সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেন প্রয়োজন? উত্তর সবার জানা
১৭৭৬ সালে সুইডেনের পার্লামেন্ট বিশ্বে প্রথমবারের মতো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং তথ্য অধিকার বিষয়ক আইন প্রণয়ন করে; বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল- গণমাধ্যম এমন এক মাধ্যম, যা ব্যবহারের মাধ্যমে জনসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে তাদের স্বাধীনতার চর্চা করে।
এটা ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে নতুন ভোর। এ আইনের মূল সাফল্য ছিল রাজনৈতিক সেন্সরশিপের বিলুপ্তি ও সরকারি নথিপত্রে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
এখন দেখা যাক, এ আইনের ফলে সুইডেনে এর কী প্রভাব পড়েছিল।
দুর্নীতির ধারণা সূচকে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা আইনের শাসন সূচকে—অর্থাৎ বৈশ্বিক সুচকগুলোয় সুইডেনের অবস্থান আজ প্রথম সারিতে। ১৭৭৬ সালে প্রণীত ওই আইনকে বর্তমান সুইডেনের উজ্জ্বল চিত্র এবং অন্যান্য সাফল্যের জন্মদাত্রী বললে একদম ভুল হবে না। যার কল্যাণে সুইডেন এখন বিশ্বে বসবাসের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গাগুলোর একটি।
সুইডেনকে অনুসরণ করে ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রও সুইডেনের পথেই হাঁটে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর দৃঢ় ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করে। সেখানে বলা হয়: কংগ্রেস এমন কোনো আইন প্রণয়ন করবে না, যা সংবাদমাধ্যম বা বাক-স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে।
এর ফল কী দাঁড়ায়? পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিকে পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীতেই দেশটি অন্যদের টপকে শীর্ষে চলে আসে। আজপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে তার এ অবস্থান থেকে টলানো সম্ভব হয়নি।
বিগত দুই শতাব্দী ধরে এই প্রথম সংশোধনী যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্টের যে কোনো ব্যক্তি সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের যেকোনো নীতির বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন। এমনকি, বিদ্যমান নীতিমালা এবং বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়েও যেকোনো উদ্ভাবনী ধ্যানধারণার কথা জানাতে পারেন স্বাধীনভাবে।
এই সময়ের উদাহরণ দিলে, অস্ট্রেলিয়ার কথা বলা যায়: অস্ট্রেলিয়ার আইনসভা মুদ্রণ এবং ইলেকট্রনিক সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতাদের সামনে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশটি গুগল এবং ফেসবুকের মতো প্রযুক্তিখাতের রাঘববোয়ালদের বাধ্য করেছে স্থানীয় মিডিয়া হাউজ এবং প্রকাশকদের প্রাপ্য অর্থ শোধ করতে। ফেসবুক এবং গুগলের নিউজ ফিড কিংবা সার্চ রেজাল্টে সংবাদের লিংক প্রকাশ করলেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ প্রদানে বাধ্য এখন ফেসবুক কিংবা গুগুল।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়ার এ আইনটিকে বিশাল এক বিজয় ধরা যেতে পারে। কেননা, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের টিকে থাকার পূর্বশর্ত হল অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা।
এসম্বন্ধে বলতে গিয়ে যৌথ এক বিবৃতিতে দেশটির যোগাযোগমন্ত্রী পল ফ্লেচার এবং ট্রেজারার জশ ফ্রাইডেনবার্গ বলেন, "সংবাদ মাধ্যমগুলোর নিজেদের বানানো কনটেন্টের ব্যবহারে ন্যায়সঙ্গত ভাবে ব্যবসা নিশ্চিত করবে নতুন এই বিধিমালা। সেইসাথে, অস্ট্রেলিয়ায় জনস্বার্থে পরিচালিত সাংবাদিকতাকেও টিকে থাকতে সাহায্য করবে এ আইন।'
সংবাদ মাধ্যমগুলোকে রক্ষা করতে অন্যান্য দেশও অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করতে পারে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশের আইনসভা প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত কয়েকটি ধারার কারণে, দেশ এখন বৈশ্বিক মানদণ্ড এবং উৎকৃষ্ট চর্চার একেবারে বিপরীতে অবস্থান করছে। সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীদের মতে, ধারাগুলো দেশের গণমাধ্যম এবং বাক-স্বাধীনতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
মানুষ এখন সরকারি নীতিমালা এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের সমালোচনা করতে ভয় পায়। অনলাইনের লেখা কিংবা পোস্টের কারণে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা তাদের পক্ষে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি সংক্ষুদ্ধ বোধ করলে ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি "দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ' করার দায়ও চাপতে পারে তার ওপর।
জেলখানায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু আইনের নির্মম প্রয়োগের আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। বিতর্কিত আইনের আওতায় নয় মাস আগে তাকে আটক করা হয়েছিল। এমনকি, একাধিকবার জামিন আবেদন করা হলেও- তা নাকচ করা হয়।
সম্প্রতি, বিভিন্ন ধারার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনটির পরিবর্তনের দাবিতে আওয়াজ উঠেছে।
মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতার সংকোচনে আইনের প্রভাব বিস্তৃত। ক্ষমতাধর মানুষেরা ক্ষমতার জোরে তাদের অপরাধ থেকেও নিষ্কৃতি পান। তাদের আইনের আওতায় না আনায় মূল ভুক্তভোগী হয় শাসন ব্যবস্থা। সেইসাথে, অর্থনীতির জীবনীশক্তিও নিঃশেষিত হয়। অবাধ দুর্নীতির প্রশ্রয়ে বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল অর্থনীতি এখন ভুগছে। মানুষ সু-শিক্ষা, সু-চিকিৎসা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দুর্নীতির ধারণা সূচক, আইনের শাসন কিংবা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকের মতো- বৈশ্বিক সূচকে দেশগুলোর অবস্থান শোচনীয় পর্যায়ে। বছরের পর বছর উন্নয়নশীল এ দেশগুলো সূচকের নিচের দিকেই অবস্থান করে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০০৮ সালে প্রকাশিত ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদনের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। "প্রেস ফ্রিডম অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট" শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে দারিদ্র্য, সুশাসন এবং শান্তির মতো উন্নয়নের বহুমুখী মাত্রার সাথে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছিল।
প্রতিবেদনটিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, "সুনির্দিষ্টভাবে, মানব উন্নয়নের বিভিন্ন মাত্রা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যের সাথে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ইতিবাচকভাবে সম্পর্কিত। সু-শাসনের অন্যান্য নির্দেশকের সাথে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা; টেকসই উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি করে।" কোনো দেশের গণমাধ্যমের প্রতিবন্ধকতা যত কম হবে, সেই দেশ ততো বেশি উন্নত হবে। একইভাবে প্রতিবেদনটির তথ্যানুযায়ী, গণমাধ্যমের কন্ঠ যতো রোধ করা হবে, দেশের দুরবস্থাও ততো বৃদ্ধি পাবে।
ইতিহাসও ইউনেস্কোর বিশ্লেষণের স্বপক্ষেই কথা বলে। সুইডেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকেই উদাহরণ হিসেবে ধরুন। এমনকি, উন্নত অর্থনীতির অন্য রাষ্ট্রগুলোয় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কৃত বিশ্লেষণও এই তথ্যকে সমর্থন করে।
একটি বিষয় নির্দিষ্ট করে বলা দরকার। উন্নয়নশীল বহু দেশেই ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ জনসম্মুখে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে গীত গান। কিন্তু, তাদের কার্যক্রমে প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের কন্ঠ রোধ হয়। অপকর্মের কথা প্রকাশিত হলে, এই ব্যক্তিরা গণমাধ্যমের উপর তাদের ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করেন। এমনকি, গণমাধ্যমে নিজেদের "সৎ কর্মের" চিত্র তুলে ধরতে এই ব্যক্তিরা বহু চাটুকারের ব্যবস্থাও করে ফেলেন।
পরিশেষে, বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের একটি প্রাসঙ্গিক বক্তব্যের উল্লেখ করা যায়। দুই শতাধিক বছর আগে তিনি বলেছিলেন, "সমাজের সকল সদস্যের মত-প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে, মুক্ত এবং স্বাধীন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যতার সমন্বয়ে আলোকিত ও উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়।''
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: Why the press needs freedom? The answer is blowing in the wind
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা