কোভ্যাক্সিন ফলপ্রসূ হলে বেগবান হবে টিকা কর্মসূচি আর ভ্যাকসিন কূটনীতিতে আধিপত্য পাবে ভারত
মানবদেহে চালানো বড় আকারের সর্বশেষ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিজেদের আবিষ্কৃত কোভ্যাক্সিন টিকা ৮১ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারত বায়োটেক। ট্রায়ালের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা এক প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দৃঢ় হলে ভারতের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে আসবে নতুন গতি। পাশাপাশি দেশটির ভ্যাকসিন কূটনীতিও পাবে অনন্য মাত্রা।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষেধক উৎপাদক ভারত বায়োটেক। তবে ওষুধ শিল্পের বাইরে সংস্থাটির তেমন পরিচিতি নেই। সংস্থাটি সরকারি বিজ্ঞানীদের সহায়তায় ২০২০ সালের প্রথমার্ধ থেকে তাদের কোভিড-১৯ টিকা তৈরির চেষ্টা শুরু করে। গেল বছরের শেষদিকে কোভ্যাক্সিনের জরুরি অনুমোদন দেয় নয়াদিল্লি। দ্বিতীয় ট্রায়াল শেষ হওয়ার পর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার সঙ্গে দেওয়া হয় এ অনুমোদন। ইতোমধ্যেই, জাতীয় টিকাদানের অংশ হিসেবে এর ডোজ দেওয়া হয়েছে ১০ লাখের বেশি।
তৃতীয় ট্রায়াল শেষের আগে স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত ও অনুমোদিত এ টিকায় আস্থা রাখতে পারেননি ভারতের আপামর জনতা। তারা শেষ ট্রায়ালের ফল প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে তারা সেই সুযোগ পাননি। এছাড়া, জাতীয় টিকাদানের অংশ হিসেবে টিকাগ্রহীতাদের কোভ্যাক্সিন বা সেরামের কোভিশিল্ড টিকার মধ্যে যেকোনো একটি বেঁছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এমনকি- কে কোন টিকার ডোজ পেলেন- সেটাও জানানো হচ্ছে না। দেশটির স্বাস্থ্য কর্মীদের মতে, কোভ্যাক্সিন নিয়ে এই অনাস্থা ও ভীতির কারণেই প্রত্যাশার চেয়ে ধীর গতিতে চলছে ভারতের টিকাদান কর্মসূচি।
গত বুধবার (৩ মার্চ) দেওয়া ঘোষণার মাধ্যমে এ উদ্বেগ দূর করা লক্ষ্য ছিল বলে জানিয়েছে ভারত বায়োটেক। তৃতীয় ট্রায়ালে প্রতিষেধকটি ও প্লেসেবো হিসেবে অন্য ওষুধের নির্যাস ১৮ থেকে ৯৮ বছরের ২৫,৮০০ জনকে দেওয়া হয়। ট্রায়ালের মধ্যবর্তী ফলাফলে বলা হয়, এটি কোভিডের বিরুদ্ধে ৮১ শতাংশ ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে। কোম্পানিটি আরও জানায়, যুক্তরাজ্যে পাওয়া করোনার আরও বেশি সংক্রামক ধরনটির বিরুদ্ধেও এটি রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলেতে পেরেছে।
ভারত বায়োটেকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষ্ণা এলা বলেন, "আজকের দিনটি শুধু আমাদের কোম্পানি নয়, সমগ্র দেশ এবং ভারতীয় বিজ্ঞানের জন্যে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন।"
ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ জন, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই আক্রান্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি। অবশ্য, মাথাপিছু প্রাণহানির মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকটাই কম। তবে অদৃশ্য জীবাণুর থাবায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতির একটি ছিল ভারত।
বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে আছে প্রতিবেশী দেশটি। আগস্ট নাগাদ ১৩০ কোটি নাগরিকের মধ্যে ৩০ কোটিকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে ভারত সরকার। ইতোমধ্যে, দেওয়া হয়েছে মাত্র দেড় কোটি ডোজ। এর বেশিরভাগই ছিল সেরাম উৎপাদিত ও যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথভাবে আবিষ্কৃত প্রতিষেধকের মাধ্যমে।
গত বুধবার স্থানীয়ভাবে তৈরি কোভ্যাক্সিনের ডোজ ইঞ্জেকশন নেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এসময় তিনি প্রতিষেধকটির উপর তার আস্থার কথাও গর্বভরে প্রকাশ করেন।
"আমাদের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে কাজ করে যেভাবে বিশ্ব পর্যায়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী লড়াইয়ে অবদান রেখেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর।" টুইটারে টিকার ইঞ্জেকশন নেওয়ার ছবি পোষ্ট করে সেখানেই একথা লেখেন তিনি।
ভ্যাকসিন কূটনীতিতে সকলকে চমকে দিয়েই প্রথম সারিতে চলে এসেছে ভারত। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশের প্রতি বাড়িয়েছে টিকা প্রাপ্তিতে সহযোগিতার হাত। কিছু ধনী দেশও পেয়েছে সে সহযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উৎপাদকরা তাদের সিংহভাগ চালান ধনী দেশে বিক্রি করে ফেলাতেই, কূটনীতির অভিনব সুযোগ আসে ভারতের সামনে। তাছাড়া, অন্যান্য দেশের ওষুধ সংস্থা উৎপাদনে গতি আনতেও হিমশিম খাচ্ছে। এসব কিছু ভারতের জন্যে খুলে দেয় প্রভাব বিস্তারের নতুন দিগন্ত।
সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার ব্যাপক উৎপাদন সক্ষমতার কল্যাণে ইতোমধ্যেই প্রতিবেশীসহ অনেক দেশে লাখ লাখ ডোজের চালান পাঠাতে পেরেছে ভারত। সঙ্গে পূরণ করতেও পারছে নিজেদের চলমান টিকা কর্মসূচির চাহিদা। তারপরও, রয়েছে রপ্তানির জন্য যথেষ্ট উদ্বৃত্ত। এরমধ্যেই, কানাডা, কেনিয়া, কলম্বিয়া, বাংলাদেশ-সহ ৪৫টি দেশে রপ্তানি করেছে সাড়ে ৪ কোটি ডোজ। এর বাইরে অনুদান হিসেবে ৭০ লাখ ডোজ দিয়েছে ভারত সরকার।
মানব দেহে সুরক্ষা পরীক্ষার শেষ ট্রায়ালের ইতিবাচক ফলাফলের পর সেরামের মতোই কোভিড টিকার আরেক বৃহৎ উৎপাদকে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা করছে ভারত বায়োটেক। গত বুধবার সংস্থাটি জানায়, ইতোমধ্যেই ৪০টি দেশ তাদের আবিষ্কৃত প্রতিষেধক কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে।
আর সবকিছু ঠিকঠাক চললে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে আধিপত্য বাড়বে ভারতের। তেমন সম্ভাবনাই বেশি; কারণ ভারত বায়োটেক ভ্যাকসিন উৎপাদনের দৌড়ে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। অতীতে তারা উৎপাদন করেছে নানা রোগের শত শত কোটি ডোজ প্রতিষেধক। কোম্পানিটির দাবি, সাধারণ ফ্রিজারের তাপমাত্রায় সংরক্ষণের সুবিধা থাকায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বাজারে তাদের টিকা তুলনামূলকভাবে অন্যগুলির তুলনায় এগিয়ে থাকবে।
ভারত বায়োটেকের আরও দাবি, বক্স খোলার পর সেখানে থাকা তাদের টিকার ডোজগুলো ২৮ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। অন্যান্য টিকার ক্ষেত্রে বক্স খোলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব ডোজ দেওয়া না হলে- সেগুলো কার্যকারিতা হারায়। এই সুবিধা সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববাজারে নতুন মাত্রা দেবে কোভ্যাক্সিনের বিপণন।
- সূত্র: ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল