‘স্থানীয় ব্যাটারি শিল্পের জন্য প্রয়োজন সুষম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র’
অল্প বয়সে বাবা-মা দু'জনকেই হারিয়েছিলেন আবদুর রহিম। শৈশবের আদর-স্নেহ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোনোটাই তার ভাগ্যে জুটেনি। পরিশ্রমী এবং স্ব-প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসেবে তিনি বড় হয়েছেন। বিভিন্ন ব্যবসায় জড়ানোর পর, ১৯৫৪ সালে তার প্রথম প্রতিষ্ঠানটি আলোর মুখ দেখে।
আবদুর রহিমের প্রতিষ্ঠিত রহিমআফরোজ অ্যান্ড কোং বর্তমানে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বৃহৎ এক গ্রুপে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের ৭০ টি দেশে ব্যাটারি রপ্তানির জন্য ব্র্যান্ড পরিচিতি লাভ করেছে তারা।
ব্যাটারির কারণে রহিম-আফরোজ সুনাম অর্জন করলেও বর্তমানে তাদের অধীনে আটটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অংশীদার ভিত্তিক ব্যবসা এবং অলাভজনক সামাজিক সংস্থা আছে। মূল প্রতিষ্ঠানটির অধীনে বর্তমানে সাড়ে তিন হাজারের অধিক কর্মচারী কাজ করছে। এছাড়া, আরও ৫০ হাজার মানুষ পরোক্ষভাবে প্রতিষ্ঠানটির সাথে সরবরাহকারী, ঠিকাদার, ডিলার এবং খুচরা ব্যবসায়ী হিসেবে যুক্ত আছেন।
সাত দশকের কার্যক্রমে রহিম আফরোজের মালিকানা বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্মের কাঁধে গিয়ে পৌঁছেছে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্প্রতি রহিম-আফরোজ স্টোরেজ পাওয়ার ব্যবসার তরুণ নির্বাহী পরিচালক ফারাজ এ রহিমের সঙ্গে কথা বলে। স্থানীয় ব্যাটারি শিল্প সম্পর্কে ফারাজ তার চিন্তা-ভাবনার কথা তুলে ধরেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস): আমাদের ব্যাটারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পরিস্থিতি কী? ডজনখানেক দেশে ব্যাটারি রপ্তানির পরেও, আমরা কি স্থানীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছি?
ফারাজ এ রহিম: আগে ব্যাটারির বাজার ছিল ছোট। মূলত, অটোমোটিভ ব্যাটারি, আইপিএস এবং কিছু ঘরোয়া সোলার ব্যবস্থাই ব্যাটারির বাজারে প্রতিনিধিত্ব করত। স্থানীয় ব্যাটারি প্রস্তুতকারকরা এসব ক্ষেত্রে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছেন। আমরা টেলিকমিউনিকেশন, রেলওয়ে, ফোর্কলিফট, গলফ কার্ট ইত্যাদির জন্যও ব্যাটারি নির্মাণ ও সরবরাহ করে থাকি। লিথিয়াম-ব্যাটারি ছাড়া, সামান্য সংখ্যক লেড বা সীসা নির্ভর ব্যাটারি আমদানি করা হয়ে থাকে। বাকি সব ব্যাটারি স্থানীয় ভাবেই উৎপাদিত হয়।
বর্তমানে ব্যাটারির বাজারের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। সময়ের সাথে, বাজারে পরিবর্তন এসেছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যাটারির চাহিদা ইজি বাইক এবং ইলেকট্রিক রিকশা কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এই খাতটি বিশদভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। অন্যান্য ব্যাটারির চাহিদাও বেড়েছে, তবে ইভি ব্যাটারির বাজারে আমরা উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধি দেখেছি। তবে, এই ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ ঘটেছে বাংলাদেশে অবস্থিত চীনা মালিকানাধীন কারখানাগুলোর হাত ধরে।
টিবিএস: এমন কেন হল? আমাদের স্থানীয় উৎপাদনকারীরা কেন বাজার দখল করতে পারল না?
ফারাজ: কিছু চীনা মালিক পরিবেশগত অনুমোদন এবং অন্যান্য বাধ্যবাধকতার তোয়াক্কা না করেই ছাতার মতো এখানে সেখানে কল-কারখানা স্থাপন করে চলেছে। এমনকি তারা ভ্যাটও প্রদান করছে না। ব্যাটারি উৎপাদকদের সংগঠন অ্যাকুমুলেটরস ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এবিএমইএবি) তাদের সংগঠনে যোগদান ও বৈধ উপায়ে কার্যক্রম পরিচালনার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সহযোগিতায় তারা ভিন্ন উপায়ে কার্যক্রম পরিচালনার পথ খুঁজে নেয়।
চীনা ব্যাটারি আমদানির মধ্য দিয়ে এই অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা প্লেট আমদানিও শুরু করে। পরিশেষে, পুরো ব্যাটারি নির্মাণেই মনোনিবেশ করে তারা।
স্থানীয় ব্যাটারি উৎপাদনকারীদের চাপে পড়ে পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) এবং অন্যান্য সংস্থা মাঝেমধ্যে অবৈধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। তবে, তারা আবার ভিন্ন নামে, ভিন্ন জায়গায় কার্যক্রম শুরু করে।
ইভি ব্যাটারির ৭০ শতাংশই দেশের চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি। স্থানীয় উৎপাদনকারীরা এ ধরনের ব্যাটারি উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও, তারা বাজার ধরতে পারছে না। কেননা, চীনা অবৈধ কারখানাগুলোর উৎপাদন খরচ বেশ কম। তাদের কোনও বায়ু পরিশোধন প্ল্যান্ট (এটিপি) এবং বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (ইটিপি) নেই। এছাড়া তাদের ভ্যাট প্রদান করতে হয় না।
আমরা আরও শুনেছি যে, লেড-ক্যালসিয়ামের বদলে বহু চীনা প্রস্তুতকারী ব্যাটারিতে লেড-ক্যাডমিয়াম ব্যবহার করে থাকেন। উৎপাদন খরচ কমলেও এ ধরনের ব্যাটারি থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তবে, এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা ইভি ব্যাটারি উৎপাদন করে চলেছি। কিন্তু বাজারে আমাদের অবস্থান দুর্বলই থাকছে। আর তাই সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সরকারের কাছে ভ্যাট কমিয়ে শূণ্য থেকে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব রেখেছি। অবৈধ চীনা প্রস্তুতকারকদের সাথে সুষম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরিতে তা সাহায্য করবে।
টিবিএস: দেশে প্রায় দশ লাখ ইলেকট্রিক তিন চাকার পরিবহন আছে। উচ্চ ধারণ ক্ষমতা ও দীর্ঘসময় চার্জ থাকায় বিশ্বব্যাপী হালকা ভারের লিথিয়াম ব্যাটারি জনপ্রিয়। তাহলে আমরা কেন এখনও সীসা-নির্ভর ব্যাটারি ব্যবহার করছি?
ফারাজ: এখানে দুইটি প্রধান কারণ আছে। প্রথম কারণটি হল লিথিয়াম ব্যাটারির উচ্চ আপফ্রন্ট খরচ। দ্বিতীয়ত, সীসা-এসিড ব্যাটারির স্ক্র্যাপ বা ভাঙারি মূল্য আছে। অন্যদিকে, লিথিয়াম ব্যাটারির পুনর্ব্যবহার বেশ কঠিন। বিশ্বে মাত্র হাতেগোণা কয়েকটি রিসাইকেল কারখানা আছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনও ব্যবস্থা নেই।
এছাড়া আরও কয়েকটি কারণ আছে। লিথিয়াম ব্যাটারির চার্জার বেশ দামি। তাছাড়া, যানবাহনে ব্যবহৃত ব্যাটারির ওয়াটেজেও পার্থক্য আছে। ফলে, ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (বিএমএস) সাথে মিল রাখা বেশ কঠিন। মোট কথা, এতসব চ্যালেঞ্জ সামলে আমাদের বাজার এখনও লিথিয়াম ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রস্তুত হয়নি।
টিবিএস: রিসাইকেলিং এর কথা বললে, সীসা-এসিড ব্যাটারির রিসাইকেলিংও পরিবেশের জন্য উদ্বেগজনক। তাই নয় কি?
ফারাজ: আপনার কাছে কার্যকরী এটিপি এবং ইটিপি থাকলে, এবং এসিড ঠিকমতো প্রশমিত করতে পারলে উদ্বেগজনক নয়।
টিবিএস: রহিম আফরোজের তিনটি ব্যাটারি কারখানার দুইটি আমরা পরিদর্শন করেছি। সেখানে আমরা এটিপি এবং ইটিপির মাধ্যমে লেড পরিশোধন ব্যবস্থা দেখেছি। কিন্তু, অসংখ্য লেড কারখানা আছে যেখানে ধাতু বিগলনের কাজ চলে। সেখানকার পরিবেশগত নিরাপত্তা কিংবা কর্মীদের সুরক্ষার কী হবে?
ফারাজ: এটা সত্যিই বেশ উদ্বেগজনক। দেশে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদিত মাত্র তিন থেকে চারটি রিসাইকেল কারখানা আছে। বাকিগুলো অনুমোদনহীন। সংগঠনের তরফ থেকে, আমরা সরকারের কাছে গিয়েছিলাম। আমরা সংগঠিত ব্যবস্থাপনার অধীনে ব্যাটারি রিসাইকেল ব্যবস্থা আনার প্রস্তাব রেখেছি। আমরা সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার অধীনে স্ক্র্যাপ ব্যাটারি বা ব্যাটারি বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইকেল করতে পারি। সেক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে দৃঢ় নজরদারির প্রয়োজন। তা না হলে, আবারও যত্রতত্র অনুমোদনহীন কারখানা গড়ে উঠবে।
- সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে পড়ুন: 'We need a level playing field for local battery industry'