চট্টগ্রামের এক উদ্যোক্তার স্বাবলম্বী হওয়ার যাত্রা
পারিবারিক টানাপড়েনে ২০২০ সালের শুরুর দিকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন শিরীন আক্তার। স্বামীর সঙ্গে সেপারেশনের পর দুই সন্তান নিয়ে কীভাবে পথ চলবেন, এই চিন্তায় ছিলেন দিশেহারা। এর মধ্যে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
এমন বিপর্যয় মুহূর্তে চট্টগ্রামের এই নারী শুরু করেন হোম মেইড ফুড বিজনেস। ২০২০ সালের ১১ মার্চ 'ক্যাফে স্পাইস' নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন তিনি। ১৩ মার্চ ১ হাজার টাকার চিকেন রোল ও চিকেন সমুচার অর্ডার পান। রান্না ঘরে থাকা সরঞ্জাম দিয়েই তিনি সেই অর্ডার ডেলিভারি দেন।
এক বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার উদ্যোক্তা শিরিন আক্তারের হোম মেইড ফুড ব্যবসার প্রসার ঘটেছে বহুগুণ।
হোম মেইড ফুড এবং ফরিদপুরের খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি পিঠা বিক্রি করে শিরিন আক্তার বিপর্যয় কাটিয়ে হয়েছেন স্বাবলম্বী। প্রতি মাসে এখন তার গড় বিক্রি প্রায় এক লাখ টাকা। বিভিন্ন মেলায় অংশ নিলে বিক্রি বাড়ে কয়েক গুণ। বর্তমানে তার ব্যবসায় নিয়মিত কাজ করেন ৫ জন শ্রমিক। মেলার স্টলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫। শিরিন স্বপ্ন দেখছেন একটি রেস্টুরেন্ট দেওয়ার।
ক্যাফে স্পাইসের স্বত্বাধিকারী শিরিন আক্তার বলেন, 'অনলাইন বিজনেস শুরু করতে আমাকে সাহস জুগিয়েছেন নারী উদ্যোক্তা এসএফ বুটিকসের স্বত্বাধিকারী সৈয়দা ফারজানা হারুন। রান্নায় পূর্বের অভিজ্ঞতা এবং ইউটিউবে নিয়মিত রান্নার রেসিপি দেখে শিখে নিজের রান্নাঘরকেই বানিয়েছি উপার্জনের অবলম্বন। নিজ এলাকা ফরিদপুর থেকে খেজুরের গুড় সংগ্রহ করে তৈরি করি বিভিন্ন রকমের পিঠা। হালিশহর ও আগ্রাবাদ, পাঁশলাইশ, মেহেদীবাগ এলাকার বেশ কয়েকটি ব্যাংক, কারপোরেট প্রতিষ্ঠান আমার নিয়মিত গ্রাহকে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফুড ও পিঠা কিনতে আসেন ক্রেতারা।'
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এফ কমার্স ভিত্তিক অনলাইন গ্রুপ ইজি শপিং সিটিজি আয়োজিত পণ্য প্রদর্শনীতে অংশ নেয় শিরিন আক্তারের ক্যাফে স্পাইস। গত ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামে কথা হয় শিরিনের সঙ্গে। সেখানে কর্মীদের সঙ্গে তিনি নিজেও তৈরি করছেন বিভিন্ন রকমের পিঠা। স্টলে বিক্রি হচ্ছিল দুধ চিতই, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা, কুশলি, নারিকেল পুলি, মুগ পাকন, নকশি পিঠা, সেওই পিঠা, খাজা, গজা, নিমকি, চমুচা, চিকেন রোল-সহ মুখরোচক বিভিন্ন খাবার।
শিরিন আক্তার বলেন, 'অনলাইন ব্যবসা আমাকে নতুন করে পথ চলতে শিখিয়েছে। শুধু মুনাফা নয়, গ্রাহক সন্তুষ্টি ও পণ্যের ব্রান্ডিংকেই আমি গুরুত্ব দিয়েছি বেশি। কোনো মূলধন ছাড়াই শুরু করা এই ব্যবসার আয় দিয়েই চলছে আমার দুই সন্তানের পড়ালেখাসহ সব খরচ।'
তিনি আরও বলেন, 'নিজস্ব ডেলিভারি সার্ভিস চালু করা গেলে পুরো চট্টগ্রাম শহরে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো যেত। ব্যবসার এই ধারাবাহিকতা থাকলে একদিন এই প্রত্যাশাও পূরণ হবে।'
'ব্যবসার শুরু থেকে আমার ভাই ইকরাম হোসেন তুহিন আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করছে। আমার এসএসসি-৯৮ ব্যাচের বন্ধুরাও সাহস যুগিয়েছে। এজন্য সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ,' বলেন তিনি।
এস এফ বুটিকসের স্বত্বাধিকারী সৈয়দা ফারজানা হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সিঙ্গেল মাদার হিসেবে ভীষণ হতাশাগ্রস্ত ছিলেন শিরিন আক্তার। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, তিনি যা করতে পছন্দ করেন, সেটি নিয়েই যেন অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। অনলাইন বিজনেস নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা প্রতিনিয়ত তার সঙ্গে শেয়ার করি। মানসিকভাবে যেন তিনি ভেঙে না পড়েন, সেই সাহস যুগিয়েছি।'
'দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অনেকেই টিকে থাকার সংগ্রাম করেন। শিরিন আক্তার সেই সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। তার এই সাফল্য নিঃসন্দেহে হতাশায় ভোগা অন্য নারীদের অনুপ্রেরণা যোগাবে,' বলেন ফারজানা।