‘গণহত্যা’র দায়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি ১২ দেশের সেনাপ্রধানের নিন্দা
আন্দোলনকারীদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা ও 'গণহত্যা'র তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ১২টি দেশের সেনাপ্রধান। গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই শোকের মাতম থামছে না দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশে। ইতোমধ্যেই নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে মারা গেছে অসংখ্য সাধারণ মানুষ।
এ ঘটনায় রোববার সমন্বিত এক বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস ও নিউজিল্যান্ড।
দেশগুলোর সেনাবাহিনী প্রধানরা বলেন, 'একটি পেশাদার সেনাবাহিনী অবশ্যই নিজেদের আচরণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে বাধ্য। তাদের কাজ জনগণকে রক্ষা করা, তাদের হত্যা করা নয়। আমরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে অতিসত্ত্বর এই সহিংসতা কার্যক্রম বন্ধ রাখার জোর দাবি এবং এই সংঘাতের ফলে মিয়ানমারের যেসব ক্ষতি হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করতে আহ্বান জানাচ্ছি।'
গত শনিবার মিয়ানমার আর্মড ফোর্সেস ডে'তে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্তত ১১৪ জন ব্যক্তিকে হত্যা করার পরপরই এই সম্মিলিত বিবৃতি আসে। জাতিসংঘের অনুসন্ধানকারী দল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ কাজকে 'গণহত্যা' বলে অভিহিত করেছে।
সেনাবাহিনীর এ হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্যতম একটি দল দ্য জেনারেল স্ট্রাইক কমিটি অব ন্যাশনালিটিস হামলায় নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক ফেসবুক পোস্টে লেখে, 'আমরা এই বীরদের স্যালুট জানাই যারা বিপ্লবে নিজেদের প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের এই বিপ্লবে জয়ী হতেই হবে।'
শনিবার সেনাবাহিনী ও দেশটির সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীগুলোর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সেনাবাহিনীর বিমানের রেইডের ফলে কারেন মাইনোরিটি নামের একটি সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রিত গ্রামে তিনজন মারা গেছে বলে জানায় একটি সিভিল সোসাইটি গ্রুপ। এর আগে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন দাবি করে, তারা থাই সীমান্তের কাছে একটি আর্মি পোস্টে ১০ জনকে হত্যা করেছে। এয়ার রেইডের ফলে গ্রামবাসীরা ভীত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
'সন্ত্রাস ও অসম্মানের দিন'
জানা যায়, বার্ষিক আর্মড ফোর্সেস ডে উপলক্ষে সেনাবাহিনী এক বড় রকমের অনুষ্ঠান মঞ্চায়ন করার পরেই এই সহিংসতার সূত্রপাত।
অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইং ন্যাপিদাও'তে একটি প্যারেড চলাকালে জানান, সেনাবাহিনী জনগণকে সুরক্ষা দেবে এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে যাবে। গত নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে অং সান সু চি ও তার নির্বাচিত সরকারকে প্রত্যাখান করেন জেনারেল।
এদিকে, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের মিয়ানমারের ডেলিগেশন জানান, ইতিহাসে মিয়ানমারের ৭৬তম আর্মড ফোর্সেস ডে মিয়ানমারের জনসাধারণের রক্তের দাগে কলঙ্কিত ও সন্ত্রাস, অসম্মানের দিন হয়ে থাকবে।
তারা আরও জানান, শিশুসহ নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক হত্যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর থমাস ভাজডা একটি বিবৃতিতে জানান, সেনাবাহিনী বেসামরিক নাগরিকদেরই হত্যা করছে। মিয়ানমারের জনগণ স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে, তারা সেনাশাসনের অধীনে থাকতে চায় না।
আলাদা এক বিবৃতিতে ইউএস অ্যাম্বাসি জানায়, ইয়াঙ্গুনে কালচারাল সেন্টারে গুলি চালানো হয়, যদিও এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুস বলেন, এখনই সময় এসেছে তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার। সেটি যদি জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের মাধ্যমে সম্ভব না হয়, তাহলে ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সামিটের মাধ্যমে করতে হবে।
তিনি আরও জানান, সেনাবাহিনীকে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং অস্ত্রের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া উচিত।
অ্যান্ড্রুস এক বিবৃতিতে বলেন, 'নিন্দা জানানো কিংবা উদ্বেগ প্রকাশ এখন মিয়ানমারের জনগণের কাছে ফাঁকা বুলির মতোই শোনাবে। কারণ, এদিকে সেনাবাহিনী তাদের মেরে সাফ করে ফেলছে। মিয়ানয়ারের জনগণের যা দরকার, তা হলো বিশ্বের সমর্থন। শুধু মুখের কথাই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়, তারা কাজে প্রমাণ দেখতে চায়।'
যে কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব
জনগণকে দমিয়ে রাখতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার-নিপীড়নের ফলে ১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে দেশটিতে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে।
রাজনৈতিক কারাবন্দীদের সহযোগী সংগঠন 'ইউপি' শুক্রবার জানায়, তারা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত ৩২৮ জনের মৃত্যুর হিসাব নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও ২৪০০ জনেরও বেশি মানুষ সেনাবাহিনীর হাতে আটক রয়েছে।
দ্য মিয়ানমার নাও নামে একটি নিউজ পোর্টাল জানিয়েছে, শনিবার সেনাবাহিনীর গুলিতে মান্ডালে শহরে ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে এবং সাইংগাং শহরে ১৩ বছর বয়সী ছেলেসহ ১১৪ জন নিহত হয়েছেন।
তাদের সূত্র আরও জানায়, মান্ডালে'তে ৪০ জন এবং দেশের বাণিজ্যিক শহর ইয়াঙ্গুনে ২৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন বলেন, শনিবারের ঘটনাই দেখিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে (দেশে তাতমাদাও নামে পরিচিত) আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নিয়ে আসা উচিত।
তিনি আরও বলেন, 'দিনটি বার্মার জনগণের জন্য একটা শোকের দিন, যারা তাতমাদাওয়ের আগ্রাসী ও নৃশংস মনোভাব ও লোভের শিকার হয়েছে বারবার।'
এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে মিয়ানমারের ওপর বাহ্যিক চাপ বেড়েছে বলে জানা যায়। তবে মিয়ানমারের জেনারেল অবশ্য রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে কিছু সমর্থনও পেয়েছেন। কারণ, এই দুই ভেটো-প্রদান ক্ষমতাধারী রাষ্ট্র জাতিসংঘের যেকোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ থামিয়ে দিতে সক্ষম।
শনিবার মিয়ানমার সেনাবাহিনী আয়োজিত প্যারেডে অংশ নিয়েছেন রাশিয়ার ডেপুটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আলেক্সান্ডার ফমিন এবং তার একদিন আগেই তিনি সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কূটনীতিকরা জানান, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ড তাদের প্রতিনিধিদের পাঠালেও একমাত্র রাশিয়াই নিজেদের মন্ত্রীকে পাঠিয়েছে মিয়ানমারের আর্মড ফোর্সেস ডে'র প্যারেড অনুষ্ঠানে।
অভ্যুত্থানবিরোধী দল 'পিয়াদাংশু হ্লুতাও'র মুখপাত্র ডা. সাসা জানান, আটটি দেশের প্রতিনিধিদের এই প্যারেড অনুষ্ঠানে যোগদান করাটাই ছিল লজ্জাজনক ও অবাঞ্ছনীয়। তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে একটি 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে অভিহিত করতে।
আল-জাজিরাকে সাসা বলেন, 'বিদেশি কূটনীতিকদের মিলিটারি জেনারেলদের অনুষ্ঠানে এসে তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে দেখে আমাদের কতটা দুঃখ হয়েছে, তা বলে বোঝাতে পারব না। সেদিন তারা যেসব অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শনী করেছে, তার সবই মিয়ানমারের সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য! আর কত মানুষ মারা গেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? যদি কেউই আমাদের জন্য কিছু না করে, তাহলে ভয় হচ্ছে, আমার দেশ একটা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হবে।'
- সূত্র: আল-জাজিরা