কম আমদানি ও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় চালের বাজার অস্থিতিশীল
চাল আমদানি কম হওয়া এবং স্থানীয় উৎপাদন থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থতার কারণে আমন মৌসুমে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সরকার এখন মজুত বাড়াতে আমদানির ওপর জোর দিচ্ছে।
সরকারি গুদামের মজুত কম থাকায় বাজারে চালের সরবরাহ কমে গেছে এবং দাম বেড়ে গেছে। সাধারণত আমন মৌসুমে চালের সরবরাহ ভালো থাকে এবং দামও কম থাকে। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন।
এ অবস্থায় ওএমএস এবং টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। চালের ক্রমবর্ধমান দামের কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
৮ জানুয়ারির প্রকাশিত সরকারি এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক মাসে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। মোটা চাল, যেমন স্বর্ণা ও চায়না, প্রতি কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়ে এখন ৫৪-৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ডিসেম্বরের শেষে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। মাঝারি এবং মিহি চালের দামও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
চালের এ মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায় সরকার দ্রুত আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছে।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকারের কাছে চালের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে এবং সরবরাহ বাড়াতে দ্রুত আমদানি করা হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, জানুয়ারিতে ১.৭৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর অর্থবছরের (জুনে শেষ) বাকি সময়ে মোট আট লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হবে।
এ জন্য সংশোধিত বাজেটের ২,৮৯৮ কোটি টাকার প্রাথমিক বরাদ্দ থেকে বাড়িয়ে ৬,২৭০ কোটি টাকা চেয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৪৩৮ কোটি টাকা আগের অর্থবছরের আমদানির বকেয়া পরিশোধে ব্যয় হবে।
সূত্র জানায়, সরকার ইতোমধ্যে ২.৫০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির একটি দরপত্র চূড়ান্ত করেছে। পাশাপাশি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি ভারত থেকে আরও ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।
এছাড়া, জি-টু-জি চুক্তির আওতায় মিয়ানমার থেকে এক লাখ মেট্রিক টন এবং পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকেও চাল আমদানির বিষয়ে আলোচনা চলছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার প্রতি কেজি ৪৭ টাকা দরে সিদ্ধ চাল সংগ্রহের চেষ্টা করছে, কিন্তু বাজারে এ চালের দাম এখন ৫৫-৫৮ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে সরবরাহে অনীহা দেখাচ্ছে।
'তাই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি ছাড়া পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। চালের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রয়োজন হয়েছে,' বলেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর আমন মৌসুমে এক লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বন্যার কারণে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, 'চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে স্বল্পমেয়াদে সরবরাহ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাকৃতিক কারণে সরবরাহ ঘাটতি হলে তা পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কেউ যদি কৃত্রিমভাবে সরবরাহ ব্যাহত করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গবেষণা ও উৎপাদকদের সঙ্গে সমন্বিত সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ বাড়ানো জরুরি।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামে ৮.০৩ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ৪.১৬ লাখ মেট্রিক টন গম মজুত রয়েছে।
সরকার বর্তমানে আমন মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকে প্রতি কেজি সেদ্ধ চাল ৪৭ টাকা এবং মোটা চাল ৪৬ টাকায় সংগ্রহ করছে। গত বছরের ১৭ নভেম্বর শুরু হওয়া এ সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ পর্যন্ত খাদ্য অধিদপ্তর দুই লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করেছে।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে (১ জুলাই, ২০২৪) ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মোট এক লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকার আমদানি করেছে ২৪ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন এবং বেসরকারি খাতে আমদানি হয়েছে এক লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। তবে ডলারের দাম বাড়ায় ডিসেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সরকার ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে টিসিবির মাধ্যমে কার্ডধারী পরিবারগুলোর মধ্যে প্রতি কেজি ৩০ টাকা দরে পাঁচ কেজি চাল সরবরাহ করে আসছে। তবে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে চাল সরবরাহ না পাওয়ায় জানুয়ারি মাসে এ কর্মসূচি স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছেন টিসিবির তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
এদিকে, বুধবার (৮ জানুয়ারি) ঢাকার তেজগাঁওয়ে টিসিবির ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি বিক্রির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিন চালের দামের বৃদ্ধির জন্য অস্থায়ী মজুতকে দায়ী করেছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মজুতবিরোধী আইন কার্যকর করতে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
খাদ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওএমএসের মাধ্যমে চার লাখ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল তিন লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন।