ঢাকায় ফুলকপি ২৫ টাকা, মাঠে ৫ টাকাও পাচ্ছেন না কৃষকরা
ঢাকার বাজারে ক্রেতাকে একটি ফুলকপি কিনতে হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা দিয়ে। অথচ এই একই ফুলকপি মাঠ পর্যায়ে ৫ টাকাও বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা।
এতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। কিছু কিছু এলকায় ফুলকপি বিক্রি করতে না পেরে গরুকে খাওয়াচ্ছেন কৃষক।
মানিগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ফুকুরহাটি ইউনিয়েনের আইরমারা গ্রামের কৃষক বশির আহমেদ গত বছর ১২ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করে লাভবান হন। তাই তিনি এবার ২০ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেন। তবে বর্তমানে দাম কমে যাওয়ায় খরচ ওঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
বর্তমানে সাটুরিয়ায় ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা কেজিতে। গত কয়েকবছরে ফুলকপিতে লাভ বেশি হওয়ায় এবার বেড়েছে আবাদ। এতেই কপাল পুড়েছে সব কৃষকের। লাভ তো দূরের কথা, আবাদ বেশি হওয়ায় প্রতি বিঘা জমিতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো।
কৃষক বশির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "ফুলকপির দাম একেবারে কম। ভালো মানের ফুলকপি ৫ টাকা প্রতিপিস বিক্রি করছি। একবিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি করেছি ২০,০০০ টাকা। অথচ জমি তৈরি, সার, বীজ, শ্রমিক খরচ— সব মিলে ৫০,০০০ টাকা খরচ হয়েছে। আসলে আমাদের বাজার ব্যবস্থা ঠিক নেই। আমরা ভালোভাবে ফসল ফলালেও আমাদের চিন্তা; মাঠ ভরা ফসল বিক্রি করবো কীভাবে?"
আরেক কৃষক বলেন, "সাভার থেকে এক বিঘা জমির ফুলকপি ঢাকার বাজারে ৩টি ট্রাক ভরে নিয়েছি। বিক্রি করেছি ৩০,০০০ থেকে ৩৫,০০০ টাকা। আমার ২০,০০০ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।"
শুধু বশির নন বগুড়ায়, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকের একই অবস্থা। তারা বলছেন, ভালো মানে ফুলকপি ৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে; অথচ উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি পড়ছে ১৫ টাকা করে। আবার কিছুটা ছোট আকারের ফুলকপির প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪ টাকায়।
এদিকে, রাজধানীর কল্যাণপুর, শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এসব বাজারে ভালোমানের একটি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা করে।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. মোশেদ আল মাহমুদ বলেন, "ফুলকপির দাম কমে গেছে। কৃষক যেন ভাল দাম পান, এরজন্য আমরা কাজ করছি। যেখানে চাহিদা বেশি, সেখানে যেন পণ্য বিক্রি করতে পারে সেই খোঁজ আমরা দিচ্ছি। আমরা বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কাজ করছি। কৃষকদের পণ্য বিপণন ও কোন সময় পণ্যের চাহিদা বেশি সেটা আমরা জানিয়ে দিচ্ছি।"
সাটুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, "বাজারে বিভিন্ন ধরনের শীতের সবজি চলে এসেছে, তাই এখন কৃষক দাম কম পাচ্ছেন। আবার এখন যারা এ সবজি চাষ করছেন, তারা আগামি মাসে (ফেব্রুয়ারি) ভালো দাম পাবেন; তখন প্রতিকেজি ৬০-৭০ টাকা বিক্রি হবে ফুলকপি।"
"কখন কোন সবজি করলে আগাম বাজার ধরতে পারবেন, দাম ভালো পাবেন, ফলন বেশি পাবেন— এটা আমরা কৃষকদের জানাচ্ছি। কৃষক কীভাবে উৎপাদন খরচ কমাবেন, সেটাও আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি," যোগ করেন তিনি।
কৃষি পলিসি নিয়ে কাজ করছেন ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের রিসার্চ ফেলো ফারহানা নার্গিস। টিবিএসকে তিনি বলেন, "বাজার মনিটরিং বিষয় সঠিকভাবে করতে হবে। মাঝপথে অনেক চ্যানেল আছে সেটা যতটা কমিয়ে আনা যায়, তত ভালো। সেইসঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কৃষক যেন ন্যায্য মূল্য পান।"
"না হলে তারা ফসল ফলাতে উৎসাহী হবেন না। আর এরজন্য প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনায় সঠিক পদক্ষেপ; চাহিদা ও উৎপাদনের ভারসাম্য রাখা," বলেন তিনি।
অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজের দাম ৫ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি দেশি নতুন (মুড়িকাটা) পেঁয়াজ ৫৫–৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর এর পর থেকে সোনালি মুরগির দাম কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বেড়ে ৩৩০-৩৫০ টাকা হয়। এখনও এই দামেই বিক্রি হচ্ছে। আর ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ২০০-২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে রাজধানীর গোলির মুদি দোকানে এক লিটার ও দুই লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এর সংকট দেখা গেছে। বোতলের গায়ে লেখা দামের চেয়ে লিটারে ১০ টাকা বেশিতে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
গলির প্রায় ১০টি দোকানে কথা বলে জানা গেছে, ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো এখনো বাজারে চাহিদা মতো বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না।
কল্যাণপুরের মাহিন স্টোরেরর বিক্রিয় কর্মী বলেন, "এক লিটার, দুই লিটার তেল তো পাচ্ছিই না। বিক্রি কীভাবে করবো।"
এই দোকানের পাশেই কল্যাণপুর বিআরটিসি মার্কেট, সেখানকার মুদি দোকান বিক্রেতা মোহম্মদ শামীম বলেন, "আমাদের দোকানে এক সপ্তাহ ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। দাম বাড়ানের পর কোম্পানি কিছু তেল সরবরাহ করেছিল। এখন আবার তারা দিচ্ছে না।"
কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছের একটি মুদি দোকান থেকে মোহম্মদ বেলাল ২ লিটার বোতলজাত তেল কিনেছেন ৩৭০ টাকায়, অথচ বোতলের গায়ে মূল্য লেখা ৩৫০ টাকা।
তিনি বলেন, "দোকানদার বলেছেন, কিনলে কেনেন, না কিনলে না কেনেন, এই দামই দিতে হবে। আমরা গায়ে লেখা দামে কিনে আনি আমাদের লাভ তো করতে হবে।"
এদিকে ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের বিক্রয় সহকারী আলী হোসেন বলেন, "আমাদের গায়ে লেখা দামের চেয়ে ২ টাকা কমে তেল কিনতে হয়। আমাদের বোতল সয়াবিন বিক্রি করে এখন লাভ নেই।"
তবে কারওয়ান বাজারের প্রতি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল ছিল। সেটা সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে দেখা যায়।
এর আগে, গত ৯ ডিসেম্বর লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করে সরকার– যা আগে ছিল ১৬৭ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়।