রমজান ঘিরে কৃত্রিম সংকটে উর্ধ্বমুখী ভোগ্যপণ্যের বাজার
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারে প্রায় সব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। আসন্ন রমজানকে ঘিরে পণ্যের আমদানি ও মজুদ বৃদ্ধি করেছেন আমদানিরকরা। তবে এর আগেই বেশিরভাগ ভোগ্য পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ায় রমজান ঘিরে পণ্যের বাজার আরও অস্থির হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
এমনিতে গত দেড়-দুই মাস ধরে বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য চাল ও ভোজ্যতেলের বাজার। বাড়তি এই উর্ধ্বমুখিতায় এবার যোগ হয়েছে চিনি, ডালজাতীয় পণ্য ছোলা, মসুর ও খেসারি ডালের দাম।
ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার প্রভাবে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ ভোগপণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। এতে দেশীয় বাজারেও গত দুই মাস ধরে এই পণ্যগুলোর দাম উর্ধ্বমুখী রয়েছে। রমজানকে ঘিরে আমদানিকারকরা প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ও মজুদ বৃদ্ধি করছেন। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য গুদামে চলে এসেছে। আরও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ইতোমধ্যে ঋণপত্র খোলেছেন আমদানিকারকরা, যা আগামী দুই মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাজারে পৌঁছবে।
কিন্তু বৈশ্বিক বাজারের উর্ধ্বমুখী দামের কারণে এবারে রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর বাজার চাঙা থাকতে পারে বলে মনে করছেন ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।
চিটাগাং চেম্বার অব ইন্ডস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আসন্ন রমজানকে ঘিরে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি শুরু করেছেন আমদানিকারকরা। মোট চাহিদার অর্ধেকের বেশি পণ্য ইতোমধ্যে আমদানি হয়েছে। আগামী দুই মাস আরও পণ্য আমদানি হবে। যেহেতু করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম বেশি, হয়তো তার প্রভাব কিছুটা পড়তে পারে।
তবে আমদানি বৃদ্ধির পাশাপাশি অস্থির বাজারে নিয়ন্ত্রণ আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
বাজারের চিত্র
পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত দুই সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ডাল জাতীয় পণ্য ছোলার দাম। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়ার ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২৪০০ টাকা দামে, যা দুই সপ্তাহ আগে ১৮০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণ ছোলার দাম বেড়েছে ৪০০-৬০০ টাকা।
একই সময়ে ডাল জাতীয় অপর পণ্য সাদা মটরের দাম বেড়েছে মণে ২২০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতি মণ সাদা মটর বিক্রি হয়েছে ১২০০-১২৫০ টাকার মধ্যে, যা বর্তমানে ১৪৫০-১৪৮০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
গত দুই সপ্তাহে আমদানিকৃত মোটা মসুরের দামও মণে ২২০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে আমদানিকৃত প্রতি মণ মোটা মসুর বিক্রি হচ্ছে ২৩৮০-২৩৯০ টাকা দরে, যা দুই সপ্তাহ আগে ২১৫০-২১৬০ টাকায় বিক্রি হতো।
তবে এই সময়ের মধ্যে ডাল জাতীয় পণ্যের সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খেসারি ডালের দাম। দুই সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতি মণ খেসারি বিক্রি হয়েছে ২১৫০ টাকার নিচে। মণে ৫০০-৫৬০ টাকা বেড়ে বর্তমানে একই মানের খেসারি ২৭০০-২৭২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে প্রায় দেড়-দুই মাস ধরে উর্ধ্বমুখী রয়েছে প্রয়োজনীয় পণ্য চিনির বাজার। বর্তমানে খাতুনগঞ্জে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০-২৩৭০ টাকা দরে, যা দেড়-দুই মাস আগে মাত্র ১৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে গত দুই মাসে চিনির দাম বেড়েছে মণে কমপক্ষে ৪৫০ টাকা।
তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অস্থির রয়েছে ভোজ্যতেলের দাম। গত দুই-আড়াই মাস আগে বাজারে প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হতো ৩৫০০ টাকার নিচে। তিন মাসে কয়েক দফায় ১০০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৪৫০০ টাকায়।
এই সময়ে প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম বেড়েছে মণে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি মণ পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৩৭০০ টাকা দরে, যা দুই-আড়াই মাস আগে ৩০০০ টাকার নিচে বিক্রি হতো।
একইভাবে আগে ৩২০০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি মণ পাম অয়েল ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এখন ৩৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমদানির তথ্য
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার ২০৮ মেট্রিক টন পাম অয়েল আমদানি হয়েছে। গত বছরের (২০১৯-২০) একই সময়ে পাম অয়েল আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন।
গত অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৪২ হাজার ৩৩৫ টন। এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯৩৬ টন।
গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ছোলা আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩ টন। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ছোলা আমদানি হয়েছে মাত্র ৭৭ হাজার ৫২২ টন।
এই অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ২ লাখ ৯০ হাজার ৩৮৪ টন মসুর আমদানি হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে গত বছর এই পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ লাখ ৭৯ হাজার ১১৪ টন।
গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চিনি আমদানি হয়েছিল ৫৭ হাজার ৬৯৫ টন। এবারে একই সময়ে ৬০ হাজার ৩৩১ টন চিনি আমদানি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে জানুয়ারি পর্যন্ত খেজুর আমদানি হয়েছে ৪৬ হাজার ৬৫৫ টন। তবে গত অর্থবছর একই সময়ে আমদানিকৃত খেজুরের পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ হাজার ২৮৮ টন।
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম আমদানিকারক মেসার্স আর এম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, 'গত এক-দেড় মাস ধরে রমজানের ভোগ্যপণ্য আমদানি শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বর্তমানে প্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করছেন। রমজান শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ আরও প্রায় দুই মাস পণ্য আমদানি হবে। যদিও আমদানি ও সরবরাহের ওপর এসব পণ্যের দাম নির্ভর করে, কিন্তু এরপরও এবার রমজানকেন্দ্রিক ভোগ্যপণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী থাকার আশঙ্কা বেশি।'
কারণ হিসেবে তিনি জানান, করোনার কারণে সারা বিশ্বে ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় বাজারেও।