রিফাত সুলতানা: সকালে সন্তান জন্ম দিয়ে বিকেলে করোনার বলি যে মা
করোনাভাইরাসে ভৌতিক রূপ আরও এক নির্মমতার সাক্ষী করল আমাদের। শুক্রবার সকালে সন্তানকে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখানো মা বিকালে নিলেন চিরবিদায়। প্রাণঘাতী বৈশ্বিক ভাইরাসটি কেড়ে নিল একাত্তর টেলিভিশনের সহযোগী প্রযোজক রিফাত সুলতানার জীবন।
মুহূর্তেই মা হারা হলো নবজাতক। মা হারা হলো রিফাতের দুই বছর বয়সী যমজ সন্তান।
একাত্তর টিভি সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি এই টেলিভিশন চ্যানেলে ১১ বছর কর্মরত ছিলেন রিফাত। সপরিবারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই গতকাল বিকেল ৫টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চিকিৎসকরা জানান, সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা রিফাতের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সেদিন সকালে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় তাকে। সেখানেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয় তার কন্যা সন্তানের। পরে বিকালে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা যান তিনি।
তার স্বামী একাত্তর টেলিভিশনের আরেক সহযোগী প্রযোজক নাজমুল ইসলামও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এদিকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন রিফাতের করোনা আক্রান্ত শাশুড়ি।
রিফাত সুলতানার এমন মৃত্যুতে একের পর এক পোস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক হয়ে ওঠে যেন শোকের জার্নাল।
জনপ্রিয় মডেল ও উপস্থাপিকা শ্রাবণ্য তৌহিদা লিখেন, 'রিফাত আর নাজমুল আমাদের পারিবারিক বন্ধু। অনেক বছরের পরিচয় ওদের সাথে। ওদের প্রেম কিন্তু তার ও অনেক আগে থেকে! যেন সিনেমাকেও হার মানায়। রিফাত আর নাজমুলের বিয়ের ঘটনা ছিল আরও নাটকীয়তায় ভরপুর।একসাথে ৭১-এ কাজ করা সারাদিন ওরা একসাথেই থাকত, এটা নিয়ে আমরা খুনসুটি করলেও ওরা অনেক এনজয় করত।'
'ফুল অব লাইফ ছিল রিফাত! বারবিকিউ করা, মাওয়ার ইলিশ ফ্রাই, হইচই আনন্দে মেতে থাকত সবসময়। বাচ্চার জন্য অনেক চেষ্টার পর টেস্টটিউব পদ্ধতিতে ঘর আলো করে টুইন দুই রাজপুত্রের আগমনের ২ বছর না হতেই ন্যাচারালি হঠাৎ করেই প্যানডেমিকে কনসিভ করল! আশীর্বাদ ভেবেই সবাই খুশি ছিল। ২ বাচ্চা, অফিস, প্যানডেমিক সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল; কিন্তু তারপরও চলে যাচ্ছিল।'
'বাচ্চারা মা ভক্ত ছিল। মায়ের কাছেই সব আবদার। সব অপেক্ষা থাকত ওদের মায়ের জন্য। আর মাত্র কিছু দিনের অপেক্ষা ছিল... হঠাৎ কোভিড ঝরে সব এলোমেলো। বাচ্চারা বাদে বাসার সবাই পজিটিভ। প্রথমে বাসায়ই হসপিটাল সেটআপ দিয়ে রিফাতকে দেখাশোনা করছিল নাজমুলই। ১ সপ্তাহ পর হাসপাতালে নিতেই হলো! মুগদা থেকে ঘুরতে ঘুরতে ইমপালস হসপিটাল। বাচ্চার নড়াচড়া কমে যাচ্ছিল।ইমারজেন্সি সিজারে যেতে হলো। ফুটফুটে এক রাজকন্যা এল; কিন্তু রিফাত চলে গেল না ফেরার দেশে...।'
'হতবিহবল সবাই! একেবারেই অপ্রত্যাশিত এ মৃত্যু সবাইকেই নাড়িয়ে দিল! মৃত্যুর আগে ওর নিশ্চয় খুব দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল বাচ্চাদের, ওদের বুকে জড়িয়ে শেষবার আদরটুকুও করতে না পারার আক্ষেপ নাকি শারীরিক কষ্ট- কোনটা বেশি পীড়াদায়ক ছিল? তখন কোনো আপনজন ছিল না! এটাই কোভিড বাস্তবতা!'
'যে রাজকন্যা এলো আজ পৃথিবীতে, বড় হয়ে যখন জানবে ওর আসার দিনই মাকে চলে যেতে হয়েছিল, কেমন লাগবে ওর? আর বাসায় টুইন রাজপুত্রদের মায়ের জন্য অপেক্ষা আর শেষ হবে না। অফিস থেকে বাবা হয়তো ফিরবে, কিন্তু মা আর কোনোদিন ফিরবে না...। বড় হয়ে ওরা কি আর মায়ের জন্য অপেক্ষা করবে? মায়ের কোনো স্মৃতি কি ওদের মনে থাকবে?... এমনও কি হয়? এমনও কি হতে পারে? কি নিষ্ঠুর পৃথিবী!'
অন্যদিকে, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পাবলিক রিলেশনস ডিপার্টমেন্টের প্রধানকর্তা সুপা সাদিয়া ফেসবুক পোস্টে লিখেন, 'জনসংযোগ পেশাকে এক কথায় সবাই বলে চ্যালেঞ্জিং পেশা। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় অমানবিক পেশা। প্রতিষ্ঠানের কেউ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলে কোনো দুঃখ প্রকাশের সময় নেই। তখন সময় একটাই, তাকে নিয়ে লেখা। সবাইকে জানানো। মেয়েটি (রিফাত) স্টামফোর্ডের ছাত্রী। চলে গেল করোনায়। রেখে গেল প্রাণপ্রিয় ৩ বছরের যমজ পুত্র আর ১ দিনের কন্যা...। গত ৭ দিনে এই নিয়ে ৪ জনের চলে যাওয়া।'
মৃতদের পৃথিবীতে জীবিতদের আর্তনাদ হয়তো পৌঁছায় না। জীবিতদের পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরঘুমে শায়িত হয়েছেন রিফাত জাহান। তার সন্তানদের মা-হারা পৃথিবী নির্মম না হোক!