ভারতে অক্সিজেন জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় যেসব সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহতার শিকার হওয়া ভারত এখন তীব্র অক্সিজেন স্বল্পতায় রয়েছে। এমতাবস্থায়, ভারতকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন।
যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যেই ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র পাঠানো শুরু করে দিয়েছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোও সাহায্য পাঠাবে বলে জানিয়েছে।
এদিকে ভারত যেন অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন আরো বেশি পরিমাণে বানাতে পারে, সেজন্য ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে লকডাউনের সময়সীমা আরো বাড়ানো হয়েছে। কারণ জায়গা সংকুলান না হওয়ায় এবং অক্সিজেন না থাকায় হাসপাতালগুলো প্রতিনিয়ত অসংখ্য রোগীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সেদেশের আরো ৫০০টি অক্সিজেন উৎপাদন প্ল্যান্ট গড়ে তোলার জন্য অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার।
এরই মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আজ সোমবার (২৬ এপ্রিল) থেকে ভারতের সঙ্গে ১৪ দিনের জন্য সীমান্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ। বিগত ২৪ ঘন্টায় ভারতে নতুন করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,৫২,৯৯১ জনে। সেই সাথে নতুন করে মৃতের সংখ্যা ২,৮১২ জন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এসব সরকারি হিসাবের বাইরেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।
যুক্তরাজ্য কি পাঠাচ্ছে?
ভারতকে দেয়ার জন্য জরুরি সামগ্রী নিয়ে প্রথম চালানটি যুক্তরাজ্য ছেড়ে গেছে গত রোববারে। আশা করা হচ্ছে, মঙ্গলবার নাগাদ এটি ভারতে পৌঁছাবে। এক সপ্তাহ বাদে আবার পরবর্তী চালান পাঠানো হবে বলে জানা যায়।
ভারতে দেওয়া এই সহায়তার মধ্যে রয়েছে ৪৯৫টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। যখন হাসপাতালের অক্সিজেন গেলে তখন এই কনসেনট্রেটর বাতাস থেকে অক্সিজেন শুষে নিয়ে নতুন সরবরাহ দিতে পারবে। সেই সাথে রয়েছে ১২০টি নন-ইনভেসিভ ও ২০টি ম্যানুয়াল ভেন্টিলেটর।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এক বিবৃতিতে বলেন, "কোভিড-১৯ সৃষ্ট ভয়াবহ দুঃসময়ে আমরা প্রকৃত বন্ধুর মতো ভারতীয় জনগণের পাশে থাকবো।"
ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যের দেওয়া ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে তার আসন্ন ভারত সফর বাতিল করতে হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসসহ আরো কিছু দেশও ভারতের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ কি করছে?
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মার্কিন সরকার অতিসত্ত্বর দেশটিকে ভ্যাকসিন তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করবে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, "করোনা মহামারির একদম শুরুতে যখন আমরা বিপর্যয়ে ছিলাম; তখন ভারত যেভাবে আমাদের সাহায্য করেছে, আমরাও তাদের প্রয়োজনের সময় সেভাবে সাহায্য করতে বদ্ধপরিকর।"
ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রও ভ্যাকসিন তৈরির কাঁচামাল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু, ভারতে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হতে থাকায় সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং ভারত সরকারের কর্মকর্তারা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেন। এরপরই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এই বক্তব্য আসে।
উদ্বৃত্ত ভ্যাকসিন অন্যান্য দেশগুলোতে সাহায্য হিসেবে পাঠাতে দেরি করায় ইতিমধ্যেই সমালোচিত হয়েছে ওয়াশিংটন। লাখ লাখ অব্যবহৃত অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন মার্কিন সরকারের গুদামঘরে পড়ে আছে, যা এখনো সেদেশে ব্যবহারের অনুমোদনও পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফসি জানান, বাড়তি ভ্যাকসিনগুলো ভারতে পাঠানোর কথা আগেই বিবেচনা করা হয়েছে। এছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও সুরক্ষা সরঞ্জাম দেবে। এরই মধ্যে ফ্রান্স জানিয়েছে, যে তারা ভারতকে অক্সিজেন সহায়তা পাঠাবে।
ব্রাসেলসে ইউরোপিয় ইউনিয়ন কমিশন জানিয়েছে, তারা ভারতে অক্সিজেন ও ওষুধ দুটোই পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। কমিশনের প্রধান, উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, ভারতকে সাহায্য করার জন্য নানা দিক থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী জড়ো করা হয়েছে।
সীমান্ত সংঘর্ষ ও নানা বিষয়ে ভারতের প্রতিবেশী দেশ ও চিরশত্রু পাকিস্তানও চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান টুইট বার্তায় ভারতীয় জনগণের 'দ্রুত আরোগ্য লাভ' কামনা করেছেন। পাকিস্তানের 'ঈধি ফাউন্ডেশন' ভারতকে ৫০ টি অ্যাম্বুলেন্সের বহর পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
ভারতের পরিস্থিতি কি?
এই মুহূর্তে কঠিন বিপর্যয় ও দুঃসহ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভারত। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নাগরিকদের সাবধানতা অবলম্বন করতে ও ভ্যাকসিন নিতে বলেছেন। অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতালগুলো আর নতুন রোগী ভর্তি নিচ্ছে না।
শনিবার জয়পুরের গোল্ডেন সিটি হাসপাতালে অক্সিজেন না পেয়ে অন্তত ২০ রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। দিল্লিসহ ভারতের মূল শহরগুলোতে হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে সারাক্ষণই চলছে স্বজনদের কান্নার রোল। সবাই ডাক্তারদের মিনতি করছেন নিজের প্রিয়জনকে ভর্তি করাতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঢুকলেই অজস্র ভারতীয়র কাতর মিনতি চোখে পড়ছে।
ভারতে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতা এবং মহামারির মধ্যেও নির্বাচনী প্রচার ও ধর্মীয় উৎসবে লাখ লাখ মানুষকে সমবেত হওয়ার উৎসাহ অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তোষ বেড়েই চলেছে।
এরমধ্যেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার টুইটার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, পরিস্থিতি সামলানো আরো জটিল করে তোলে এ ধরনের টুইট বার্তা যেন তারা ব্লক করে দেয়। ফলশ্রুতিতে, টুইটারে ডজন ডজন টুইট ব্লক করা হয়েছে। এদের মধ্যে রেভনাথ রেড্ডি নামক এক আইনপ্রণেতা, মলয় ঘটক নামে পশ্চিমবঙ্গের এক মন্ত্রী ও অভিনাশ দাস নামের চলচ্চিত্র নির্মাতাও রয়েছেন বলে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।
এছাড়াও, ভারতের একটি সংবাদপত্র সংস্থা জানিয়েছে যে তারা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) ক্রিকেট সম্পর্কিত খবর প্রচার বন্ধ করে দেবে। চলমান সংকটের মধ্যে আইপিএল একটি বেমানান ও অসংলগ্ন জিনিস বলে তারা মনে করছেন।
- সূত্র: বিবিসি