নগরে বসন্ত
শিল্পোন্নত যে দেশগুলো জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পৃথিবীময় অর্থ আর সবক দিয়ে বেড়াচ্ছে, তারাই কিন্তু ব্যাপক কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে পৃথিবীর জলবায়ু বদলে দিচ্ছে। নগরে বসন্ত উৎসবের ব্যাপারটিও অনেকটা এরকমই।
গাছ কেটে, পাহাড়-টিলা সাবাড় করে, জলাশয় ভরাটের মাধ্যমে পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করে দিয়ে এখানে গাওয়া হয় প্রকৃতির বন্ধনগীতি। নানাবিধ আয়োজনে বরণ করে নেওয়া হয় ঋতুরাজ বসন্তকে। ১ ফাল্গুনে নাগরিক তারুণ্য বসনে-ভূষণে বসন্তের রঙে সেজে সমস্বরে গেয়ে ওঠে- 'আহা আজি এই বসন্তে কত ফুল ফুটে, কত পাখি গায়'।
কিন্তু নগরে ফুল কোথায়? দোকানে দোকানে ফুল আছে বটে, তরুণীদের খোঁপায়ও আছে কিছু, কিন্তু বাগান কই? নগর তো পুষ্পহীন। পাখিইবা গাইছে কই? কোকিল দূরে থাক, কাক আর চড়ুই-ই তো দুর্লভ এখানে। নগরজুড়েই তো কেবল ইট আর সিমেন্ট। আকাশ ঢেকে দেওয়া একেকটা অট্টালিকা। গায়ের রং বদলে দেওয়া সোডিয়াম আলো।
ফলে কোন এক বসন্ত দিনে, সিলেটে গ্রামের খোলা হাওয়া আর অবারিত সবুজে বেড়ে ওঠা বাউল যখন গাইছেন- 'বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে, সইগো বসন্ত বাতাসে...'; তখন নাগরিক কবিকে লিখতে হচ্ছে- 'ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত'।
সিলেটকে বলা হতো, এখনো বলা হয়ও- প্রকৃতি কন্যা। অসংখ্য পাহাড়-টিলা ঘেরা এই নগরে কিছুদিন আগেও দেখা মিলতো ঘন সবুজের। নগরলাগোয়া চা বাগান, বনভূমি, নগরের মধ্যেই ছোট ছোট টিলা, অসংখ্য দিঘী, আসাম প্যাটার্নের সব একতলা বাড়ি আর গাছগাছালি সিলেটকে করেছিলো অনন্য। কিন্তু সেই দিন আর নেই। তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়ে ওঠার কথা ছিলো যে শহরের, সেটিই এখন মেগাসিটি হওয়ার দৌড়ে নেমে ছেয়ে গেছে অসংখ্য মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিংয়ে।
তবে সব শেষ হয়ে যায়নি এখনো। এখনো কোথাও কোথাও এখনও দেখা মেলে সবুজের। এখনো কোথাও ফুটে ফুল। গাছের শাখায় দোলে নবতর পাতা আর মুকুল। এই নানান রঙের ফুল-মুকুল-পাতা জানান দেয়- 'বসন্ত এসে গেছে'।
সিলেট নগরের রিকাবিবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা মিললো এমন পুত্রপুষ্পময় সড়কের। রিকাবিবাজার-মিরের ময়দান সড়কটি ২০১৭ সালে প্রশস্ত করে সিলেট সিটি করপোরেশন। এরপর সড়ক বিভাজকে কৃষ্ণচূড়া ও রাঁধাচূড়ার চারা রোপন করা হয়।
এই বসন্তে সেইসব গাছে ফুল ফুটেছে। এখানকার কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে এখন প্রেমের আগুন, আর রাঁধাচূড়ায় ঐতিহ্যের হলদে রং। লাল আর হলুদের এই মাদকতা দৃষ্টি কাড়ছে নগরবাসীর।
এই সড়ক ছাড়াও সুবিদবাজার-মদিনা মার্কেট সড়কের বিভাজকে লাগানো কৃষ্ণচূড়া-রাঁধাচূড়া গাছেও ফুটেছে রঙিন ফুল। নগরের বালুচর এলাকায় গিয়ে দেখা মিললো বসন্তের ট্রেডমার্ক হয়ে ওঠা শিমুল ফুলেরও। ফুলের উপর পাখিও বসেছে দু'একটা। দেখা মিললো মুকুলে পাতা ঢেকে যাওয়া আম গাছেরও। নগর থেকে বসন্ত এখনো ফুরিয়ে যায়নি তাহলে!
সিলেট সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, নগরের বিভিন্ন সড়ক বিভাজক, সুরমা নদীর দুই তীর, নগরের মানিকপীর টিলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফুল গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, 'আমরা নগরে পরিবেশের সুরক্ষায় সবসময় সচেষ্ট। পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন আমরা চাই না'।
তিনি বলেন, 'নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ফুলের গাছ লাগানো তার একটি অংশ। শুধু সড়ক বিভাজকে নয়, নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ও সুরমা নদীর তীরে আমরা কৃষ্ণচূড়া-রাঁধাচূড়া গাছ রোপনের উদ্যোগ করছি। এগুলো সফল হলে নগরে বসেই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন সবাই। সিলেটকে আমরা একটি পর্যটনবান্ধব সুন্দর নগর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই'।
কেবল নগরের কথাই বলা কেনো, গ্রামও কি আছে আগের মতো! 'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর' কবির এই আকুতি উপেক্ষা করে এখন আমাদের নতুন শ্লোগান- 'গ্রাম হবে শহর'।
বাউল শাহ আব্দুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালালের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। নূর জালাল নিজেও বাউল। সেদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, 'হাওরের গ্রামগুলো আর আগের মতো নেই। উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে সেখানেও এখন পৌঁছে গেছে স্যাটেলাইট সংযোগ। আগে প্রতি রাতে যেসব গ্রামে বাউল গানের আসর বসতো, সেখানে এখন বিনোদনসঙ্গী হয়ে ওঠেছে ভিনদেশী টিভি সিরিয়াল আর ইউটিউবের ওয়াজ মাহফিল'।
তবু তো নগর থেকে ভালো। বসন্তের মিহি হাওয়া, ফুল, ভ্রমর আর পাখির গানের যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা এখনো গ্রামেই পাওয়া যায়।
তাই নাগরিক শিশুদের ঋতু বৈচিত্র দেখাতে প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর গ্রামে নিয়ে যান বিমান তালুকদার নামে সিলেটের এক সংস্কৃতিকর্মী। 'মেঠোসুর' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি। এই পত্রিকার উদ্যোগেই শিশুদের নিয়ে যান প্রকৃতির কাছে। সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারি নগরের শতাধিক শিশু ও তাদের অভিভাবকদের শীতের সৌন্দর্য দেখাতে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে নিয়ে যান বিমান।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে উন্নয়ন মানেই পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস। একদিকে নদী দখল করে ফেলা হচ্ছে অপরদিকে অসংখ্য সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু নদীই যদি না থাকে সেতু দিয়ে কী হবে? আমাদের উন্নয়নগুলো এরকমই।
তিনি বলেন, 'নগরে বসে এখন আর ষড়ঋতু বোঝা যায় না। শীত, গ্রীস্ম, বর্ষা- এই তিন ঋতুই নাগরিক মানুষ উপলব্দি করতে পারে। ফলে ঋতুবৈচিত্র বুঝতে হলে গ্রামে যেতে হবে। একারণে আমরা নগরের শিশুদের ঋতুবৈচিত্র দেখাতে গ্রামে নিয়ে যাই। বসন্তের সৌন্দর্য দেখাতেও গ্রামে নিয়ে যাবো'।
প্রতিবছর সিলেটে বসন্তবরণে নগরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও এবার করোনা সংক্রমনের কারণে বড় কোনো আয়োজন হচ্ছে না বলে জানালেন সিলেট সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত। ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ থাকায়ও এবার ঘরোয়া আয়োজনেই বসন্তকে বরণ করে নেওয়া হবে বলে জানান রজত।
আর পরিবেশবাদী সংগঠন 'ভূমিসন্তান বাংলাদেশ'-এর সমন্বয়ক আশরাফুল কবীরের মতে, 'প্রকৃতি বন্ধনার উৎসবের পাশপাশি প্রকৃতির সুরক্ষায়ও আমাদের মনোযোগি হতে হবে। নতুবা পলাশ-শিমুল-কোকিল আর বসন্ত কেবল বইয়েই থাকবে। বাস্তবে এসবের দেখা মিলবে না'।