কোভিডের লক্ষণ প্রকাশের পর স্নায়বিক জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা
সম্প্রতি শিশু-কিশোরদের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিভিন্ন শারীরিক প্রদাহজনিত লক্ষণ দেখা যাওয়ার বিষয়ে বিশ্বে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অল্পবয়সীদের মাঝে মূলত ফুসকুড়ি বা র্যাশ, পেট ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। তবে, শিশু-কিশোরদের মাঝে এর থেকেও ভয়াবহ লক্ষণগুলো হল নিম্ন রক্তচাপ, শক এবং রক্ত সঞ্চালনে অসুবিধাসহ বিভিন্ন হৃদজনিত সমস্যা।
নতুন একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত লক্ষণের ভুক্তভোগী শিশু-কিশোরদের মাঝে পরবর্তীতে স্নায়ুজনিত বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। আক্রান্তদের মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু দৃষ্টিবিভ্রম, বিভ্রান্তি, বাক-প্রতিবন্ধকতা, ভারসাম্য ও সমন্বয় রক্ষা করতে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন স্নায়ুরোগের উপসর্গে আক্রান্ত । লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসারত ৪৬ জন শিশুর উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, অর্ধেক সংখ্যক শিশু অর্থাৎ ২৪ জনই বিভিন্ন স্নায়ুজনিত উপসর্গে ভুগছে। তবে, ওই শিশুদের কারোরই পূর্বে এধরনের শারীরিক সমস্যা ছিল না।
সাধারণ রোগীদের তুলনায় স্নায়ুজনিত উপসর্গ দেখা দেওয়া রোগীদের ভেন্টিলেটর ব্যবহারের প্রয়োজনীতাও দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পায়। গবেষণার সহ-লেখক এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইন্সটিটিউট অব নিউরোলজির ক্লিনিকাল রিসার্চ ফেলো ডক্টর ওমর আবদেল মান্নান জানান, উচ্চ-প্রদাহজনিত অবস্থার কারণে এই রোগীদের শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। একই সাথে এই রোগীদের হৃদপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতা স্বাভাবিক করতেও দ্বিগুণ পরিমাণ ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।
সাধারণত উপসর্গবিহীন অথবা মৃদু উপসর্গ নিয়ে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে ছয় সপ্তাহ পর এধরনের অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ এই অবস্থাটির নাম 'মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন' সংক্ষেপে, এমআইএস- সি। বিরল হলেও শিশুদের জন্য অবস্থাটি বিপজ্জনক। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে ৩৬ জনের মৃত্যুসহ এধরনের ৩ হাজার ১৬৫টি কেস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ডক্টর আবদেল মান্নান আরও জানান, নতুন করে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ ভাইরাস প্রতিরোধে ইম্যুনো ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট প্রদাহের সাথে স্নায়ুজনিত উপসর্গের সম্পৃক্ততা তত্ত্বকে জোরদার করছে। প্রতিবেদনে শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শারীরিক লক্ষণগুলোর জন্য চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমেই অধিকাংশ স্নায়ুজনিত জটিলতার সমাধান মিলছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরাও এমআইএস-সিতে আক্রান্ত শিশুদের মাঝে স্নায়ুজনিত উপসর্গ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। জামা নিউরোলজিতে গত মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৬১টি হাসপাতালে গত বছর কোভিড লক্ষণ নিয়ে ভর্তি হওয়া ৬১৬ জন অল্পবয়সী রোগীর মাঝে ১২৬ জনের স্নায়ুজনিত সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে ২০ জনের অবস্থা স্ট্রোক কিংবা এনসেফেলোপ্যাথি বা মস্তিষ্ক ব্যাধির কারণে আশঙ্কাজনক ছিল বলে উল্লেখ করেন গবেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রসহ নতুন এই সিনড্রোম নিয়ে অন্য কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, আক্রান্তদের অধিকাংশই ছিলেন 'অশ্বেতাঙ্গ'। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে বিভিন্ন বর্ণের জনগোষ্ঠীর মধ্যে মহামারির ভিন্ন ধরনের প্রভাবের প্রতিফলন এই সিনড্রোম। অন্যদিকে, আক্রান্তদের মধ্যমা বয়সের মান ছিল ১০ বছর, যাদের দুই-তৃতীয়াংশই পুরুষ।
স্নায়ুজনিত উপসর্গে আক্রান্ত ২৪ জন রোগীর প্রত্যেকেই মাথা ব্যথায় ভুগছিলেন। এদের মধ্যে ১৪ জনের এনসেফেলোপ্যাথি ছিল। বিভ্রান্তিসহ স্মৃতি কিংবা মনোযোগ ও অন্যান্য মানসিক কর্মক্ষমতা সংক্রান্ত জটিলতা বোঝাতে 'এনসেফেলোপ্যাথি' শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ছয়জন শিশু দৃষ্টিবিভ্রমে ভুগছিল। ডক্টর আবদেল মানান জানান, "তারা রুমে অনুপস্থিত মানুষদের বর্ণনা দিচ্ছিল কিংবা দেয়ালে কার্টুন ও অন্যান্য পশুপাখি চলাফেরা করতে দেখার কথা বলছিল।" তিনি আরও জানান অনেকে শ্রুতিবিভ্রাট বা অডিটরি হ্যালুসিনেশনের আক্রান্ত হয়েছিল। "তারা অনুপস্থিত মানুষের আওয়াজ শুনতে পারছিল," বলেন তিনি।
ছয়জন শিশুর কথা বলার ক্ষেত্রে পেশি নিয়ন্ত্রণে জটিলতায় ভুগছিল। চারজনের ছিল ভারসাম্য ও সমন্বয়হীনতা। একজনের খিঁচুনি সৃষ্টি হয়েছিল। মুখ কিংবা কাঁধের পেশিতে সমস্যাজনিত কারণে তিনজন শিশুর মাঝে পেরিফেরাল স্নায়ু জটিলতার সৃষ্টি হয়। এমনকি একজনের পেরিফেরাল স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাকে চলাফেরার জন্য ক্রাচ ব্যবহার করতে হয়, একই সাথে শিশুটিকে নার্ভ ট্রান্সপ্লান্টের পরামর্শও দেওয়া হয় বলে জানান ডক্টর মান্নান।
আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে তিনজনকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এদের মধ্যে একজনের পুনরায় মস্তিষ্কজনিত সমস্যা দেখা যায়। বাকি দুইজন সংক্রমণজনিত জটিলতায় ভুগছিল বলে জানা যায়। তবে ডাক্তার মান্নান জানান, শিশুদের কারও মৃত্যু ঘটেনি এবং "প্রায় সকল শিশুই পূর্ণাঙ্গ কার্যক্ষমতা ফিরে পায়।"
গবেষণার সিনিয়র লেখক ডক্টর ইয়েল হাচোহেনের নেতৃত্বে একটি দল একই সাথে স্নায়ুজনিত উপসর্গযুক্ত এবং উপসর্গবিহীন শিশুদের পর্যবেক্ষণে রাখবে বলে জানান ডক্টর মান্নান। এছাড়াও, তারা শিশুদের মস্তিষ্ক স্ক্যান এবং অবধারণগত মূল্যায়নের মাধ্যমে শিশুদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিজনিত ও মানসিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবেন।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস