আমদানিতে গতি না থাকায় খাদ্য মজুদ তলানিতে, চাপে সরকার
- বোরো ও আমনে সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় খুবই সামান্য
-
সরকারের আমদানিতে গতি না থাকায় মজুদ তলানিতে
-
সরকারের মজুদ ঘাটতির সুযোগে বাজারে চালের দাম বেশি
-
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে খাদ্যশস্যের বিরতণ নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে
-
দ্রুত আমদানি শেষ করতে না পারলে মানুষ আতংকিত হবে- দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী
আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রমে ব্যর্থ হয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।বেসরকারিভাবে আমদানিতে গতি থাকলেও সরকার দ্রুত চাল আমদানি করতে পারছে না। ফলে তলানিতে থাকা খাদ্যের সরকারি মজুদ বাড়াতে চাপে পড়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন বাজারে চালের দাম কমছে না, অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে খাদ্যশস্য বিতরণ কর্মসূচি চলমান রাখা নিয়েও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সদ্য সমাপ্ত আমন সংগ্রহ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দুই লাখ টন আমন ধান, ছয় লাখ টন আমন সিদ্ধ চাল ও পঞ্চাশ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মৌসুম শেষে দেখা গেছে, সরকার ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার ৪.১৫ শতাংশ, চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার ৮.৮৬ শতাংশ অর্জন করেছে মাত্র।
এ সময় সরকারের মজুদ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নেমে আসে। এর প্রভাবে বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭.৩১ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে মোটা চাল, ১৪.১৩ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে মাঝারি চিকন ও প্রায় ৯ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে চিকন চাল কিনতে হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত ১০.৩৯ লাখ টন চাল ও ৩.০১ লাখ টন গম বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৮.২৬ লাখ টন চাল এবং ২.৮৯ লাখ টন গম বিতরণ করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমনের ভরা মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ কার্যক্রমে ব্যর্থ হওয়ায় মজুদ নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল আমদানি শুরু করেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। চাল আমদানিতে দীর্ঘসূত্রীতার কারণে সরকারের হাতে যথেষ্ট মজুদ তৈরি হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, গত মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত সরকারের কাছে ৬.৪৭ লাখ মে টন খাদ্যশস্য রয়েছে, যার মধ্যে ৫.৩৮ লাখ টন চাল ও ১.০১ লাখ টন গম রয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, 'খাদ্যশস্যের মজুদের ঘাটতি নিয়ে কয়েক মাস ধরেই সরকার চাপে রয়েছে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরাও চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অবস্থা কাটাতে দ্রুত সরকারের মজুদ বাড়ানো দরকার।'
তিনি বলেন, 'সরকারের কাছে সবসময় অন্তত ১০-১২ লাখ টন খাদ্যশস্যের মজুদ রাখতে হবে। তাহলে যে কোন সময় যে কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।'
এই অবস্থায় করণীয় ঠিক করতে সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) একটি মিটিং করে। এতে অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা অংশ নেন।
এই সভায় কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, মন্ত্রীরা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত চালের আমদানি শেষ করার তাগিদ দেন। কারণ মে-জুন মাসে বোরো ধান উঠবে। আমদানির প্রভাবে যাতে সে সময় কৃষক ধানের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়।
সভায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, 'ফসল কাটার সময় শিপমেন্ট হলে উৎপাদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে'।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'আসন্ন বোরো সংগ্রহ মৌসুমে বাজারদর পর্যবেক্ষণ করে ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা জরুরী। একই সঙ্গে বোরো মৌসুমের ধান উঠার আগেই চাল আমদানি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে'।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, 'ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে আসন্ন বিতরণ চাহিদাকে বিবেচনা করে দ্রুত আমদানি শেষ করতে না পারলে মানুষ আতংকিত হবে'।
এ সময় সরকারের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ার ব্যখ্যা দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, '৫ দফা বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে আমনের ফলন কম হয়েছে। ফলে মৌসুমের শুরু থেকেই ধান ও চালের মূল্য বাজার দরের তুলনায় বেশি ছিল। বাজারেই বেশি দাম পেয়ে কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করেনি'।
একইভাবে সরকারের ঘোষিত দামে লোকসানের অজুহাত তুলে মিলাররা সরকারকে চাল দেয়নি বলে জানান খাদ্যমন্ত্রী।
তবে কিছু সংখ্যক মিলার মাত্র ১.৪৩ লাখ টন চাল সরবরাহের জন্য চুক্তি করেছিল বলে জানা গেছে।
আগামী বোরো মৌসুমে ১০-১৫ লাখ টন ধান সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কেনায় নীতিগত সিদ্ধান্ত খাদ্য মন্ত্রণালয় নিয়েছে বলে জানান খাদ্যমন্ত্রী।
এদিকে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম আমদানির বিষয়ে মিটিংয়ে জানান, চলতি অর্থবছরে ২-৩ লাখ টন চাল বিদেশ থেকে জি টু জির মাধ্যমে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু গত বোরো ও আমন মৌসুমে সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় এবং মজুদ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে জিটুজি ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে চাল আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে একাধিক দেশ থেকে মোট ৬ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। চাহিদা মেটাতে আরও প্রায় ৫ লাখ সহ মোট ১১ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে বলে জানান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারী পর্যায়ে ১০ লাখ টনের বেশি চাল আমদানির জন্য ৩২০ জন ব্যবসায়ী/প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে আমদানি করা চালগুলো বাজারজাতের জন্য চলতি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সময় বেধে দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে সভায় অর্থমন্ত্রী খাদ্যের ক্ষেত্রে চাহিদার পরিমাণ বার্ষিক ভিত্তিতে প্রজেকশন এর পরিবর্তে মৌসুম ভিত্তিক প্রজেকশন করার তাগিদ দিয়েছেন।
এছাড়া গুদামের ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো, খাদ্যে গুণগত মান ঠিক রাখা এবং সিদ্ধ ও আতপ চালের চাহিদার সময় ও সংগ্রহের ডাটাবেইজ তৈরি, খাদ্যশস্যের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা, চাহিদা, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, আমদানি কার্যক্রম একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে সমন্বয়ের কার্যক্রম হাতে নেয়ার বিষয়ে মতামত দেন।