যে নারীর উদ্যোগে লক্ষাধিক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শুনেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
চট্টগ্রামে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে কাজ করছেন চট্টগ্রামের এক নারী। ১ যুগ ধরে চট্টগ্রাম শহর এবং বিভিন্ন উপজেলার কওমি ও অন্যান্য মাদ্রাসায় আয়োজন করছেন 'জঙ্গিবাদ বিরোধী আলেম ওলামা শিক্ষার্থী সমাবেশ'।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং জয় বাংলা স্লোগানসহ সমবেত জাতীয় সংগীত পরিবেশনায় অংশ নেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে নেওয়া হয় দেশবিরোধী সহিংসতা কিংবা উগ্রবাদে না জড়ানোর শপথ।
চট্টগ্রামের তরুণ সংগঠক জিনাত সোহানা চৌধুরী এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। মোবাইলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে হরদম হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তারপরও দমে যাননি তিনি। অদম্য সাহস আর কিছু সৃষ্টিশীল মানুষদের সহযোগিতায় এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছেন জিনাত সোহানা।
করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও থেমে নেই তার কর্মসূচী। ডিজিটাল প্লাটফর্মে আয়োজন করছেন জঙ্গিবাদ বিরোধী আলেম ওলামা শিক্ষার্থী কনফারেন্স। সর্বশেষ গত ৩ মার্চ তার সঞ্চালনায় আয়োজিত এই কর্মসূচীতে অংশ নেন দেশের প্রখ্যাত আলেমসহ সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।
জিনাত সোহানার মানবিক কর্মযজ্ঞ বিস্তৃত হয়েছে করোনাকালের কঠিন সময়েও। চট্টগ্রামে কিছু স্বপ্নবাজ তরুণদের সঙ্গে নিয়ে ১০ দিনের মাথায় গড়ে তোলেন ১০০ শয্যার করোনা আইসোলেশন সেন্টার। করোনার কঠিন দুঃসময়ে ৮০০ করোনা আক্রান্ত রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে এই সেন্টার।
জিনাত সোহানা জানান, চট্টগ্রাম নগর এবং উপজেলায় শতাধিক কওমি ও অন্যান্য মাদ্রসার প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী শুনেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। যেখানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনে ছিল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা, সেখানে শিক্ষার্থীদের সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় জাতীয় সংগীত, জয় বাংলা স্লোগান। এতে অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, দেশের প্রখ্যাত আলেম ওলামা এবং জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
তিনি বলেন, 'মাদ্রাসার বৃহৎসংখ্যক শিক্ষার্থী এই দেশেরই উন্নয়ন অগ্রগতির অংশীদার। তারা যদি মূলধারায় যুক্ত হন, বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে যাবে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ধর্মীয়, নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তির শিক্ষায় শিক্ষিত হলে দেশের উন্নয়নে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সমান্তরালে নিজেদের অবস্থান গড়ে নিতে পারবেন। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা- যারা অজ্ঞতা, কুসংস্কারবোধ ধর্মীয় গোঁড়ামির জালে আবদ্ধ আমরা তাদের আলোর পথ দেখাতে চাই।'
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, 'দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চর্চা হয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত করে একটি গোষ্ঠী। পবিত্র ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করার অপচেষ্টা রুখে দেওয়া এই কর্মসূচীর প্রধান লক্ষ। চট্টগ্রাম বিভাগে শুধুমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে এই কর্মসূচী পালন করা হলেও পরবর্তীকালে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু করা হবে।'
চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, 'বছরের পর বছর একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত করেছে। জিনাত সোহানার প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম জেলার মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ সৃষ্টির সঠিক ইতিহাস জানতে পারছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তার এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই।'
এই কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, কুসংস্কার, মাদক ও জঙ্গিবাদমুক্ত সমাজ গঠনে এই উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত হবে।
চট্টগ্রাম নগরীর জামেয়া আমহদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার আরবি বিভাগের প্রভাষক মোঃ জামাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এই মাদ্রাসায় ৬ বার জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাদ্রাসায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেছেন। মাদকসহ সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে প্রতিটি কর্মসূচীতে। এ ধরনের উদ্যোগের কারণে শিক্ষার্থীরা নৈতিক শিক্ষা লাভ করেছেন।'
বায়তুশ শরফ মাদ্রাসার আলীম দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিরাজ মাহমুদ বলেন, 'মাদ্রাসায় আগে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হতো না। জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মসূচীর কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারছি।'
কেন নিজেকে এই কর্মসূচীতে যুক্ত হলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জিনাত সোহানা বলেন, "দেশের প্রধামন্ত্রী ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দেন দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করার। একজন নারী হিসেবে দেশকে জঙ্গিবাদমুক্ত করার ঘোষণা আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগের সারথী হতে 'সুচিন্ত বাংলাদেশ'-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাতের নির্দেশনায় নিরন্তর কাজ করে চলেছি।"
'সুচিন্তা বাংলাদেশ' চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়কারী জিনাত সোহানা আরও বলেন, 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার সুতিকাগার। শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী যেন যৌন হয়রানির শিকার না হয়, তা নিয়ে সকলকে কাজ করতে হবে।' ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি বলৎকারের শাস্তিও যেন মৃত্যুদণ্ড করা হয়, সেই দাবি জানান এই নারী নেত্রী।
চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম নেওয়া জিনাত সোহানা বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। তার বড় বোন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী।
সোহানা বলেন, 'সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। নারীদের কাজ করার কর্মপরিবেশ তৈরি হয়েছে। নারীকে নারী হিসেবে না দেখে তাদের যদি মানুষ হিসেবে দেখে, তাহলে কাজ করা সহজ হবে।'
সোহানা চট্টগ্রাম আদালতে অতিরিক্তি পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেক্সুয়াল হেরেসমেন্ট কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। টানা তৃতীয়বারের মতো যুক্ত আছেন বেসরকারি কারা পরিদর্শক হিসেবে।