স্বাধীনতার মাসে ফিরে দেখা ভাবনা
পাকিস্তানের দুটি অংশ যে আর একসঙ্গে থাকবে না, থাকতে পারবে না, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়েই সেটা এক রকম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের আগাম হিসেব-নিকেশ উল্টে দিয়ে দেখা গেল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের দুটি বাদে সবকটি আসনেই জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। এমন একটি দল, পশ্চিম পাকিস্তানে যার সে-অর্থে কোনো অবস্থানই নেই। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের অল্পসংখ্যক আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলেও, তা ছিল প্রতীকী ধরনের। সে সব আসনে জয়ের ব্যাপারে দলটি আশাবাদী বা উদ্যোগী কোনোটাই ছিল না।
দলীয় প্রধান হিসেবে মুজিব এমনকি সেখানে প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারেও যাননি। উল্টোদিক থেকে দেশের পশ্চিম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী ভুট্টোর পিপল্স পার্টিও দেশের পূর্বাংশে কোনো আসন পায়নি। শুধু আসন পায়নি বললেও যথেষ্ট হবে না। নির্বাচনের সময় দু-চারটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ছাড়া দেশের এই অংশে দলটির বলতে গেলে কোনো তৎপরতাই ছিল না। একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়তো নয়। অর্থাৎ নির্বাচনে বিজয়ী প্রধান দুটো দলের একটি একান্তভাবে পূর্ব বাঙলার ও অন্যটি দেশের পশ্চিম অংশের বিশেষ করে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর প্রতিনিধিত্ব করছিল। দেশের অপর অংশের ওপর তাদের সামান্যও প্রভাব ছিল না। এ অবস্থায় কেন্দ্রে এককভাবে সরকার গঠন করে কারো পক্ষেই বেশিদিন দেশ পরিচালনা সম্ভব ছিল না। আর যদি বা দল দুটির মধ্যে এ ব্যাপারে সাময়িক সমঝোতা হতো, তা হতো স্রেফ কৌশলগত। আর অল্পদিনেই তা ভেঙে যেত। পাকিস্তানের বিশেষ ভৌগেলিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে, এর অন্যথা আশা করাই হতো মূর্খতা। কেন্দ্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকার গঠনের পর পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র হাত গুটিয়ে বসে থাকত, সরকারকে তাদের পরিকল্পনা মতো দেশ পরিচালনায় সহায়তা করত, এমন ভাবার কোনো কারণ ছিল না। অতীতেও কখনো তারা তা করেনি, পরবর্তীকালে, অর্থাৎ খণ্ডিত পাকিস্তানেও আজ অবধি নয়।
যে যা-ই বলুন, সত্যি কথাটা হলো, শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক গুরু ও নেতা সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আর কখনোই নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাননি। আগেও যে তেমন মাথা ঘামাতেন, তা-ও নয়। বরং তখনও তিনি মাঝে মাঝে হলেও যে ভিন্নরকম চিন্তা-ভাবনা করতেন, সোহরাওয়ার্দীর স্মৃতিকথা থেকেও সেটা জানা যায়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর মূলত মুজিবেরই আগ্রহে ও উদ্যোগে, অনেক সিনিয়র নেতার বিরোধিতা সত্ত্বেও, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করা হয়। এ পর্যায়ে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে সভাপতি করে আওয়ামী লীগের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলেও, তার কার্যকারিতা ছিল অল্পই। প্রতিষ্ঠার পর সোহরাওয়ার্দী বেঁচে থাকতে যেমন, তাঁর মৃত্যুর পরও আওয়ামী লীগ মূলত পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনৈতিক দলই থেকে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানে এর কমিটি থাকলেও, সেখানে দলের অস্তিত্ব ছিল যাকে বলে নামকা ওয়াস্তে।
১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলসমূহের সম্মেলনে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেছিলেন (তখন কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ)। সম্মেলনে উত্থাপনের জন্য মুজিব একটি ছয়দফা কর্মসূচি বা আসলে দাবিনামা নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত সেটা ছিল তাঁর একার কর্মসূচি। দলের ও দলের বাইরের কিছু ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি তো দূরের কথা, পূর্ব পাকিস্তান কমিটিরও অনুমোদন এর পেছনে ছিল না। মুজিব সে অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টাও করেননি। কারণ তাঁর আশঙ্কা ছিল দলের অনেক নেতাই এ ধরনের কর্মসূচি (যা অনেকটা বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতার কাছাকাছি) সমর্থন করবেন না। তাঁর অনুমান যে সঠিক ছিল, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তা প্রমাণিত হয়। যার পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও ছয়দফাপন্থী ও ছয়দফা বিরোধী দ্বন্দ্ব এবং তা থেকে ১৯৬৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। লাহোর সম্মেলনে মুজিব তাঁর ছয়দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করতে পারেননি। কারণ বিষয়নির্বাচনী কমিটিতে খোদ দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহসহ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ একযোগে সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে এর অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেন। উল্লেখ্য যে, লাহোরে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে কেবল তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোকেই ডাকা হয়েছিল। ন্যাপ ও এনডিএফ তাসখন্দ চুক্তিকে সমর্থন করায় এ দুটি দলকে সম্মেলনে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে মুজিবও কিন্তু তাসখন্দ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি ছিল ছয়দফা কর্মসূচি উপস্থাপনের জন্যই। তাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন ও ছয়দফার পক্ষে প্রচারাভিযানে নেমে পড়েন। পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। সুতরাং এখানে তাঁর পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মুজিব তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কোনো পর্যায়েই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে সামান্যও বিশ্বাস করেননি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠককালেও মুজিব ২২ তারিখ ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট হাউসের বারান্দায় টেনে নিয়ে একান্তে বলেছিলেন, ভুট্টো যেন আর্মিকে বিশ্বাস না করেন। কারণ তারা আগে মুজিবকে শেষ করতে পারলে, তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হবেন ভুট্টো। ভুট্টো নিজেই পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় এ তথ্য দিয়েছেন। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবের বৈঠকের শেষ পর্যায়ে তাঁদের ও তাঁদের উপদেষ্টাদের আলোচনা এসে ঠেকেছিল দেশের দুই অংশে প্রাদেশিক সরকারগুলোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ও তাঁর পরিকল্পনা বিষয়ে। মুজিবের কাছেও তখন কেন্দ্রে সরকার গঠনের সম্ভাবনাটি দূর পরাহত বলে মনে হয়েছিল। কাজেই মুজিব ওই সময়টিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্নে বিভোর থেকে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন বা তাকে উপেক্ষা করেছিলেন, এমন ভাবাটা হবে ইতিহাসের ভুল পাঠ গ্রহণ।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচনের জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব তাঁর দিকে থেকে একে পূর্ব বাঙলার জন্য ছয়দফার পক্ষে গণভোটে পরিণত করেন। পাকিস্তান আন্দোলনকালে জিন্নাহ বলেছিলেন, তিনি যদি কোনো লাইট পোস্টকেও ভোট দিতে বলেন, তবে পাকিস্তান আদায়ের স্বার্থে সেই তাকেই ভোট দিতে হবে। একই ভাবে ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে মুজিবও বলেছিলেন, তিনি যদি কোনো কলা গাছকেও মনোনয়ন দেন, ছয়-দফা বাস্তবায়নের জন্য তাকেই ভোট দিতে হবে। হয়েছিলও তাই। অন্যান্য দলের অনেক যোগ্য, সৎ, ত্যাগী ও সুপরিচিত প্রার্থীও ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো 'কলাগাছে'র কাছে জামানত হারিয়েছিলেন। শুধু যে মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের মতো তথাকথিত শক্তিশালী কেন্দ্রের সমর্থক বা পূর্ব বাঙলার স্বাধিকার সংগ্রামের বিরোধী দলগুলোই (তখন যারা 'ইসলাম-পছন্দ্' বলে পরিচিত ছিল) পরাজিত হয়েছিল, তা নয়। ন্যাপ (ওয়ালি-মোজাফ্ফর) অনেকগুলো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও, প্রাদেশিক পরিষদের একটি (সুনামগঞ্জ থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) ছাড়া সকল আসনে পরাজিত হয়। ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও, এই দলেরও কেউ কেউ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে একই রকম ভাগ্য বরণ করেছিলেন। কারণ পূর্ব বাঙলার অধিকার আদায়ের ব্যাপারে জনগণ তাঁদের ওপর ভরসা করতে পারেনি।
একথা ঠিক, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় জুড়ে মুজিব পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে থেকেই পূর্ব বাঙলার যথাসম্ভব স্বাতন্ত্র্য রক্ষা ও স্বাধিকার আদায়ের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। বরাবরই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের একমাত্র যদি না-ও হয়, প্রধান লক্ষ্য ছিল সেটাই। ১৯৫০ দশক থেকে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা এবং পরিষদে ও পরিষদের বাইরে সকল বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে এটাই প্রতিভাত হয়। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে তিনি বিভিন্ন সময় পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাঁর পক্ষে প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, সে ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালিরা রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রাধান্য লাভ করবে ও ফলে তাদের অধিকার অর্জনের পথ প্রশস্ত হবে। মুজিব বিপ্লবী বা বামপন্থী ছিলেন না। প্রচলিত গণতান্ত্রিক বা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অনুসারী হিসেবে তাঁর পক্ষে এভাবে ভাবাটাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক ছিল। তারপরও আইয়ুবের ক্ষমতা দখলের পর, পাকিস্তানে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পূর্ব বাঙলার অধিকার আদায়ের সম্ভাবনা যখন প্রায় তিরোহিত, তখন মুজিব হয়তো অনন্যোপায় হয়েই সশস্ত্র উপায়ে পূর্ব বাঙলাকে স্বাধীন করার একটি ক্ষণস্থায়ী প্রচেষ্টার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। এ উদ্যোগে প্রতিবেশী ভারত সরকারের সাহায্য পেতে তিনি এমনকি গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতেও গিয়েছিলেন।
১৯৬০ দশকের গোড়ায় তাঁর কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলায় পৌছানোর তথ্যটি নানা সূত্রেই পরবর্তীকালে সমর্থিত হয়েছে। তবে এ উদ্যোগটিও ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব, এর সঙ্গে তাঁর দলের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এমনকি তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীরাও বোধহয় কেউ এ সম্পর্কে জানতেন না। দলবহির্ভূত কারো কারো সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁর যোগাযোগ ঘটেছিল। তা ছাড়া তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দী তখনও জীবিত, যিনি একবার কোনো প্রসঙ্গে বলেছিলেন, পিআইএকে বাদ দিলে তিনিই হলেন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে নানা চ্যানেলে এ ধরনের যোগাযোগ প্রক্রিয়া মুজিব পরবর্তী সময়েও কমবেশি চালু রেখেছিলেন। তবে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী বা সুপরিকল্পিত উদ্যোগের অংশ এগুলোকে বলা যাবে না। অন্তত তা বলতে পারার মতো পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ বা সাক্ষ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তো আগরতলায় তাঁর সেবারের অভিযানটি ব্যর্থ হয়েছিল। দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও, নেহরু সরকার সে সময় তাঁদেরকে তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করতে রাজি হয়নি। ফলে হতাশ হয়েই মুজিব দেশে ফিরে আসেন। মাঝখানে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে তাঁকে কিছু সময় বা কয়েকদিন আটক থাকতেও হয়েছিল প্রচণ্ড জ্বর গায়ে নিয়ে ভোররাতে ঢাকার বাসায় ফিরবার পরদিন সকালেই পাকিস্তানি পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। সেবারের সেই বিরূপ বা হতাশাজনক অভিজ্ঞতাও সম্ভবত একটা কারণ যে-জন্য ইয়হিয়ার সঙ্গে আলোচনা ভেঙে যাওয়া ও পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর, তাজউদ্দীন প্রমুখের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও, তিনি বাড়ি থেকে বেরুতে ও অনির্দিষ্ট যাত্রায় তাঁদের সঙ্গী হতে রাজি হননি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে মুজিব সেদিন কোথায় যেতেন? তাঁর পক্ষে বাংলাদেশের ভেতরে কোথাও আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব ছিল কি? তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞতায়ও আত্মগোপনের ব্যাপারটি তো ছিল না কখনো। যাঁদের ছিল সেই কমিউনিস্ট বা বামপন্থিরাও তো অধিকাংশই আগে-পরে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীকেও ভারতেই যেতে হয়েছিল। তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীই কি মুজিবকে বাড়ি থেকে বেরুবার সুযোগ দিত? যে-বাহিনী অনেক আগে থেকেই তলে তলে তাদের অভিযান প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছিল, অন্তত বৈঠকের শেষ পর্যায় থেকে তিনি কি তাদের গোপন ও সার্বক্ষণিক নজরদারিতে ছিলেন না? মুজিব কি তা জানতেন না কিংবা তাঁর পক্ষে সেটা অনুমান করা কি কঠিন ছিল? অন্যান্য বারের মতোই তিনি যে বাড়িতে বসে গ্রেপ্তারের অপেক্ষা করছিলেন, তার পক্ষে তিনি পরে একটা যুক্তি দিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন, তাঁকে না পেলে পাকিস্তানি বাহিনী হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজে বেড়াবে, আর তা করতে গিয়ে সমস্ত ঢাকা শহরের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাবে।
তাঁকে গ্রেপ্তার করার পরও পাকিস্তানি বাহিনী কিন্তু সেই কাজটাই দেশ জুড়ে করেছিল। এক্ষেত্রে মুজিবের অনুমান নিশ্চয় ভুল ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী আসলে তাদের সামরিক অভিযান পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই দেশব্যাপী এই নির্বিচার হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। ত্রাস সৃষ্টি করে বিদ্রোহী বাঙলাকে নতি স্বীকার করানোই ছিল তাদের সে পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। মুজিব তাদের সে পরিকল্পনার কথা জানতেন না, এমন কি অনুমানও করতে পারেননি। নেতা হিসেবে এটা হয়তো তাঁর ব্যর্থতা। যেহেতু সমগ্র জাতি সেদিন নেতৃত্ব বা নির্দেশের জন্য একমাত্র তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক অভিযান যে এতটা ব্যাপক ও বর্বর রূপ নিতে পারে, দেশের ভেতরে বা বাইরে আর কেউ কি তা অনুমান করতে পেরেছিলেন? আমাদের বামপন্থি দলগুলোরও কি এ ব্যাপারে কোনো পূর্ব ধারণা বা প্রস্তুতি ছিল? ২৫ মার্চের পর মুজিব ভারতে আশ্রয় নিয়ে যদি সেখান থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতেন, তবে তাতে যুদ্ধকালীন অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা -- বিরোধ, বিভ্রান্তি, বিতর্ক হয়তো এড়ানো যেত। কিন্তু উল্টোদিকে অন্য অনেক বিভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতারও কি তা জন্ম দিত না? যুদ্ধকালীন, এমনকি পরবর্তী সময়ের জন্যও? দুটি বড় ঘটনার কথা বলি। পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়ার পর লন্ডন হয়ে স্বদেশ ফেরার পথে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারেই মুজিব তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে অবস্থানকানী ভারতীয় সেনাদের কবে ফিরিয়ে নেয়া হবে। কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে বসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিলে এমনকি মুজিবের মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষেও কি তা বলা সম্ভব বা সহজ হত? ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার আগে মুজিব ভারত সরকার বা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরামর্শ তো দূরের কথা, তাঁদেরকে সে বিষয়ে অবহিত করাও প্রয়োজনীয় মনে করেননি। হ্যাঁ, সেদিন মুজিব কী ভেবে কী করেছিলেন, তা নিয়ে আজ আমরা কেবল অনুমান বা জল্পনা-কল্পন্ইা করতে পারি। তবে ভারত সরকার বা সেখানকার প্রভাবশালী মহলের অনেকেই যে মুজিবের এ ধরনের স্বাধীনচেতা আচরণগুলোকে ভালো চোখে দেখেনন নি, পরবর্তীকালে তাঁদের লেখা বইপত্র থেকেও আমরা আজ সেটা জানতে পারি।
নির্বাচনে ছয়-দফার পক্ষে গণরায় পাওয়ার পর, শেখ মুজিবের পক্ষেও তা থেকে পিছু ফিরে দাঁড়াবার কোনো উপায় ছিল না। আর খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়েও, যদি ছয়-দফার মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, তবে তার দ্বারা পূর্ব বাঙলা স্বশাসনের যে অধিকারটুকু লাভ করবে, তা ঠিক স্বাধীনতা না হলেও, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিশেষ ভৌগোলিক বাস্তবতায়, তার সঙ্গে স্বাধীনতার দূরত্বও বেশি থাকে না। এ কথা মুজিব যেমন জানতেন, পাকিস্তানি শাসকরা, সেখানকার সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও পুঁজিপতি গোষ্ঠীও জানত। তাদের দিক থেকেও তারা এ ব্যাপারে কোনোরকম আপোস করতে রাজি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরই তারা নিজেদের মধ্যে এ ব্যাপারে একটা ঐকমত্যে পৌঁছে যায়। ইয়াহিয়া-ভুট্টো তাদের হয়েই আসলে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। ভুট্টোর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উসকে দিয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাবি প্রভাবিত ক্ষমতাচক্র আসলে তাদের স্বার্থরক্ষার ষড়যন্ত্রেই মেতে উঠেছিল। ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার আয়োজন ছিল সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সাময়িক ক্যামোফ্লেজ মাত্র। এরপর যে বেপরোয়া খেলায় তারা মেতে উঠবে, তার প্রস্তুতির জন্য খানিকটা সময় নেয়া। কিন্তু এটা আজ আমাদের কাছে যতটা পরিষ্কার, সেদিন মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কিংবা অন্য কারো কাছে ততটা পরিষ্কার ছিল কি? একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার কথা সেদিন অনেকেই বলেছিলেন। এমনকি পল্টনে জনসভা করে শাহ আজিজ, দুদু মিয়া ও এস এম সোলায়মানের মতো নেতারাও। ২৫ মার্চের ক্রাক-ডাউনের পর যাঁদের অনেকে প্রথম সুযোগেই পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। অন্য যাঁরাও 'স্বাধীন পূর্ব বাঙলা' প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, আপোসের চোরাবালিতে পা ডোবানোর বিরুদ্ধে মুজিবকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, তাঁদেরই বা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কতটা প্রস্তুতি ছিল? এ ব্যাপারে তেমন কোনো সক্রিয়তা কি তাঁরাও দেখাতে পেরেছেন? পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মুখে তাঁরাও কি বাকি দেশবাসীর মতো একই রকম দিশেহারা ও অসহায় বোধ করেননি? জীবনরক্ষা ও আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করেননি? তাঁদেরও অনেকেই কি শেষ পর্যন্ত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেননি?
৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় মুজিব, তিনি যদি 'হুকুম দিতে নাও' পারেন, তবু 'যার যা আছে' তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটা কি আপোসের ভাষা ছিল? তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। এখানে 'মুক্তি' কথাটার নানা রকম দ্যোতনা থাকতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রায় সাড়ে চার দশক পরও, সে-অর্থে মুক্তি হয়তো আমরা এখনও লাভ করিনি। কিন্তু অন্তত 'স্বাধীনতা' কথাটাকে তার ভৌগোলিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য থেকে বিযুক্ত করে দেখা যায় কি? আরও বিশেষ করে যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা তাঁর জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে সে কথা বলেন? পাকিস্তানি শাসকরা কি সেই বিশেষ অর্থেই কথাটাকে গ্রহণ করেনি? মুজিবের বিরুদ্ধে আনা দেশদ্রোহিতা বা পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র ও উস্কানির অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করতে তাঁর ওই ৭ মার্চের ভাষণটিকেই কি তারা অকাট্য প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেনি? নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অনুসারী তিনি, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে, যদি সেদিন কৌশলগত কারণে 'জয় পাকিস্তান' বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেনও, তার আগে তো তিনি নিশ্চয় 'জয় বাংলা' কথাটিও উচ্চারণ করেছিলেন? মুজিব না হয়ে সেদিন যদি স্বয়ং বিধাতা পুরুষও রেসকোর্সের ওই মঞ্চে এসে দাঁড়াতেন, তাঁর পক্ষেও 'জয় বাংলা' কথাটা বাদ দিয়ে শুধু 'জয় পাকিস্তান' বলা সম্ভব ছিল কি? কাজেই যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি বা বিভ্রান্তি ছড়াতে চান, তাঁদের সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো।
একইভাবে বদরুদ্দীন উমরের মতো যেসব বাম তাত্ত্বিক মনে করেন, ৭ মার্চের সেই জনসভা থেকেই শেখ মুজিবের উচিত ছিল হাজার হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও বা আক্রমণ করা, তা করা হলে সেদিনই নাকি পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটত, দেশ এক লহমায় স্বাধীন হয়ে যেত, তাঁদের কল্পনাশক্তির প্রশংসাতেই বড়জোর আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। তারপরও কথা হলো, একজন বুর্জোয়া ধারার রাজনীতিকের কাছে তাঁরা তেমন ভূমিকা আশা করবেন কেন? এ কি অনেকটা সেই আমগাছের কাছে কাঁঠাল চাওয়ার মতো ব্যাপার নয়? আর মুজিব তো ঘোষিতভাবেই ঘেরাওয়ের রাজনীতির বিরোধী ছিলেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের শেষদিকে মওলানা ভাসানীর আহ্বানে তৎকালীন পূর্ব বাঙলায় যখন ঘেরাও ও 'জ্বালাও-পোড়াও' আন্দোলন শুরু হয়, তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্যমুক্ত মুজিব প্রকাশ্যে তার নিন্দা করেছিলেন। মুজিব না হয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে সংগ্রামের পথ থেকে পিছিয়ে গেলেন। কিন্তু অন্যরা, যেমন মওলানা ভাসানী, তো ছিলেন! ২৫ মার্চের আগে বা তারপর, এপ্রিলের প্রথমদিকে, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় নিরস্ত্র জনতার ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও বা তার চেষ্টার পরিণতি কী হয়েছিল?
পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মুজিব নিজে কোনো মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে সশস্ত্র প্রতিরোধের আহ্বান দিয়ে যেতে পেরেছিলেন কিনা, কিংবা তাঁর হয়ে আর কেউ তেমন একটি বার্তা প্রচার করেছিলেন, সে সম্পর্কে নিঃসংশয় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সুযোগ বোধহয় আজ আর আমাদের নেই। এ ব্যাপারে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে আমরা কেবল বিভ্রান্তিই বাড়িয়ে তুলতে পারি। তবে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে যে ইঙ্গিতটুকু ছিল, তাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে, এমনকি ২৫ মার্চের আগেও, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবকরাসহ সাধারণ জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা যে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অল্পাধিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, এ তো ঐতিহাসিক সত্য। বঙ্গবন্ধুর সায় নেই জানলে তারা কি এটা করত? সুতরাং জিয়াউর রহ্মান 'বিচিত্রা'র বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর একটি লেখায় ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে যে 'গ্রীন সিগনাল' কথাটি ব্যবহার করেছিলেন, তার যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের সুযোগ কম।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তখনকার মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজ নামে, এবং পরে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে বা অন্য কেউ তা ধরিয়ে দেওয়ার পর, দ্বিতীয়বার শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। আগের দিন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নানও চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে অনুরূপ ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। তবে তাঁর সেই ঘোষণাটি নানা কারণে বেশি মানুষ শুনতে পায়নি। সেই তুলনায় জিয়ার ঘোষণাটি চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বাইরে অনেক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। অন্য একটি কারণেও ভাষণটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার মুখে এই ভাষণটি শুনেই দেশবাসী প্রথম জানতে পারে যে, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, আর এ লড়াইয়ে তারা আছে আমাদের পাশে। অর্থাৎ আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম ইতিমধ্যে তার সশস্ত্র পর্বে প্রবেশ করেছে। সেদিন সেই দিশাহারা সময়ে এই জানা, উপলব্ধিটুকুর গুরুত্ব ছিল দল-মত নির্বিশেষে দেশবাসীর কাছে অনেক। জিয়ার স্বকণ্ঠ ঘোষণা হয়তো দেশের অনেক অঞ্চলের মানুষই শুনতে পায়নি। কিন্তু খবর হয়ে এটিই সমগ্র দেশবাসীর রক্তে শিহরণ জাগিয়েছিল, তাদেরকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। জিয়ার এই ঘোষণার গুরুত্ব বা তাৎপর্যের কথা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদও তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশেষ প্রেক্ষাপটে মুজিব ও জিয়াসহ সকলের ভূমিকা বা স্থান ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট। তাঁদের রাজনীতি বা আগেপরের ভূমিকা দিয়ে তাঁকে ম্লান বা নাকচ করা যাবে না। বেতারে ঘোষণা পাঠকারী বা অনুষ্ঠান ঘোষকেেক যদি আমরা 'ঘোষক' বলতে পারি, তবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী জিয়াকে 'স্বাধীনতার ঘোষক' বলাতে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? কিংবা তাতে কার গৌরবকে ক্ষুণ্ণ করা হয়? সত্যিই বোঝা মুশকিল।
জিয়া কি কোনোভাবেই মুজিব বা ভাসানীর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন? আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শীর্ষ নেতা, মূল প্রেরণা বা প্রতীক হিসেবে মুজিবের ভূমিকাকে জিয়া নিজে তো কখনোই অস্বীকারের চেষ্টা করেননি। এমনকি তিনি যখন ক্ষমতায়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বা তাদের রাজনীতির সমালোচনা করলেও, কখনো কোনো প্রসঙ্গে ঘুণাক্ষরেও শেখ মুজিব সম্পর্কে সামান্যও কটুক্তি করেননি। বর্তমানের অনেক মুজিবভক্ত সে সময় প্রায়শ যা করতেন। মুজিবও তাঁর দিক থেকে জিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অবদানকে অবমূল্যায়ন করতে চেয়েছিলেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তাতে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ, চুলোচুলি ও চরিত্র হননের এই পালা শুরু হয়েছে যখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেকেই দৃশ্যপট থেকে অন্তর্হিত হয়েছেন, তারপর। অর্থাৎ যখন সাক্ষী দেওয়ার আর বিশেষ কেউ নেই। আর আমাদের উভয় তরফের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কিছু মানুষ, কিছু ইতিহাসবোধহীন রাজনীতিকের সঙ্গে যোগসাজশে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে এই বিতর্ককে ক্রমাগত উস্কে চলেছেন, ভবিষ্যতেও জারি রাখতে চান। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে এঁদের বেশিরভাগেরই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত সহকারী হাজী গোলাম মোর্শেদ তাজউদ্দীন-কন্যা শারমিন আহমদকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সেই ১৯৫০-এর দশকেই সোহরাওয়ার্দী তাঁকে একটি কথা বলেছিলেন : 'এমন একটা সময় আসে যখন সবাই স্ট্রিট লেবারার টু টপ অব দ্য কান্ট্রি একই সময়ে একই কথা ভাবে, একই চিন্তা করে, রেডিও ওয়েভ লেংথের মতো, তখনই দেশ মুক্ত হয়।' (তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা, পৃ.২৮৯) আমাদের জাতির জীবনে ১৯৭১ তেমনি এক মহালগ্ন হয়ে এসেছিল। যখন অল্পকিছু ব্যতিক্রম বাদে দেশের আপমর মানুষ স্বপ্নে-বেদনায়, সংগ্রামে-আকাক্সক্ষায় এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। কোনো জাতির জীবনেই তেমন সময় বারবার আসে না। পুরনো স্বপ্নের কালটা এক সময় কেটে যায়। রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় জাতিকে। আরেক স্বপ্নের দিকে শুরু হয় তার নতুন অভিযাত্রা। আর সে অভিযাত্রায় ইতিহাস তার কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে আসে, বিবাদ-বিসংবাদের বিষয় হয়ে নয়।
(মার্চ ২০১৫)
মোরশেদ শফিউল হাসান গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক