এমন কৌতুহল জাগাই স্বাভাবিক। ১৬৩৪ সালে মারটেন সলোমনস ও উপজেন কপিট নামে এক বিত্তশালী দম্পতির ছবি আঁকেন রেমব্রাঁ। বিত্তশালী এ দম্পতির সম্পদের উৎসেই ছিল জটিলতা। সলোমনস ছিলেন আমস্টারডামের অন্যতম বৃহৎ চিনি শোধনাগারের উত্তরাধিকারী। চিনি উৎপাদনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াই নির্ভরশীল ছিল দাসদের শ্রমের ওপর। ১৫ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত ইউরোপের চিনির চাহিদা মেটাতে জোর করে ধরে আনা আফ্রিকান দাসদের ব্যবহার করা হতো।
ডাচ রিপাবলিকের স্বর্ণযুগ বলে পরিচিত সেসময়ে আমস্টারডাম ছিল বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বন্দরনগরী। বিশ্বজুড়ে রাজত্ব ছিল ডাচ নাবিক ও বণিকদের। চিনি ও দাস ব্যবসায়- দুই ক্ষেত্রেই আধিপত্য ছিল নেদারল্যান্ডের।
রিজকসমিউজিয়াম ১৭ শতকের নেদারল্যান্ডের অর্থ-প্রতিপত্তি ও সম্পর্কিত চিত্রকর্মের নিদর্শনে পরিপূর্ণ। চিত্রকর্ম, সম্পদ ও অমানবিকতার মধ্যকার সম্পর্ক ভালোভাবেই দেখা যায় জাদুঘরটির প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীর পাশাপাশি জাদুঘরটির ৮০টি নিদর্শন চিহ্নিত করেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ যেগুলোর দাসত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্ক ছিল।
রেমব্রাঁ-কেও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে এ প্রদর্শনীর পর। ১৯৩০'র দশকের সেই বিত্তশালী দম্পতির সলোমন সুগার ফ্যাক্টরিকে 'দ্য ফায়ার অব পারগেটরি'এ ডাকা হতো। চিনি শোধনাগার পদ্ধতির জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা থেকেই এ নামের সূত্রপাত। সলোমনস মারা যাওয়ার পর কপিট ব্যবসায়ের হাল ধরেন। তিনি পরবর্তী সময়ে মারটায়েন ডায়ে নামের এক সৈনিককে বিয়ে করেন। সেই সৈনিক শুধু ডাচ উপনিবেশগুলোতে কাজই করেননি, আফ্রিকান এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে।
এই সলোমনস-কপিট দম্পতির ছবিই এঁকেছিলেন রেমব্রাঁ। সেসময় পোট্রেট আঁকা বেশ লাভজনক ছিল, অর্থের প্রয়োজনও ছিল তার। ওই একই বছরই তিনি সাসকিয়া ভান উয়লেনবার্গ-কে বিয়ে করেন। হয়তো তার গ্রাহকের অর্থের উৎস ও নৈতিক দুরবস্থার কথা চিন্তায়ই আসেনি তার। বিশ্বজুড়ে এটি যে খুব নিন্দনীয় তাও নয়, বরং একেই স্বাভাবিক বলে গণ্য করা হয়।
কিন্তু রেমব্রাঁ তো কিছুটা আলাদা ঘরানার শিল্পী। নৈতিকতার দিক দিয়ে তার সময়ের চেয়েও বেশি এগিয়ে থাকার জন্য পরিচিত তিনি। ইহুদীবিদ্বেষের সেসময়ে তার চিত্রকর্মে গভীর অনুরাগের সাথে নির্যাতিত ইহুদী জনগোষ্ঠীকে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
তবে রেমব্রাঁর ওই চিত্রকর্মে তার স্বভাবজাত দুরদৃষ্টি অনুপস্থিত ছিল। সেই দম্পতির ছবিতে তাদের শরীরে শোভা পাওয়া প্রাচুর্যের চিহ্ন ছাড়া আলাদা আর কিছুই নেই ছবিতে, নেই কোনো অভিব্যক্তিও। রেমব্রাঁ তার এই ছবির মাধ্যমে তাদের প্রাচুর্য-সর্বস্ব চিত্রই যেন ফুটিয়ে তুলেছেন।
পরবর্তী সময়ে, ১৬৬১ সালে দুজন আফ্রিকানের ছবি এঁকেছিলেন তিনি। তখনও তিনি পোট্রেট আঁকার কাজ করতেন, তবে কমিশনের কাজ আর তেমন একটা করতেন না। নিজের কাজ নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন তিনি। কিছুদিন পরই তিনি দেউলিয়া হয়ে যান, তার বাড়ি ও অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বিক্রি করে দিতে হয়।
১৬৬১ সালে রেমব্রাঁকে আমস্টারডাম টাউন হলে দেশপ্রেমের ইতিহাস ফুটিয়ে ছবি আঁকতে বলে আমস্টারডাম সিটি কাউন্সিল। তবে এর বদলে তিনি এঁকেছিলেন 'দ্য কনস্পিরেসি অব ক্লডিয়াস সিভিলস' চিত্রকর্মটি। বাতাভিয়ান বিদ্রোহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল চিত্রকর্মটিতে।
পরবর্তীতে রেমব্রাঁর আঁকা আফ্রিকানদের দুটি ছবিতে তৎকালীন সমাজে তাদের প্রকৃত চিত্র দেখা যায়। দুজন ব্যক্তি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন, শত্রুভাবাপন্ন বিরাট পৃথিবীতে দুজন বন্ধুই কঠিন সময়ে পাশাপাশি ছিলেন। তাদের চোখের ভাষাতেই রেমব্রাঁ আশ্রয়হীন শহরে একাকীত্ব ও উদ্বেগের ভাষা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাদের চোখের দুঃখবোধকে ব্যক্তিগত দুঃখবোধের বাইরে নিয়ে ঐতিহাসিক চিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রেমব্রাঁ।
রেমব্রাঁ কখনোই ব্রাজিল, বর্তমান ঘানার এলমিনা ক্যাসেল বা ডাচদের দাসত্ব স্থাপনের সাথে জড়িত কোথাও যাননি। তারপরও আফ্রিকান সেই দুই ব্যক্তির চোখের ভাষা দেখেই তিনি অনেক কিছু অনুধাবন করেছিলেন, যা ফুটিয়ে তোলেন তার চিত্রকর্মে। সমাজের শাসকদের থেকে তার মানসিক বিচ্ছিন্নতা, তার মধ্যকার মানবিকতা, বিশ্বের নিগৃহীত জনতার প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে তার নানা সময়ের চিত্রকর্মে। জাদুঘরের প্রদর্শনী এ চিত্রকর্মটি একইসাথে থাকলে এই বৈপরীত্বও প্রস্ফুটিত হতো।