টিকাদানে এগিয়ে থাকা দেশেও দলবদ্ধ সুরক্ষা অর্জন না হওয়ার ঝুঁকি, বাকি বিশ্বের জন্য অশনি-সংকেত
কোভিড-১৯ আসার পর প্রচলিত ভাষায় যুক্ত হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক শব্দের দৈনিক ব্যবহার। সেই সূত্রে হার্ড ইম্যিউনিটি' বা দলবদ্ধ রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতার কথা আমরা বাংলাদেশিরাও জেনেছি। এই হার্ড ইম্যিউনিটি হলো এমন এক ধরনের অবস্থা; মহামারি বা অতিমারির ক্ষেত্রে যখন দেশের একটা বড় অংশ (করোনার ক্ষেত্রে ৭০%) এই রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন এই রোগটা আর মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে না। তখন বলা যায়, গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু, শুনতে সহজ মনে হলেও, তা অর্জনের পথ ঝুঁকিপূর্ণ। এবং জীবন রক্ষার তাগিদে টিকাদান ছাড়া শুধু দলবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে ওঠার ভরসায় চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকাও যায় না। তাই টিকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দেশে শুরু হয়- তা নাগরিকদের দেওয়ার জোর উদ্যোগ। টিকাগ্রহীতা ও আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে ওঠা ব্যক্তি; দুইয়ে মিলে মহামারি প্রতিরোধের মতো গণ-সুরক্ষা কবচ তৈরি হবে, এমনটাই প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞ মহলের।
টিকাদানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলো, অন্যদের আগে হার্ড ইম্যিউনিটি' অর্জন করবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। যেমন ইসরায়েল, সুফল পাচ্ছে কোভিড টিকার পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় পরিচালনা নীতি থেকে, যার মাধ্যমে বিতরণের জটিল সমস্যাগুলোও কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে।
এসব সুবিধার কল্যাণেই বৈশ্বিক টিকাদানের সারণীতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে ইসরায়েল। মোট ৯৩ লাখ জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ ইতোমধ্যেই কার্যকর ও স্থায়ী প্রতিরোধের জন্যে নির্ধারিত দুই ডোজ নিয়েছেন। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে এমন ব্যক্তির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ মাত্র।
তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখন দেখছেন, টিকাদানের প্রথম পর্বটাই ছিল সহজ। প্রতিষধকের গুণাগুণে বিশ্বাস করেন না; অপেক্ষাকৃত তরুণেরা, সবচেয়ে বেশি সন্দেহপ্রবণ অতি-রক্ষণশীল ইহুদিরা। আর আরব বংশদ্ভূত কিছু ইসরায়েলি নাগরিকও আছেন তাদের দলে। এরা টিকা কেন্দ্রেও আসছেন না। অথচ, সকলের অংশগ্রহণ ছাড়া করোনা মহামারি প্রতিরোধে ব্যর্থ হবে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতিনিয়াহু'র টিকা নিয়ে রাজনীতিও অনেক নাগরিককে নিরুৎসাহিত করছে।
দ্বিতীয় পর্বে কত সংখ্যক ইসরায়েলি প্রতিষেধকের ইঞ্জেকশন নেন, তার ভিত্তিতে মূল্যবান শিক্ষা নিতে পারবে দলবদ্ধ প্রতিরক্ষা অর্জন প্রত্যাশী অন্যান্য দেশেসমূহ। মহামারি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হার্ড ইম্যিউনিটির জন্যে ৭০ শতাংশ নাগরিকের টিকাদান সম্পন্ন হওয়া উচিৎ অথবা আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠা দরকার। সংখ্যাটি অর্জন করা না গেলে, ব্যর্থ হবে এপর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে থাকা কোভিড প্রতিরোধের লড়াই, বাকি বিশ্বের জন্যেও যা অশনি-সংকেত।
ইসরায়েলের দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী- মাক্কাবি হেলথকেয়ার সার্ভিসের টিকাদান কর্মসূচি'র প্রধান ইদো হাদিরি বলেন, "সময়ের সাথে সাথে চাহিদা কমছে। তার মানে এই নয় যে, সবাই টিকা নিয়েছেন। আসলে এটা একটি খাড়া পাহাড়ে ওঠার মতোই কঠিন, আমরা মাঝপথে আছি। বাকি পথটুকু মনে হচ্ছে আরও বেশি দুর্গম। সত্যি বলতে কী সবাইকে টিকার আওতায় আনার এই পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ আমাদের ক্লান্তি বাড়িয়ে তুলছে।"
টিকা প্রয়োগের জাতীয় তথ্যাবলি সরবরাহ করার শর্তে কোভিডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর ফাইজার ইঙ্কের টিকার চালান পায় ইসরায়েল। গেল বছরের ডিসেম্বরে নিজে ইঞ্জেকশন নিয়ে জাতীয় টিকাদান উদ্বোধন করেন নেতিনিয়াহু।
ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে যখন টিকাদান কর্মসূচিতে ছিল বিশৃঙ্খলা, ইসরায়েল তখন বেশ সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা মাফিক তা বাস্তবায়ন করতে থাকে। মাত্র দুই মাসের মধ্যে এ কর্মসূচির কল্যাণে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে হাসপাতাল ব্যবস্থার উপর চাপ কমতে থাকে। আর তৃতীয় দফা লকডাউন থেকেও বেঁচে যায় ইসরায়েলি অর্থনীতি। প্রথম ধাপের টিকা কর্মসূচির প্রাথমিক লক্ষ্য ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৯০ শতাংশ ইসরায়েলিরা এপর্যন্ত অন্তত এক ডোজ করে ভ্যাকসিন পেয়েছেন।
সফলতার এই পরিধি আন্তর্জাতিক স্তরে ভূয়সী প্রশংসা পায়। কিন্তু, গল্পটা সেখানেই শেষ নয়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কমেছে টিকার ডোজ নেওয়ার আগ্রহ। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে, শূন্য টিকাদান কেন্দ্রের চিত্র। এখন ১৬ বছরের বেশি বয়সী সকলের জন্যে টিকাদান উন্মুক্ত হলেও, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নাগাদ দৈনিক টিকাগ্রহীতাদের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ কমেছে, জানুয়ারির সর্বোচ্চ অবস্থার তুলনায়। ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই তথ্যে অবশ্য অধিকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে প্রতিষেধক বঞ্চিত ফিলিস্তিনিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে খুব কম সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভুগতে পারেন, এমন তথ্য-প্রমাণের পরও অনেকেই টিকা নিতে ভয় পাচ্ছেন।
পেশায় কেশ-পরিচর্যাকারী ৫৮ বছরের ইসরায়েলি নারী এত্তি মেসসিকা বলেন, "টিকার কথা ভাবলে ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আমাদের সন্তানদের সবাইকে টিকা দিয়েছি, কিন্তু নিজে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভয়টা কাটছেই না। কারণ আমি মনে করি, আরও সময় নিয়ে এবং পরীক্ষা করে এটি অনুমোদন দেওয়া উচিৎ ছিল। আমার আশঙ্কা মহামারির কারণে তড়িঘড়ি করে টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।"
এই ভীতি অনেক ইসরায়েলির মনে গভীর সন্দেহের বীজ বুনেছে। টিকা কর্মসূচির রাজনীতিকরণ নিয়েও বিশ্বের দেশে দেশে অবিশ্বাস ও ভয় বাড়াচ্ছে, আস্থা কমছে সরকারি উদ্যোগের মহৎ লক্ষ্যে। উন্নত বিশ্বের মতো উচ্চ-মাত্রায় সফল ভ্যাকসিনের চালান না পাওয়ায়, উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেকে নাগরিক তাদের দেশে অনুমোদিত রাশিয়া, চীন বা ভারতে উৎপাদিত টিকায় আস্থা রাখতে পারছেন না।
আর উন্নত দেশের মূল সমস্যা; টিকা নিয়ে আগে থেকেই সংশয়বাদী জনসংখ্যা। ইসরায়েলে এখনও ২৭ লাখ ব্যক্তিকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া বাকি। এর বাইরে বয়স অত্যন্ত কম হওয়ায় অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ইসরায়েলি রয়েছে টিকাদানের উপযুক্ত নয়। আর যারা উপযুক্ত বয়স থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় টিকা নেননি, তারাও তো আছেন। তারা যদি গোঁ ধরেই থাকেন, তাহলে হার্ড ইম্যুউনিটি অর্জন পরিণত হবে সুদূর পরাহুত স্বপ্নে। অন্যান্য দেশের কপালেও থাকতে পারে একই পরিণতি। আর এমনটা হলে টিকাদানে পেছনের সারিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশেরাও মহামারির ভয়াল চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
- সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট