বাংলাদেশ থেকে এলোভেরা ও আনারস রপ্তানি করছে তাইওয়ান ফুড
নাটোরের খোলাবাড়ীয়া গ্রামের কৃষক মোস্তফা কামাল ২১ বিঘা জমিতে ভেষজ উদ্ভিদ এলোভেরার চাষ করছেন। নিজের জমিতে উৎপাদিত সব এলোভেরা তিনি ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত তাইওয়ান ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে বিক্রি করেন। তার মতো খোলাবাড়ীয়াসহ আশেপাশের গ্রামের প্রায় সব কৃষকই তাইওয়ান ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছে তাদের উৎপাদিত এলোভেরা বিক্রি করেন।
মোস্তফা কামাল তাইওয়ান ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে একজন এলোভেরা সরবরাহকারী হিসেবেও কাজ করেন। প্রতিদিন তিনি গড়ে ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন এলোভেরা তাইওয়ান ফুড কোম্পানিকে সরবরাহ করেন।
খোলাবাড়ীয়া গ্রাম থেকে তার মতো আরও তিনজন সাপ্লায়ার রয়েছেন ।
যেহেতু নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়ীয়া গ্রামে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেষজ উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়; তাই গ্রামটি ওষুধি গ্রাম হিসেবেই পরিচিত। নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, খোলাবাড়ীয়া গ্রামে বছরে ১৪ হাজার ১৪০ মেট্রিক টন এলোভেরা উৎপাদন হয়।
মোস্তফা কামাল জানান, তাইওয়ান কোম্পানি আমাদের কৃষকদের কাছ থেকে সারা বছর জুড়ে ভালো মানের এলোভেরার পাতা কেনে প্রতিকেজি ১৩ টাকা এবং তার চেয়ে একটু কম মানের এলোভেরা কেনে প্রতিকেজি ৭ টাকা হিসেবে। এক বিঘা জমিতে প্রায় ৩০ হাজার কেজি এলোভেরা উৎপাদন হয়।
তাইওয়ান ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ মেট্রিক টন এলোভেরার পাতা কিনে থাকে। প্রায় সব পাতাই কেনা হয় নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের গ্রামগুলো থেকে। এর ফলে কৃষকদের উৎপাদিত এলোভেরা বিক্রি করা সহজ হয়েছে। কোম্পানিটি নিয়মিত ক্রয় করায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছে।
কোম্পানিটি এলোভেরা পাতাগুলো কিনে নিয়ে আসে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত তাদের নিজস্ব কারখানায়, এখানে অটোমেশিনে বাইরের আবরণ তুলে; কয়েক ধাপে প্রক্রিয়াজাত করে কাঁচামাল তৈরি হয়। এরপর তাইওয়ান, জাপান, আরব আমিরাত ও ইউরোপে রপ্তানি করা হয়।
এছাড়া, বাণিজ্যিক সংস্থাটি আনারসের মৌসুমেও প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার পিস আনারস কিনে ভালুকার কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে। আনারসের বাইরের আবরণ তুলে পিস করে কেটে বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
তাইওয়ান ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ হোসেন জুয়েল- টিবিএসকে জানান, "আমাদের কারখানায় ৯০ শতাংশ অটোমেটিক মেশিনে এলোভেরা ও আনারস প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরপর তার পুরোটাই বিদেশে রপ্তানি করা হয়। আমরা শতভাগ রপ্তানি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের কারখানায় প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ মেট্রিক টন পর্যন্ত এলোভেরার চাহিদা থাকে। কিন্তু, এখন কিছুটা কম সরবরাহ হচ্ছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১৫ মেট্রিক টন এলোভেরা পাচ্ছি।"
কোম্পানিটি শেফার্ড গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। এটি সম্পূর্ণ তাইওয়ানি অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে এটি ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানত, বাংলাদেশের কৃষি পণ্য বহির্বিশ্বে পরিচিত করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
বাংলাদেশি কৃষিপণ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে সম্পূর্ণভাবে বিদেশে রপ্তানি করতে এই কোম্পানি কাজ করে শুরু থেকেই। কোম্পানিটি সম্পূর্ণভাবে শুধুমাত্র বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করতে চেয়ে কাজ শুরু করেছিল। তবে শুরুর দিকে তাইওয়ান, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাতসহ ইউরোপের কিছু দেশে রপ্তানি শুরু করলেও এখন, করোনাকালে শুধুমাত্র তাইওয়ান ও চীনে রপ্তানি করছে।
ভালুকার কারখানায় ৩০০ জন শ্রমিক কয়েকটি শিফটে কাজ করেন।
শেফার্ড গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আব্দুল মান্নান মুঠোফোনে- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা আপাতত এলোভেরা ও আনারস কয়েকধাপে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করছি। আগামিতে ধীরে ধীরে মাশরুম, ভুট্টা ও কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির ইচ্ছা আছে। এখন আমরা যে এলোভেরা ও আনারস রপ্তানি করছি- তা শুধুমাত্র আমদানিকারক দেশে খাদ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে আমরা ওষুধ, প্রসাধনীসহ বিভিন্নখাতের কাঁচামাল যাতে প্রক্রিয়াজাত করা যায়- তা নিয়েও কাজ করছি। বিশেষ করে, এলোভেরার যে ওষুধি গুণ রয়েছে- তা ব্যবহার করতেও চেষ্টা করছি। কৃষিমন্ত্রীও আমাদেরকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করছেন।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা চেষ্টা করছি, যেসব পণ্যের বাংলাদেশে বাজার নেই- সেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে। এতে করে কৃষকরা লাভবান হবেন। এর মাধ্যমে আমাদের দেশও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে।"
আব্দুল মান্নান বলেন, "এদেশে এলোভেরা হকারি পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর প্রায় বাজার তেমন নেই বললেই চলে। অথচ, আমরা ক্রয় করাতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত এলোভেরা আমাদের কাছে ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন। আমরা আনারস ক্রয় করার আগে; আনারস মৌসুমে লাখ লাখ পিস আনারস নষ্ট হতো। এখন আর তেমনটি হচ্ছে না। এখন যেমন কাঁঠাল নষ্ট হয়। অথচ, কাঁঠাল বিদেশে রপ্তানি করা গেলে- তার ভালো বাজারমূল্য পাওয়া যাবে। দেশের বাগান মালিকরাও তখন ভালো দাম পাবেন। আমাদের পরিকল্পনায় মাশরুম, ভূট্টাসহ কাঁঠালও প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করার চিন্তাভাবনা আছে।"
গার্মেন্টস সেক্টরে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করে- তারপর তা থেকে আমাদের দেশে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করা হয়। সেখান থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। কিন্তু, কৃষিপণ্য শতভাগ রপ্তানি করা যায়। কাঁচামাল আমদানির কোনো প্রয়োজন হয় না, যোগ করেন তিনি।