সিডরের একযুগ: স্বজনহারা দুর্গতদের মনের ক্ষত আজও শুকায়নি
স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানার ১২ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন গ্রাম।
জানা গেছে, সিডর প্রথমে সুন্দরবনের পূর্বাংশ লন্ডভন্ড করে উপকূলে আছড়ে পড়ে। জলোচ্ছ্বাসে এক গ্রামের মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অন্য গ্রামে। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ মারা গেছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা, মৎস্যখামার ও গবাদিপশুসহ মানুষের সহায় সম্পদ ভেসে গেছে। দিনের পর দিন নদী-খালে গবাদিপশুর সঙ্গে মানুষের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। সিডরে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা।
এখানে সিডরের আঘাতে নিহত অনেকের লাশ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারি হিসেবে সিডরে শুধুমাত্র শরণখোলা উপজেলায় ৬৯৫ জন মারা গেছে এবং এখনও পর্যন্ত ৭৬ জন নিখোঁজ আছে। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। কাছাকাছি সাইক্লোন শেল্টার না থাকার কারণে সিডরে এত বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের দপ্তর সূত্র জানায়, সিডরে জেলায় সরকারি হিসেবে ৯০৮ জন মারা গেছে, নিখোঁজ আছে ৭৬ জন। সিডরে বাগেরহাটের এক হাজার ৬২৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬৫ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির মুখে পড়ে চার লাখ মানুষ। সরকারি হিসেবে টাকার অংকে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
সিডরের আঘাতে সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত বাগেরহাটের শরণখোলার জনপথ এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবে ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, ভাই-বোনসহ স্বজন হারানোর কষ্ট আজও ভুলতে পারেনি সুন্দরবনঘেঁষা শরণখোলা জনপদের মানুষ। বলেশ্বর নদী পাড়ে মানুষ আজও প্রিয়জনকে খুঁজে ফেরে। স্বজন হারানোর কষ্ট বুকে চেপে এভাবে মানুষ পার করছে বছরের পর বছর।
যারা স্বজনদের মৃতদেহ আজও খুঁজে পায়নি তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। সিডর আঘাত হানার ১২ বছর পর সেই নভেম্বর মাসেই আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ শরণখোলার মানুষকে নতুন করে আতঙ্কিত করছে।
সিডর বিধ্বস্ত বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী গ্রামের বাসিন্দা আলেতুন নেছারের (৭৬) স্বামী, দুই নাতি-নাতনি এবং পুত্রবধূ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। ১২ বছরেও প্রিয়জন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওই বৃদ্ধা। এখন রোগে শোকে অনেকটা অচল হয়ে পড়েছেন আলেতুন নেছার।
বৃদ্ধা জানান, সিডরের রাতে নাতনি শারমিন আক্তার, নাতি বাবু পঞ্চায়েত, পুত্রবধূ আসমা বেগম এবং স্বামী সেকেন্দার আলীকে সঙ্গে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের যাওয়ার পথে হঠাৎ করে বুক সমান পানি চলে আসে। পানিতে তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একটি গাছ ধরে বেঁচে থাকেন তিনি। আর স্বামী একটি গাছের ডাল ধরে বাঁচার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি।
প্রতিবেশী রুহুল আমিন পঞ্চায়েত (৫৫) তার দুই ছেলে-মেয়ে এবং বাবাকে হারিয়েছেন সিডরে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে তার বংশের দুই বছরের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২২ জন নারী-পুরুষ। স্বজন হারানোর কথা মনে উঠলে এখনো থমকে যায় তারা। শুধু আলেতুন নেছা এবং রুহুল আমিন নয়, বলেশ্বর নদী পাড়ের অনেকেই তাদের স্বজনকে হারিয়েছে সিডরে। আবার কেউ কেউ তাদের স্বজনকে আজও খুঁজে পায়নি। কোন কোন শিশু বাবা-মাকে হারিয়ে এতিমের খাতায় নাম লিখিয়েছে। রাজৈর গ্রামে খানবংসের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২৬ জন নারী-পুরুষ মারা গেছে সিডরের তান্ডবে।
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এখনও সেখানে কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর রয়েছে। তার একটি ঘরে আলেতুন নেছার বসবাস। সিডরের পর আশে পাশে কাঁচা-পাকা, আধাপাকাসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। এমনকি সিডরের আগে যে ধরনের ঘরবাড়ি ছিল তার চেয়েও বেশি মজবুত ঘরবাড়ি দেখা গেছে অনেক এলাকায়। দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করা হয়েছে দুইতলা এবং তিনতলা বিশিষ্ট সাইক্লোন শেল্টার। নতুন করে গাছপালা জন্ম নিয়েছে সেখানে।
সেই রাতে সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট।
গাবতলা গ্রামের বাহাদুর খান জানান, সিডরে তার এক বোন, চাচা এবং চাচীকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কয়েকদিন পর ধানক্ষেত থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে দাফন করে।
উত্তর তাফাল বাড়ি গ্রামের মো. জিয়ারুল ফকির জানায়, সিডরের সময় তার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। সিডরের কোন স্মৃতি তার মনে নেই। সিডর তাকে এতিম করে রেখে গেছে। এখন জীবিকার তাগিদে সে বলেশ্বর নদীতে মাছ ধরে।
একই এলাকার সেতারা বেগম জানান, সিডরের রাতে গলাসমান পানি সাঁতরিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরের দিন সকালে বাড়িতে এসে দেখি জলোচ্ছ্বাসে বাড়িঘর সব কিছুই ভেসে গেছে। শুধুমাত্র ঘরের পোতা অবশিষ্ট আছে। পরে সরকারি-বেসরকারি সাহায্যে সহযোগিতায় ধীরে ধীরে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে।