পাকিস্তানের বিখণ্ডীকরণ ঠেকাতে...
২০২১ যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির তেমনি পাকিস্তানের বিখন্ডীকরণ ঠেকানোর উদ্যোগেরও অর্ধশতক পূর্তি এ বছরই। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধীরা কিভাবে পাকিস্তান প্রেম দেখিয়েছেন তার কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরা হল:
গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে বালুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত লেফটেন্যান্ট জেনালে টিক্কা খান বেতার ভাষণে বলেছেন: দেশকে খন্ড-বিখন্ড হওয়া থেকে এবং পরিনামে ভারতীয় দাসত্বের কবল থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালনের জন্যই সেনাবাহিনী আহ্বান করা হয়েছিল।
আর বেসামরিক গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ডাক্তার এ এম মালিক বলেছেন, আল্লাহতায়ালা আমাদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। প্রদেশের অভ্যন্তরে ও বহিশত্রু থেকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হুমকি প্রদেশে শান্তির বিঘ্ন ঘটিয়েছে এবং অর্থনীতির ক্ষতি সাধন করেছে। জীবন সায়াহ্নে তিনি একদা বহুল কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার সৈনিক হিসেবে পুনরায় সেই দেশটিকে অখন্ড রাখা, শান্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং পুনর্গঠন করার দায়িত্ব নিয়েছেন। পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি ধ্বংসের প্রয়াসে লিপ্ত শত্রুদের তৎপরতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে তিনি জনগণকে আহ্বান জানান।
গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) বোমা বর্ষণের পর গভর্নরকে ট্রেঞ্চে ঢুকতে হলো। ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসার পর পাকিস্তান অখন্ড রাখার প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে পারলেন না। ১৪ ডিসেম্বর দলবল নিয়ে পদত্যাগ করে প্রাণ বাঁচাতে ছুটলেন রেডক্রস ঘোষিত নো ওয়ার জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টলে। প্রাণে বেঁচে গেলেন বটে কিন্তু পেয়ারা পাকিস্তান দু'দিন পরেই ভেঙ্গে দু'টুকরো হয়ে গেলো। পূর্বাংশে সৃষ্টি হলো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
রাজাকার ও পুলিশ প্যারেডে আমন্ত্রণ
পরদিন ১৪ আগস্ট ১৯৭১। পাকিস্তানের ২৪তম স্বাধীনতা দিবস সেদিন। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানে তাদের সময়টা পাকিস্তানের অনুকূলে নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করার এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ দেবার লোক মাত্র হাতে গুণা কজন। তার উপর নাশকতার আশঙ্কাও আছে।
প্রথম কাজ নাশকতা ঠেকানো। দিনাজপুরের সামরিক আইন প্রশাসক আদেশ জারি করলেন 'আজ রাত ১০:৩০ মিনিট হইতে সকাল ৪টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকিবে। উক্ত সময়ের মধ্যে কাহাকেও ঘরের বাহিরে কিংবা রাস্তায় পাওয়া গেলে গুলি করা হইবে।' আজ রাত মানে ১৩ আগস্ট রাত।
এমনিতে তখন ঢাকা চট্টগ্রামসহ জেলা শহরের মানুষ কারফিউতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা দিবস পালনের জন্য সামরিক আইন প্রশাসক ১৩ আগস্ট যে আদেশ জারি করেছে তার সারাংশ নিম্নরূপ :
ক) শান্তি কমিটির সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার লোকজনসহ ১৩ আগস্ট সাড়ে তিনটার মধ্যে টাউন হলে হাজির থাকবেন। টাউন হলে থেকে শোভাযাত্রা বের হবে এবং শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করবে।
খ) ১৪ আগস্ট শনিবার সকাল ৬টায় সকল সরকারি ও বেসরকারি ভবনে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ছটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত মসজিদে কোরআন পাঠ হবে।
গ) সব স্কুলে পতাকা উত্তোলন, সকল স্কুল ছাত্র জেলা স্কুলে এবং সকল ছাত্রী সরকারি গার্লস স্কুলে সমবেত হয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকা উত্তোলন করবে।
ঘ) সকাল ৯টায় দিনাজপুর পুলিশ লাইনে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীর প্যারেড অনুষ্ঠিত হবে। সরকারি কর্মচারি ও জনগণ উপস্থিত থাকবেন।
ঙ) বিনে পয়সায় সিনেমা প্রদর্শন করা হবে: ছাত্ররা যাবে বোস্তান সিনেমায় এবং ছাত্রীরা মডার্ন সিনেমা হলে।
চ) পাকিস্তানের সমৃদ্ধি ও উন্নতি কামনা করে মসজিদে মোনাজাত এবং মন্দির ও গির্জায় প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। মহিলাদের মিলাদ ২টায়, নিউ টাউন এলাকার মহিলাদের জন্য নিউ টাউন প্রাইমারি হল এবং অন্য এলাকার মহিলাদের জন্য সরকারি গার্লস স্কুল।
ছ) বিকেল ৪টায় টাউন হলে জনসভা।
জ) সন্ধ্যা ৭টায় সরকারি ও বেসরকারি ভবনে আলোকসজ্জা। বেসরকারি ভবনে সজ্জার জন্য পুরস্কার দেয়া হবে-- ১ম পুরস্কার ১০০ টাকা, ২য় পুরস্কার ৭৫ টাকা ও ৩য় পুরস্কার ৫০ টাকা।
এই আদেশ জারির পরপরই কর্তৃপক্ষের নজর পড়ে জাতীয় পতাকার অপব্যবহার হচ্ছে। সুতরাং ১৯ আগস্ট নতুন আদেশ জারি করল জেলা সামরিক আইন প্রশাসক :
গত ২৬ মার্চ হইতে জাতীয় পতাকা ব্যক্তিগত বা ঘর, গাড়ি, রিক্সা সাইকেল ইত্যাদিতে যথেচ্ছা ভাবে উড়ান হইতেছে। ঐ সমস্ত পতাকার বেশির ভাগ বিবর্ণ, ছেড়া এবং উপযুক্ত মাপের নহে।
মার্শাল ল অথরিটির নির্দেশে সর্ব সাধারণকে জানান যাইতেছে যে তাহারা যেন নিজনিজ বাড়িঘর, দোকান, গাড়ি, রিক্সা, সাইকেল ইত্যাদি হইতে অবিলম্বে জাতীয় পতাকা নামাইয়া ফেলেন। যে সমস্ত বিল্ডিং-এ পতাকা উঠাইবার নির্দেশ আছে, সেই সব বিল্ডিং-এ যথারীতি যথারীতি পতাকা উড়িবে।
এই আদেশের শেষে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় রাত সাড়ে দশটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে, ঘরের বাইরে কিংবা রাস্তায় কাউকে পাওয়া গেলে গুলি করা হবে।
শান্তি কমিটিকে আগমন সংবাদ জানানো
যারা অন্য কোনো স্থান থেকে দিনাজপুর শহরে আসবেন তাদের সবাই তো আর পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নাও হতে পারেন। তা ছাড়া এটাও সত্য সামরিক প্রশাসন মনে করছে দেশে শত্রুর তৎপরতাও বেড়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বাইরে থেকে আসা মানুষকে রিপোর্ট করতে হবে। কোথায় থানায়? না। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের জারি করা পত্রে বলা হয়েছে :
'সর্ব সাধারণের অবগতির জন্য জানান যাইতেছে যে যাহারা বাহির হইতে দিনাজপুর টাউনে আসিতেছেন তাহারা যেন জেলা শান্তি কমিটির নিকট তাহাদের আগমনের কথা রিপোর্ট করেন।'
জেলা সামরিক আইন প্রশাসক আরো জানায় শহরের পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও অন্যান্য সম্পত্তি বিধবাদের নিকট বন্দোবস্তু দেবার জন্য তাদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হচ্ছে-- 'সবুজ রংয়ের দরখাস্তের ফর্ম আনজুমানে মোহাজেরিনের অফিস ও টাউন হলের নিকট অবস্থিত শান্তি কমিটির অফিসে পাওয়া যাইবে। শান্তি কমিটি ও রিলিফ কমিটির মেম্বারগণকে এবং সমস্ত সমাজকর্মীগণকে বিধবাদের উক্ত ফর্ম পূরণ করতে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করা যাইতেছে। ফর্ম পূরণ করিয়া আগামী ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিসি সাহেবের অফিসে দাখিল করিতে হইবে।
চ্যান্সেলর টিক্কা খান
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। সুতরাং চ্যান্সেলর তো তার উপর অর্পিত কিছু ক্ষমতা দেখাইতেই পারেন। তিনি গভর্নর ছাড়াও তিনি জোন বি-র সামরিক আইন প্রশাসক।
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত (টার্মিনেট) করা হয়। তারা হচ্ছেন বাংলার মুনিরুজ্জামান, ডক্টর এনামুল হক, একই সঙ্গে তিন বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ডক্টর এ বি এম হাবিবুল্লাহ। মুনিরুজ্জামানের ক্ষেত্রে সামরিক আইনের ৭৮ বিধি অনুযায়ী আটকাদেশও হয়। ইংরেজিতে জারি করা আদেশের একটি অনুবাদ পেশ করা হলো :
মার্শাল ল হেডকোয়ার্টার্স জোন বি, ঢাকা
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কর্তৃক এমএলআর ৮০-তে আমার উপর অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, এইচকিউএ, এসপিকে জোন বি-র সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের ক্ষমতাবলে ডক্টর এবিএম হাবিবুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধানকে আপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত করলাম, এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
টিক্কা খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল
সামরিক আইন প্রশাসক জোন বি গভর্নর পূর্ব পাকিস্তান।
একই দিনে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে অংশগ্রহণ না করার জন্য ইংরেজি বিভাগের ডক্টর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলা বিভাগের ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিম এবং বাংলা বিভাগের ডক্টর মুনীর চৌধুরীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আদেশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানেরই।
হাজিরহতেব্যর্থহলে...
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সামরিক আইন প্রশাসক জোন বি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষকসহ ৫ জনকে ৮ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় এমপি হোস্টেলে ৬ নম্বর সেক্টরের সাব-মার্শাল ল অ্যাডমিনস্ট্রেটরের কাছে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়। হাজির হতে ব্যর্থ হলে সামরিক আইনের ৪০ নম্বর বিধি অনুযায়ী অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য চালানো হবে।
১. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২. আবদুর রাজ্জাক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৩. সারওয়ার মুর্শেদ, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৪. মাজহারুল ইসলাম, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
৫. আবু জাফর সামসুদ্দিন, বাংলা একাডেমি।
রাষ্ট্রদ্রোহী কর্নেল ওসমানী
মার্শাল ল রেগুলেশন ৪০ এ প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে--
আমি 'খ'অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে: জে: টিক্কা খান এম পিকে, পিএসসি
আপনি কর্নেল এমএজি ওসমানীকে (অবসরপ্রাপ্ত) আপনার বিরুদ্ধে পাকিস্তান দন্ডবিধির ১২১, ১২৩, ১৩১ ও ১৩২ নম্বর ধারা এবং সামরিক আইন বিধির ১০ ও ১৪ নম্বর ধারায় আনীত অভিযোগের জবাব দেবার জন্য ১৯৭১ সালের ২০ শে মে সকাল ৮টার সময় ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানীস্থ ১ নম্বর সেক্টরের উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হতে আদেশ দিচ্ছি।
এই আদেশে আরো জানানো নয় অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি হাজির হতে ব্যর্থ হন তাহলে তার অনুপস্থিতিতেই সামরিক আইনের ৪০ নম্বর বিধি অনুযায়ী বিচারকার্য করা হবে।
১৩ সিএসপির জন্য হাজিরা পরওয়ানা
দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ১৯৭১ সালে আমলাদের বেশ ক'জনকে সামরিক আদালতে তলব করা হয়েছিল। ২ সেপ্টেম্বরের প্রথম আদেশটিতে সামরিক আইন বলে প্রাপ্ত ক্ষমতায় লে. জেনারেল টিক্কা খান ১৩ জন সিএসপি কর্মকর্তাকে ৮ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় এমপিএ হোস্টেলের ছয় নম্বর সেক্টরের সাব মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটরের নিকট হাজির হবার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক আইন বিধি ৪০ ধারায় বিচার করা হবে। কর্মকর্তারা হচ্ছেন :
১. খোন্দকার আসাদুজ্জামান, জয়েন্ট সেক্রেটারি, অর্থ বিভাগ।
২. এইচ টি ইমাম, ডিসি, পার্বত্য চট্টগ্রাম।
৩. আবদুস সামাদ, ডিসি সিলেট।
৪. মোহাম্মদ নূরুল কাদের খান, ডিসি পাবনা।
৫. সৈয়দ আবদুস সামাদ, পুনর্বাসন অফিসার, পার্বত্য চট্টগ্রাম
৬. কুদরত এলাহী চৌধুরী, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার, রাজশাহী
৭. মোহাম্মদ খুরশেদুজ্জামান চৌধুরী, এসডিও, কিশোরগঞ্জ
৮. কাজী রকিবুদ্দিন, এসডিও ব্রাহ্মণবাড়িয়া
৯. ওয়ালিউল ইসলাম, এসডিও, মাগুরা
১০. আকবর আলী খান, এসডিও, হবিগঞ্জ
১১. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এসডিও, নড়াইল
১২. মোহাম্মদ তৌফিক এলাহী চৌধুরী, এসডিও মেহেরপুর
১৩. সাদাত হোসেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, যশোর।
ঠেডা মালেইক্কার শপথ ও তার মন্ত্রীসভা
একাত্তরে এম আর মুকুলের পাঠ করা চরমপত্র যারা স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত শুনতেন, এমনকি অনিয়মিত শ্রোতার কানেও ঠেডা মালেইক্কা নামটি পৌঁছেছে। তিনি ডাক্তার আবদুল মোতালিব মালিক বা এ এম মালিক। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন একটি ধারনা দেবার জন্যই লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের জায়গায় বেসামরিক গভর্নরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিন সেপ্টেম্বর গভর্নর হাউসে (এখনকার বঙ্গভবন), 'জাকজমকপূর্ণ' অনুষ্ঠানে শপথ গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী শপথ পাঠ করান। তারপর তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি এবং দু'জন সাবেক গভর্নর সুলতানউদ্দিন আহমদ ও আবদুল মোনায়েম খান। অতিথি হিসেবে আরো হাজির ছিলেন গোলাম আজম, আবুল কাশেম, ফজলুল কাদের চৌধুরী, খান এ সবুর, শামসুল হুদা, ইউসুফ আলী চৌধুরী, এ এস এম সোলায়মান, আবদুল জব্বার খান, পীর মোহসেনুদ্দিন, আনোয়ারুল হক, হাফিজুদ্দিন, এ আর এস দোহা, কিউ এম রহমান, নওয়াব হাসান আসকারী, এম এম ইস্পাহানি, বিচারপতি আমিন আহম্মদ। এ ছাড়াও কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীগণ উপস্থিত ছিলেন। লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের নামগুলো আশা করছি একালের আগ্রহী গবেষক বের করবেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বরাবরই চাটুকারবৃত্তিতে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন।
গভর্নর শপথ নেবার ১৪ দিন পর ৮ জন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেন। ৯ জনের শপথ নেবার কথা ছিল। একজন পৌঁছতে না পারার কারণে পরদিন তিনি শপথ নেন। এই ৯ জন হচ্ছেন মুসলিম লীগের আবুল কাশেম এবং এডভোকেট নওয়াজেশ আহমদ, জামায়াতে ইসলামের আব্বাস আলী খান ও মওলানা এ কে এম ইউসুফ, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার এবং শামসুল হক, কৃষক শ্রমিক পার্টির এ এম এম সোলায়মান, নেজামে ইসলামে মোহাম্মদ ইসহাক, কনভেনশন মুসলিম লীগের আখতারুদ্দিন আহমদ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অউং শু প্রু। পরবর্তী সময়ে আরও তিনজন এ কে মোশাররফ হোসেন, মুজিবুর রহমান, জসীম উদ্দিন আহমদ শপথ নেন।
দফতর বন্টনের পর আবুল কাশেম হলেন অর্থমন্ত্রী এবং আব্বাস আলী খান পেলেন শিক্ষা, আখতার উদ্দিন আহমদ : বাণিজ্য মন্ত্রী ও শিল্প, আইন ও সংসদীয় বিষয়: এ এস এম সোলায়মান, শ্রম সমাজ কল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা, অউং শু প্রু, বন সমবায় ও মৎস, মওলানা এ কে এম ইউসুফ, রাজস্ব দফতর: মওলানা এ কে এম ইউসুফ রাজস্ব, মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা; নওয়াজিশ আহমদ খাদ্য ও কৃষি; স্বাস্থ্য ওবায়দুল্লাহ মজুমদার এবং তথ্য, শামসুল হক সাহায্য ও পুনর্বাসন; এ কে মোশাররফ হোসেন পূর্ত বিদ্যুৎ ও সেচ: শামসুল হকের দায়িত্বের সাথে যোগ করা হয়। প্রত্যাগত ও গৃহত্যাগীদের পুনর্বাসন।
এই মন্ত্রী পরিষদ দীর্ঘায়ু হয়নি। গভর্নরসহ মন্ত্রীদের সকলেই স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নরের নেতৃত্বে একটি কাগজে সই করে সকলেই পদত্যাগ করেন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
গভর্নর এ এম মালিক পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক থাকতে এবং তাদের তৎপরতা ঠেকাতে উজ্জীবিত করতে বেশ কটি বক্তৃতা দেন। তিনি কয়েকটি বাস্তব প্রশ্নও সামনে তুলে ধরেন। 'এই নজিরবিহীন সংকটের মুখে'পাকিস্তান একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবে টিকে থাকবে না 'আমরা শেষ হয়ে যাব'সেইটিই আমাদের সামনে প্রশ্ন। তিনি বলেন, পশ্চিম বঙ্গের ক্ষুধা দারিদ্র্য ও ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য ভারত এই অঞ্চলকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে।
পশ্চিম বাংলার লোকেরা যেখানে দিল্লির হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাচ্ছে না সেখানে পূর্ব বাংলার লোকদের পিন্ডির হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পরামর্শ দিচ্ছে কেনো?
গভর্নর বলেন, 'বাংলা যদি স্বাধীন হয় তাতে পশ্চিম বঙ্গও থাকা উচিত।'
গভর্নর রাজাকারদের নিষ্ঠার সাথে বাইরের শত্রু ও ঘরের শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তিনি নভেম্বরে করাচিতে রাজাকারদের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তারা জীবনের বিনিময়ে রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের নাশকতামূলক তৎপরতার মোকাবেলা করছে। ৩০ অক্টোবর উর্দু ডাইজেস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন '২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনী যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে তাতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু তিনি রক্ষা পেলেন না। ১৪ ডিসেম্বর পরিষদসহ তাকে পদত্যাগ করতে হয়। ১৯৭২-এর ২০ নভেম্বর তিনি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ১৯৭৭-এ মুত্যুবরণ করেন।
একাত্তরের মন্ত্রীবচন
শ্রম, সমাজ কল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এ এস এম সোলায়মান :
ক. আমরা যদি মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে যাই তাহলে পাকিস্তান টিকবে না।
খ. আমাদের বীর জনগণ শত্রুকে নির্ভুল করে দিয়েছে।
গ. ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্র চালু রাখতে চান বলেই বেসামরিক গভর্নর ও মন্ত্রীদের নিয়োগ দিয়েছেন।
ঘ. পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ পাকিস্তানকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়েছে।
ঙ. বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আমাদের শত্রুদের হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল কাশেম:
তিনি ধরি মাছ না ছুই পানি জাতীয় কথা বলেছেন : জনগণের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা দরকার। জনগণ এগিয়ে না এলে মন্ত্রীদের প্রচেষ্টা সফল হবে না। তিনি জনগণকে জিজ্ঞেস করেছেন : পরের উস্কানিতে কেউ কি নিজের ঘরে আগুন লাগায়?
শিক্ষা ও বাণিজ্যমন্ত্রী আখতার উদ্দিন আহমদ
ক. হিন্দুদের সঙ্গে বাস করা একদম অসম্ভব জেনেই কায়েদে আজমের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয় এবং মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
খ. আল্লাহ না করুক যদি পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে মুসলমানরা তাদের আলাদা বৈশিষ্ট হারিয়ে ফেলবে এবং হিন্দুদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়বে।
গ. ইসলাম ও মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে।
রাজস্বমন্ত্রী এ কে এম ইউসুফ
রাজাকাররা শুধু অনুপ্রবেশকারীদের হামলাই সাফল্যের সাথে প্রতিহত করেনি, তারা বেশ কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় ছাপমারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
পূর্তমন্ত্রী এ কে মোশাররফ হোসেন
১. ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ হামলা ছাড়াও আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আক্রমণ চালাচ্ছে।
২. বর্তমান সংকটে পাকিস্তান আরো শক্তিশালী হয়েছে ও একটি দৃঢ়ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে।
৩. মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক :
১. মাতৃভূমি থেকে শত্রুদের উৎখাতের ব্যাপারে সশস্ত্রবাহিনীর সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে।
২. আমাদের মধ্যকার আঞ্চলিক সংকীর্ণ মনোভাব পরিত্যাগ ও ভাষার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মুসলমান হিসেবে আমাদের সংস্কৃতি যে এক তা অনুধাবন করতে হবে।
পুনর্বাসন মন্ত্রী শামসুল হক:
১. জাতীয় আদর্শের প্রতি উদাসীনতাই আজকের (একাত্তরের) সংকটের কারণ।
২. জনগণ আওয়ামী লীগকে ছয় দফা অথবা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতেই ভোট দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ষড়যন্ত্রকারীরা ভারতের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে বিচ্ছিন্নতার দাবি করছে।
খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী বলেন, ছাত্রদের মঙ্গলের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রমজানের ছুটি বাতিল করা হয়েছে, ছাত্রদের পড়াশোনা করে পাকিস্তানে খাঁটি দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ের মন্ত্রী জসীম উদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত শক্তিশালী করতে জনগণের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান বলেন, বিপথগামী নেতৃত্ব ও ভুল শিক্ষানীতির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন তা আমাদের জন্য তার শুভেচ্ছার প্রমাণ বহন করে। সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী অউং শু প্রু পূর্ব পাকিস্তান বৌদ্ধমন্দির ধ্বংসের ভারতীয় প্রচারনাকে ডাহা মিথ্যে বলে চিহ্নিত করেন। ওবায়দুল্লাহ মজুমদার বলেন, মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং ক্যাম্পে তাদের মস্তক সেলাই করা হচ্ছে।
পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স একাডেমি
পাকিস্তান আমলের দালাল বুদ্ধিজীবী পোষণ করা প্রতিষ্ঠান বিএনআর বা ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকলস্ট্রাকশন একাত্তরের জুলাই মাসে এক অর্ডিন্যান্স জারি করে বিলুপ্ত করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিস্থাপিত করতে পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স একাডেমি। 'একাডেমি বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং সাধারণভাবে পাকিস্তান সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষনায় নিয়োজিত থাকবে। এ ছাড়া একাডেমি পূর্ব পাকিস্তানের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্নাদি এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়াদি সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশনার দায়িত্বও গ্রহণ করবে।
নতুন একাডেমিতে ১৩ জন সরকারি ও বেসরকারি সদস্যের একটি বোর্ড থাকবে। ৫ সদস্যের একটি কার্যনির্বাহী কমিটিও থাকবে। বিলুপ্ত ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশনের ডিরেক্টর হাসান জামান নবস্থাপিত একাডেমি ফর পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স-এর ডিরেক্টর হবেন। অত্যন্ত স্বল্পায়ু এই একাডেমি অচিরেই অকার্যকর হয়ে যায় এবং স্বাধীনতার পরপরই বিলুপ্ত হয়।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার বিচার প্রেসনোট
নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা ও অন্যান্য অপরাধে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে আজ ৯ আগস্ট জারি করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
১৯ আগস্ট গোপনীয়ভাবে বিচার কার্য শুরু হবে এবং বিচারের কার্যবিবরনী গোপন রাখা হবে বলে প্রেস নোটে উল্লেখ করা হয়।
এই বিচারও পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার স্বার্থে!
কিন্তু দুর্ভাগ্য, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাথে নিয়েও পাকিস্তান সরকার বিখন্ডীকরণ ঠেকাতে পারেনি।