বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বন্ডের ৪০০তম জন্মদিন, সুদ দিচ্ছে আজও
সে বহুকাল আগের কথা, ৪০০ বছর আগে ১৬২৪ সনের – সেদিন নেদারল্যান্ডসের লেক নদীতে জমাট বাধা বরফের চাপে ভেঙে যায় একটি বেড়িবাঁধ। নেদারল্যান্ডস সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়েও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিচে, ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। উতরেখত অঞ্চল ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়। এমনকী পানির তোড়ে রাজধানী আমস্টারডামও প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা শেষপর্যন্ত বহু কষ্টে এই বন্যাকে আটকাতে সক্ষম হন, তবে এবার তাঁদের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়– একটি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, যা বেশ ব্যয়বহুল।
তবে ডাচরা জলপ্রকৌশলবিদ্যা ছাড়াও– আর্থিকখাতের নানান ব্যবস্থারও অগ্রদূত। সেই সময়েই বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর বন্ড বাজার গড়ে তুলেছিল তারা। সে বাজারে হোগেনরাডশপ লেডভিক বোভেনড্যাম নামে পরিচিত স্থানীয় পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৫০টি বন্ড বিক্রি করে। এই বিক্রি থেকেই উঠে আসে ২৩ জাজার ক্যারোলাস গিল্ডার্স (তৎকালীন মুদ্রা)। এভাবেই বাঁধ নির্মাণের অর্থের জোগান হলো।
ওই ৫০টি বন্ডের মধ্যে একটি বিক্রি হওয়া বাকি ছিল, ১৬২৪ সনের ১০ ডিসেম্বর ১,২০০ গিল্ডার্স দামে এটি কিনে নেন আমস্টারডামের বাসিন্দা এলস্কেন ইয়োহরিসডখতার নামের এক ধনাঢ্য নারী। বন্ড ক্রয়ের সময় পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষটি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেয়– যতদিন এই বন্ড তাঁর বা তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছে থাকবে– ততদিন ধরে তাদেরকে ২.৫ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হবে। অর্থাৎ, এই বন্ডের ধরাবাধা মেয়াদ নেই।
তারপর কত যুগ কেটে গেল, পৃথিবীর খোলনলচে বদলে গেল কতো, কত সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন হলো, কিন্তু সেই বন্ডটি আজও বহাল রয়েছে। এমনকী প্রতিবছর সুদও দিচ্ছে ১৩.৬১ ইউরো। বন্ডটির বর্তমান মালিক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। গেল ১০ ডিসেম্বর বন্ডটির ৪০০ বছরপূর্তিতে তারা কয়েক বছরের জমা হওয়া ২৯৯.৪২ ব্রিটিশ পাউন্ড সুদ আদায় করেছে। ঐতিহাসিক এই ঘটনার স্মরণে ছোট্ট এক আয়োজনও করে নিউইয়র্কের পুঁজিবাজারটির কর্তৃপক্ষ, যেখানে যোগ দেন ব্রিটিশ গণমাধ্যম এফটির প্রতিবেদক।
কেন এই বন্ড এত গুরুত্বপূর্ণ? উত্তর হলো– এটি শুধু কোনো আর্থিক সরঞ্জাম নয়, নয় স্রেফ এক টুকরো কাগজ, এটি সেই ব্যবস্থারও সচল উদাহরণ – যা আধুনিক বিশ্বকে গড়ে তুলেছে। গড়েছে বাজার-ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, লেনদেন, বিনিয়োগ থেকে স্থায়ী আয়ের সুযোগকে। বন্ড বিক্রির মাধ্যমে যুদ্ধ লড়েছে ইউরোপের জাতিগুলো, বন্ডের পয়সায় তাঁরা যুদ্ধ জিতেছে, আবার বন্ডের দেনা শোধ না করতে পেরে ঋণগ্রস্তও হয়েছে। বন্ড বিক্রির অর্থেই গড়ে উঠেছিল মানসম্মত হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম। আবার বন্ডের বিনিয়োগ গেছে চিনি ও তামাকের খামার গড়তে, যেখানে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের নির্মম নির্যাতন ও শ্রমের ভারে কাতারে কাতারে মরতে হয়েছে। তাঁদের রক্ত আর ঘাম শুষেই শক্ত বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়েছে ইউরোপ, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সভ্যতা।
আমাদের বর্তমান সময়ে বন্ডের বিনিয়োগ আরও বৈচিত্রময় হয়েছে, অর্থ যাচ্ছে ডেটা সেন্টার ও কম্পিউটার চিপ নির্মাণে। বন্ডের টাকায় করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে গবেষণা। এককথায় মানবজাতির ভবিষ্যৎ গড়তেও বন্ড ব্যবস্থা আজও কার্যকর।
বৈশ্বিক দেনার বিষয়ে সুর্নিদিষ্টভাবে তথ্য নেই, যা আছে তা জোড়াতালি দেওয়া; তবু বিশ্বের মোট দেনার অন্তত অর্ধেকই বন্ডে নেওয়া বলে ধারণা করা হয়। এটা যে কতো বিশাল ব্যাপার, তা এরপর আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।
এই প্রেক্ষাপটে, ৪০০ বছর পুরোনো ডাচ এই বন্ডটিকে সেলিব্রেটি হিসেবেই মনে করেন আর্থিকখাতের বিশেষজ্ঞরা।