হেলিকপ্টারে গন্ডারকে উল্টো করে ঝুলিয়ে পরিবহন করা কেন প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলের উপর দিয়ে পা উল্টো করে বাঁধা অবস্থায় একটি গন্ডারকে হেলিকপ্টারের নিচে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দৃশ্যটা দেখতে আপনার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হলেও কালো গন্ডারদের জন্যে এটা মোটেও মজার বিষয় নয়, বরং এটি তাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন।
বেশিরভাগ সময়ই গন্ডারদের এক স্থান থেকে অন্যত্র ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কিছু দূরবর্তী অঞ্চলে স্থলপথে পৌঁছানো যায় না। অগত্যা প্রাণী সংরক্ষণবাদীরা সেসব জায়গায় প্রায়ই হেলিকপ্টারে করে উড়ে যান গন্ডারদের নিরাপদ পরিবেশে সরিয়ে নিতে। গন্ডারদের স্থানান্তরের দুটি পদ্ধতি রয়েছে, একটি হলো স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া, আর অন্যটি হলো গন্ডারকে উল্টো করে ঝুলিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া।
সংরক্ষণবাদীরা এই দ্বিতীয় উপায়টিই বেশি পছন্দ করেন; কারণ তাতে স্ট্রেচারে নেওয়ার চাইতে বেশি সহজ ও কম খরচ হয়। তবে এই উল্টো করে ঝুলানো গন্ডারদের উপর কেমন প্রভাব ফেলে- তা এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট জানা যায়নি।
আর এই অনুসন্ধানের জন্যই নামিবিয়ার সরকার কর্নেল কলেজ অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন দলকে দায়িত্ব দেয় একটি গবেষণা করতে। সেই গবেষণায় উঠে এসেছে এক বিস্ময়কর তথ্য। বিজ্ঞানীরা এই উল্টো ঝুলানো অবস্থানকে গন্ডারের জন্য অস্বস্তিকর মনে করে আসলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায় যে, এই অবস্থানটিই গন্ডারের স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশি সুবিধাজনক।
উল্টো ঝুলানোই 'সঠিক অবস্থান':
আফ্রিকার মোট কালো গন্ডারের তিন ভাগেরই আবাস নামিবিয়ায়। গন্ডারের দুটি প্রজাতির একটিকে এখানেই খুঁজে পাওয়া যায়।
২০১৫ সাল থেকে শুরু করে কর্নেলের গবেষক দল ১৭৭০ থেকে ২৭২০ পাউন্ড ওজনের ১২ টি ব্ল্যাক গন্ডারকে স্থানান্তর করেছে এই উল্টো অবস্থায় ক্রেনে ঝুলিয়ে।
গবেষকরা গন্ডারদের শ্বাসপ্রশ্বাস ও ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়া বোঝার জন্য বায়োমার্কার ব্যবহার করেন। তারা লক্ষ্য করেন যে, উল্টো ঝুলানো অবস্থায় গন্ডারদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বেশি থাকে।
ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন মেডিসিন- এর সিনিয়র লেকচারার রবিন রেডক্লিফ বলেন, উল্টো ঝুলানো অবস্থানে গন্ডারদের মেরুদন্ড প্রসারিত হয়ে বেশি বাতাস ঢোকার সুযোগ করে দেয়। আর পাশ ফিরে শোয়ানো অবস্থায় এদের 'ডেড স্পেস' এর সম্ভাবনা বেশি, অর্থাৎ প্রতি নিঃশ্বাসে যে বাতাস তারা ভেতরে নেয়- তা শরীরে অক্সিজেন দেয় না।
এই দুটি অঙ্গভঙ্গিমার মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্যই। কিন্তু উচ্চমাত্রার অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের ফলে গন্ডারের মধ্যে হাইপোক্সেমিয়া সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ তাদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। তাই সামান্য উন্নতিও গন্ডারের সার্বিক অবস্থার জন্যে কাজে দিতে পারে।
আকাশপথে গণ্ডার:
উল্টো করে ঝুলানো হোক কিংবা পাশ ফিরিয়ে শোয়ানোই হোক, আকাশপথে গণ্ডার স্থানান্তরের জন্যে অবশ্যই দুটি হেলিকপ্টার আপনার লাগবেই। একটি ছোট হেলিকপ্টার থেকে সিডাটিভ গন্ডারের শরীরে বিদ্ধ করতে হবে, আর অন্য একটি বড় হেলিকপ্টারে করে প্রাণীটিকে বয়ে নিতে হবে। শোয়ানো অবস্থায় যখন গন্ডারকে স্ট্রেচারে তোলা হয় তখন স্ট্রেচারসহ ওজন অনেক বেড়ে যায় এবং এই প্রক্রিয়ায় বেশ সময়ও লাগে।
স্ট্রেচারে ঠিকভাবে গন্ডারকে রাখতে ছয়জনের একটি দলের ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় লেগে যায়।
অন্যদিকে পশুটির পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগে।
রেডক্লিফ জানান এ প্রক্রিয়ায় খরচও লাগে কম। দুই হেলিকপ্টারে প্রতি ঘন্টায় ৪০০০ ডলার ব্যয় হয়। সেই সাথে অচেতন অবস্থা কাটাতে সময় দেয় বলে প্রানীর শারীরিক অবস্থারও উন্নতি ঘটে। গন্ডারের শরীরে আফিমের ট্রাঙ্কুইলাইজার সিডাটিভ বা চেতনানাশক হিসেবে দেয়া হয়। এই চেতনানাশকগুলো মরফিনের চাইতেও ১০০০ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং প্রাণীদের উপর ঝুঁকিও ফেলে অনেক বেশি।
কেন গন্ডারদের স্থানান্তর করা হয়?
কালো গন্ডাররা আফ্রিকার বিভিন্ন মরুভূমি, ঝোপঝাড় এবং তৃণভূমি অঞ্চলজুড়ে বসবাস করে। এদের বেশিরভাগই থাকে নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া এবং জিম্বাবুয়েতে। ষাটের দশকে এক লাখেরও বেশি ব্ল্যাক গন্ডার এসব অঞ্চলে ছিল, কিন্তু বিগত ৩০ বছরে বন্যপ্রাণী নিধনের কবলে পড়ে এদের প্রায় ৯৮% কমে গেছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে মাত্র ২৩৫৪ টি কালো গন্ডার টিকে আছে।
সেই থেকেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ কার্যক্রম চালানোর ফলেই এখন কালো গন্ডারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৫৬০০ তে এসে দাঁড়িয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াল্ডলাইফ ফান্ড এর ব্ল্যাক রাইনো রেঞ্জ এক্সপানসন প্রজেক্টের নেতা জ্যাকাস ফ্লেমান্ড জানান, তিনি গন্ডার স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আকাশপথে উল্টো ঝুলিয়ে নেয়া প্রক্রিয়াই বেশি পছন্দ করেন এবং তিনি এক দশক ধরে এই কাজ করে আসছেন।
ফ্লেমান্ড আরো জানান, গন্ডার 'ডেনসিটি-ডিপেন্ডেন্ট' একটি প্রানী। অর্থাৎ কোনো একটি অঞ্চলে অনেকগুলো গন্ডার থাকলে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে, যদি না স্থানান্তর করা হয়। সেকারণেই এদের সরিয়ে নিয়ে এমন জায়গায় রাখা হয় যেখানে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
নামিবিয়ায় সরকারি উদ্যোগে গন্ডারদের উদ্ধার করে বিভিন্ন ফার্ম ও দূরে দূরে অবস্থিত রিজার্ভে রাখা হয়। স্থানীয় লোকদের গেম গার্ড ও রাইনো রেঞ্জার হিসেবে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। এভাবেই তারা প্রাণীগুলোকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেন বলে জানান সেভ দ্য রাইনো ট্রাস্ট এর সিইও সিমসন উরি-খব।
২০২০ সালে নামিবিয়ায় গন্ডার চোরাশিকারের সংখ্যা ৩০% কমে যায়। উরি-খব এর কৃতিত্ব দিয়েছেন তাদের স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক রক্ষাকে।
বর্তমানে বেশিরভাগ গন্ডারই স্থলপথে স্থানান্তর হলেও; আকাশপথে গন্ডার স্থানান্তর আফ্রিকার এসব অঞ্চলে এখনো একটি স্বাভাবিক চিত্র। রেডক্লিফ জানান, তার প্রত্যাশা যে তার টিমের গবেষণা এই প্রাণীগুলোর আরো ভালো স্থানান্তর নিশ্চিত করার সুযোগ করে দেবে। বিশ্বের নাগরিক হিসেবে প্রাণীদের সংরক্ষণ করা তাদের দায়িত্ব বলেও মনে করেন তিনি।
- সূত্র: সিএনএন