আগাম আনারসে পাহাড়ে চাষির মুখে হাসি
মৌসুম শুরুর বেশ আগেই বাজারে আসতে শুরু করেছে পাহাড়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক ফলন হওয়া মৌসুমী ফল আনারস। 'হানিকুইন' জাতের এই আনারস জেলার নানিয়ারচর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনারস চাষিরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নিয়ে আসছেন জেলা শহরে। বনরূপা সমতাঘাটে প্রতীক্ষায় থাকা পাইকারদের হাত হয়ে এই আনারস ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।
সাধারণত জুন-জুলাই মাসেই ব্যাপকভাবে উৎপাদন হতে শুরু হয় আনারস।
চাষিরা জানাচ্ছেন, এখনো মৌসুম শুরু না হলেও পাহাড়ে বিগত কয়েক বছর ধরে আগাম ফলন আসা আনারস চাষ হচ্ছে। এতে মৌসুমে উৎপাদিত আনারসের থেকে আগাম আনারসে বাড়তি লাভবান করতে পারেন তারা। কিন্তু মৌসুমে অনেক কৃষককেই আনারস চাষ করে লোকসানে পড়তে হয়।
এদিকে পাইকাররা বলছেন, করোনাকালে লেবু জাতীয় ফলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আগাম আনারসের ভালো চাহিদা থাকবে।
নানিয়ারচর উপজেলার হাতিমারা এলাকায় ২০ হাজার আনারসের চারা সৃজন করেছেন সজীব চাকমা। গত বুধবার সাপ্তাহিক হাটে ৩ হাজার আনারস এনেছেন বিক্রয়ের জন্য। তিনি প্রতিটি আনারস বিক্রি করেছেন ৯ টাকা দরে। 'যেহেতু মৌসুমে আমরা ভালো দাম পাই না, তাই এখন আগাম চাষ করি,' বলেন তিনি।
সদর উপজেলার সাপছড়ি এলাকার আনারস বাগানি রমেশ চাকমা বলেন, 'এ বছর ৯ হাজার আনারস চাষ করেছি। সাপ্তাহিক হাটবারে বাজারে ৭-৯ টাকা দরে মাঝারি ও বড় আকারের আনারস বিক্রি হচ্ছে।'
নানিয়ারচর উপজেলার মরাচেঙ্গী এলাকার চাষি রত্মবিকাশ চাকমা বলেন, 'আগাম মৌসুমে বাড়তি দাম পেতে ৩ হাজার আনারস এনেছি। কুয়াশার কারণে দাম এখন কিছুটা কমে গেছে। যে আনারস আমরা আগাম হিসেবে প্রতি পিস ২০-২৫ টাকায় বিক্রয় করতে পারতাম, সেগুলো এখন ৮-৯ টাকার বিক্রয় করতে হচ্ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পাইকাররা যে দাম বলছেন, সেই দামে বিক্রয় করলে খরচ বাদ দিলে তেমন লাভবান হচ্ছি না আমরা।'
সদর উপজেলার বন্দুকভাঙা এলাকার চাষি প্রতুল চাকমা বলেন, '৪ হাজার আনারস এনে প্রতি পিস ৭ দরে বিক্রয় করেছি। ভেবেছি আজ ১০ টাকা দরে বিক্রয় করব। এমন হলে খরচের টাকা বাদ দিলে তেমন লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই।'
পাইকারি মৌসুমী ফল ব্যবসায়ী আরমান আলী জানান, আগাম আনারস হওয়ায় মৌসুমের চেয়ে এখন দাম বেশি। 'মৌসুমে প্রতি পিস ৪-৫ টাকা কিনলেও এখন কিনতে হচ্ছে ৮-৯ টাকা দরে। আমরা এগুলো ১২-১৩ টাকা দরে বিক্রি করি,' বলেন তিনি।
মৌসুমী ফল পরিবহনে জড়িত শ্রমিক রহমান বলেন, 'এখানে চাষিদের আনা আনারসগুলো পাইকাররা কিনে নেওয়ার পর সেগুলো আলাদা নৌকায় নিয়ে ট্রাকে উঠানোর কাজ করি। এরপর ট্রাকে ভরে আনারসগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো মৌসুম আসেনি, তবু বেশ ভালোই আগাম আনারস আসছে বাজারে।'
এদিকে বুধবার সকালে রাঙামাটির বনরূপা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয়ভাবে খুচরা বাজারে প্রতি জোড়া মাঝারি আকারের আনারস বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে। বড় আকারের আনারস বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা জোড়া।
চাষিদের কাছ থেকে কিনে অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে আনারসসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফল বিক্রি করেন বলে জানালেন স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী অনন্ত চাকমা। তিনি বলেন, 'বাজারে এলাম আনারসের দর দেখতে। আগাম আনারস হওয়ায় আশা করছি ব্যবসায়ে ভালো সাড়া পাব।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি অঞ্চল সূত্রে জানা যায়, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য জেলায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ হাজার ৬৪৭ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৮ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৯২৪ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৭ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৬৯ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৮১ হাজার ৯৯ টন আনারস উৎপাদন হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি কার্যালয়ের উপপরিচালক কৃষ্ণ প্রসাদ মল্লিক জানিয়েছেন, রাঙামাটির দশ উপজেলাতে কম-বেশি আনারস চাষ হলেও নানিয়ারচর ও রাঙামাটি সদর বেশি চাষ হয়ে থাকে। গত মৌসুমে রাঙামাটির দশ উপজেলায় ২১৩০ হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার ৮৫০ টন আনারস উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে নানিয়ারচরে ১০৭০ ও সদর উপজেলায় ৫৭০ হেক্টর। চলতি বছর চাষের জমি আরও বাড়বে। এখন পর্যন্ত কৃষি বিভাগের হিসেবে ৭৩০ হেক্টর জমিতে আগাম আনারস চাষ হয়েছে।
মৌসুমের শেষ দিকে মোট কত হেক্টর জমিতে চাষ হলো, সেটি নির্ধারণ করা যাবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, 'আগাম আনারস চাষ হওয়ায় কৃষকরা ভালো লাভবান হচ্ছেন। পাইকারদের কাছে তারা এখন ৭-৮ টাকা দরে আনারস বিক্রি করছেন। পাইকাররা বাইরে নিয়ে সেই আনারস ২০-২২ টাকা দরে বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে।'
'এখানকার আনারস এখন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। এতে করে চাষিরা আনারস চাষে ঝুঁকছেন,' বলে জানান তিনি।
কৃষ্ণ প্রসাদ মল্লিক আরও জানান, আগাম আনারস ফলানোর জন্য ইথ্রেল হরমোন ব্যবহার করা হয়। হরমোন প্রয়োগে প্রায় শতভাগ গাছে একসঙ্গে ফুল আসে। চারার বয়স নয় মাস হলে বা চারার ২২টি পাতা গজালে হরমোন প্রয়োগ করে আধা কেজি ওজনের ফল পাওয়া যায়। আবার চারার ১৩ মাস বয়সে ২৮টি পাতা গজালে হরমোন প্রয়োগ করে এক কেজি ওজনের ফল পাওয়া যায়।
'শীতকালে প্রতি একরে আড়াই হাজার গাছে আনারস ফলিয়ে এক লাখ টাকা আয় করা সম্ভব,' বলেন তিনি।
হরমোন প্রয়োগে স্বাস্থ্যের কোনো ঝুঁকি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'হরমোনের কাজ হচ্ছে ফুল ফোটানো। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, পাকা ফলে হরমোনের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব থাকে না।'