খেলাধুলার সামগ্রী উৎপাদন কি পারবে আমাদের মোড় ঘুরিয়ে দিতে?
চারদিকে নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার চোখে পড়ার মতো। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মোট বৈদেশিক আয়ের ৮৩ শতাংশ এসেছে শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্প থেকে (বিজিএমইএ ২০২০)। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পোশাক শিল্প আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে এই শিল্প থেকে।
স্বল্প মজুরি এবং বৃহৎ জনবল নিয়ে কাজ করায় তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি আর কতদিন এই খাতের ওপর নির্ভর করতে পারবে? যদি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মানুষের কায়িক শ্রমের জায়গাটি দখল করে নেয়, তখন কি আমরা এই এগিয়ে থাকার সুবিধাটুকু পাব? আমাদের কি উচিত না এখনই আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য শিল্পের সন্ধান করা?
২০১১-২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এমএমএফ-এর (ম্যান মেড ফাইবার) গ্লোবাল মার্কেট শেয়ারের পরিমাণ ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে এই শেয়ারের পরিমাণ আরও বাড়বে। ভারত ও তুরস্কের মতো দেশগুলো এখন তাদের কিছু ফাইবার ইন্ডাস্ট্রিকে এমএমএফ ইন্ডাস্ট্রিতে সরিয়ে নিচ্ছে এবং তৈরি পোশাক শিল্পের দিকে হাত বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মূলত ন্যাচারাল ফাইবার বা প্রাকৃতিক তন্তুর ওপর নির্ভরশীল। কারণ বাংলাদেশের গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুতে এই তন্তুর উৎপাদন ভালো হওয়ায় তা সহজলভ্য হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তুলার উৎপাদন কম হওয়ায় এবং এর ক্রমবর্ধমান দামের কারণে বিশ্বে ক্রেতা বাজার ধরে রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, ম্যান মেড ফাইবার (এমএমএফ) বা মানবসৃষ্ট তন্তু উৎপাদনের কাঁচামাল খুবই সহজলভ্য এবং যত ইচ্ছা উৎপাদন করা সম্ভব। ম্যান মেড ফাইবারের দামও হবে প্রাকৃতিক তন্তুর চেয়ে অনেকটাই কম।
তাছাড়া, ক্রেতাদের আকর্ষণও প্রাকৃতিক তন্তু থেকে ম্যান মেড ফাইবারের দিকে সরে আসছে। কারণ ম্যান মেড ফাইবার বেশ বৈচিত্র্যময়, এটি অনেক বেশি টেকসই হয় এবং উপাদানগুলো বেশি মজবুত। সবকিছু মিলিয়েই প্রাকৃতিক তন্তুকে পেছনে ফেলে ক্রেতাদের মন জয় করে নিয়েছে ম্যান মেড ফাইবার। তাই আমরা যদি এমএমএফ ইন্ডাস্ট্রির দিকে এখনই নজর দিই, তা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের উপকারেই আসবে।
এর বাইরে আমরা অন্য বিকল্প শিল্পগুলোকে উৎসাহিত করতে পারি, যেগুলো এমএমএফ ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা বাড়িয়ে তুলবে এবং এটিকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করবে। এমএমএফকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে- এমন যেসব শিল্প বর্তমানে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আসবে, সেগুলো বিশ্ববাজারে সুবিধা পাবে সবচেয়ে বেশি।
এ রকমই একটি শিল্প হতে পারে খেলাধুলার সামগ্রী উৎপাদন। এই শিল্প বড় পরিসরে খেলাধুলার প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন- প্রশিক্ষণ সামগ্রী, ম্যাচের বল, খেলার পোশাক, মাঠের বাইরের পোশাক (পোলো শার্ট, ক্যাপ, জ্যাকেট ইত্যাদি), খেলার জুতা এবং আনুষঙ্গিক পণ্য (সানগ্লাস, ব্যাগ, পানির বোতল, প্রোটেক্টিভ গিয়ার ইত্যাদি) উৎপাদন করবে। এই ইন্ডাস্ট্রি মূলত এমএমএফকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে।
গত এক দশকে আমরা বাংলাদেশে খেলাধুলা খাতে ব্যাপক উন্নতি ও উদ্দীপনা দেখতে পেয়েছি। দেশে খেলা নিয়ে উৎসাহী ব্যক্তি এবং পেশাদার খেলোয়াড়ের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু খেলার সামগ্রী উৎপাদন শিল্প দেশের মূলধারায় পুরোপুরি যুক্ত হতে পারেনি এখনো। ২০১৭ সাল থেকে স্টার্ট-আপ বাংলাদেশের মাধ্যমে ১৭০টি স্টার্ট-আপ চালু হলেও তার মধ্যে মাত্র একটি ছিল খেলা সংক্রান্ত।
দেশে খেলার উপকরণের চাহিদা বাড়তে থাকায় ইতোমধ্যেই ফরাসি ব্র্যান্ড ডেকাথলন এবং জার্মান ব্র্যান্ড পুমার মতো কিছু বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের শাখা খুলে বসেছে। কিন্তু এই ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য উৎপাদন বাংলাদেশে হয় না। তাই এখানেই দেশীয় কোম্পানিগুলোর সুযোগ রয়েছে এই শিল্পে প্রবেশ করে নিজেদের বাজার বিস্তৃত করার।
দেশীয়ভাবেই খেলার সামগ্রী উৎপাদন শুরু করলে এখানে চাকরির সুযোগ তৈরি হবে এবং বৈদেশিক পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমবে। এছাড়াও এই খাতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় তা এমএমএফ-এর উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে। ফলে ছোট ছোট অনেক এমএমএফ প্ল্যান্ট জন্মাবে, যদিও প্রাথমিকভাবে এসব প্ল্যান্টের স্টার্ট-আপ মূল্য বেশি।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০০টি রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট রয়েছে, যার বেশিরভাগই ঢাকায় অবস্থিত। কিন্তু রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের তুলনায় এমএমএফ প্ল্যান্ট উৎপাদনের পরিমাণ খুবই কম।
বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্লাস্টিক ফ্লেক্স ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, অস্ট্রিয়া, ইউক্রেন, ফিলিপাইন, তাইওয়ান এবং কিছু ইউরোপীয় দেশে রপ্তানি করে থাকে। বর্তমানে ভারত এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশের প্লাস্টিক ফ্লেক্সের প্রধান ক্রেতা। এই দেশগুলো প্লাস্টিক ফ্লেক্স ব্যবহার করে অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে এবং বিশ্বজুড়ে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
অন্যদিকে, বিশ্ববাজার ধরে রাখতে আমাদের তৈরি পোশাক খাতে প্রতি বছর বিদেশ থেকে প্রচুর এমএমএফ আমদানি করা হয়। আমরা দেশেই এমএমএফ উৎপাদন করার বদলে এমএমএফ-এর মূল উপাদানগুলো রপ্তানি করে যাচ্ছি। এর মূল কারণ, স্টার্ট-আপে অত্যাধিক খরচ এবং দেশে এমএমএফ-এর কম চাহিদা।
শেষ করতে চাই এই বলে, দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে খেলাধুলার সামগ্রী ও আনুষঙ্গিক পণ্য বাজারজাত করতে শুরু করলে আমাদের ম্যান মেড ফাইবারের চাহিদা বাড়বে এবং তা দেশের এমএমএফ ইন্ডাস্ট্রিকে গতিশীল করতে সহায়ক হবে।
এই সূত্র ধরেই এমএমএফ ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়ন আমাদেরকে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নের দিকে ধাবিত করবে। তৈরি পোশাক শিল্পের শক্ত অবস্থান মানেই যে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের নিশ্চিত ভবিষ্যত, তা বলাই বাহুল্য।
- লেখকদ্বয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী
- মূল লেখা: Can sports merchandise manufacturing industry be our gamechanger?
- অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া