৫ মিলিয়ন ডলারের মেডিকেল অক্সিজেন প্ল্যান্ট আমদানি করবে জিপিএইচ
মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের লক্ষ্যে চীন থেকে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অক্সিজেন তরলীকরণ যন্ত্র আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জিপিএস ইস্পাত। এর মধ্য দিয়ে দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় অক্সিজেনের চাহিদা পূরণে রচিত হলো এক নতুন পদক্ষেপ।
আমদানিকৃত অক্সিজেন প্ল্যান্টটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৫০-৬০ টন। নতুন এই প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে জিপিএস কারখানায় দৈনিক ৭০-৮০ টন মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন সম্ভব হবে। ফলে, মেডিকেল অক্সিজেনের ওপর বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা কমতে চলেছে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিষ্ঠানটির অধীনে আগে থেকেই ২৫০ টন উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন অক্সিজেন প্ল্যান্ট আছে। তবে, এই প্ল্যান্টটি মূলত ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত প্ল্যান্টটি দৈনিক ২২-২৫ টন তরল মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। গ্যাস হিসেবে উৎপাদিত অক্সিজেনের বাকি অংশ ইস্পাত কারখানায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তবে, তরলীকরণ নতুন প্ল্যান্টটি দ্রুত আমদানি করতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।
জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল বলেন, "আমরা প্ল্যান্ট আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সরকার আমাদের সহযোগিতা করলে আমার চার মাসের ভেতর প্ল্যান্ট আমদানি করে উৎপাদন শুরু করতে পারব। তা না হলে আরও দুই-তিন মাস বেশি সময় লাগবে।"
"সরকার যদি চীনা সরকারের সাথে সময়মতো চালান পাঠানোর জন্য সমঝোতায় আসে, তাহলে আমরা দুই মাসের ভেতর প্ল্যান্টটি হাতে পাব। প্ল্যান্ট আসার পর পুরোদমে উৎপাদন শুরু করতে আরও সর্বোচ্চ দুই মাস সময় লাগবে," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "আমরা শীঘ্রই সকল নির্মাণের কাজ শেষ করব যাতে প্ল্যান্টটি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে স্থাপন করা যায়।"
শিমুল আরও জানান, কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে অক্সিজেন প্ল্যান্টটি আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতেই প্রতিষ্ঠানটি মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনে প্ল্যান্ট স্থাপনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের যথাসাধ্য সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেছে," বলেন তিনি।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালে মেডিকেল অক্সিজেনের ব্যবহার ৪০-৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০-১৮০ টনে গিয়ে পৌঁছেছে।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মোট চাহিদার মাত্র ৭০-৮০ শতাংশ পূরণে সক্ষম। চাহিদার বাকি অংশ ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়ে থাকে। তবে, ভারতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটির সরকার গত ২২ এপ্রিল অক্সিজেন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
লিন্ডে বাংলাদেশ দৈনিক ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকে। বর্তমানে, স্থানীয় বাজারে মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহে প্রতিষ্ঠানটি শীর্ষ অবস্থানে আছে।
এদিকে, দেশে আশঙ্কাজনকহারে কোভিড-১৯ এ শনাক্ত সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার শিল্পখাতে অক্সিজেন সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
জিপিএইচ ইস্পাতের অক্সিজেন তরলীকরণ প্ল্যান্ট আমদানির সংবাদে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডাক্তার ফরিদ হোসেন মিয়া ।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জিপিএইচ যদি তরল অক্সিজেন উৎপাদন করে, তাহলে আমাদের ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করতে হবে না।"
"দেশে দুটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। তবে কিছু সংকট থাকায়, আমাদের ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করতে হয়," বলেন তিনি।
এই মুহূর্তে দেশে অক্সিজেন সংকট না থাকলেও কোভিড-১৯ সংক্রমণ সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
"আর তাই, স্থানীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন উৎপাদনে এগিয়ে আসলে সংকট প্রতিহত করা যেতে পারে," বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড একাধিক বার ফোন করেও পায়নি।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সচিব এবং সাবেক স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান টিবিএসকে বলেন, "যেকোনো সংকট মোকাবিলায় আমাদের অক্সিজেন স্বনির্ভরতা অর্জনের চিন্তা করতে হবে। জিপিএইচ ইস্পাত অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনে আমাদের সহযোগিতা কামনা করেছে। এ বিষয়ে আমরা তাদের যথাসাধ্য সহযোগিতা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়েছি।"
কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেনকে মূল অনুষঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখানে প্ল্যান্ট স্থাপিত হলে আমাদের অনেকটাই স্বস্তি এনে দিবে।"
২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট জিপিএইচ ইস্পাত চীনা প্রতিষ্ঠান সিচুয়ান এয়ার সেপারেশন প্ল্যান্ট (গ্রুপ) করপোরেশন লিমিটেডের সাথে ২৫০ টন উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করে।
গত বছর জুলাইয়ের পর প্ল্যান্টটি পুরোদমে চালু হয়। ২৫০ উৎপাদনক্ষমতার প্ল্যান্ট থেকে জিপিএইচ দৈনিক ২২-২৫ টন তরল মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। বাকি অক্সিজেন গ্যাস হিসেবে উৎপাদিত হয় যা ইস্পাত কারখানায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আলমাস শিমুল জানান, জিপিএইচ বর্তমানে উৎপাদিত তরল অক্সিজেন বিনামূল্যে বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করে থাকে।
"প্ল্যান্টে জীবনরক্ষাকারী মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য ইস্পাত উৎপাদন কমিয়ে দিতে হলেও আমাদের সমস্যা নেই। কিন্তু মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করতে হলে আমাদের তরলীকরণ প্ল্যান্টের প্রয়োজন," বলেন তিনি।
বিভিন্ন হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে জিপিএইচ ইস্পাত পরিবহনের জন্য ট্রাক কেনাসহ ১১ জন কর্মী নিয়োগ করেছে। শুধু চট্টগ্রাম নগরীতেই নয়, বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলেও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি বিনামূল্যে পরিবহন খরচ ছাড়াই বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে।
"দেশের মানুষ জিপিএইচকে আজ বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে জিপিএইচ ইস্পাত এই কঠিন সময়ে মুনাফার কথা চিন্তা না করে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে," বলেন আলমাস শিমুল।
তিনি আরও বলেন, "অক্সিজেন সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে আমরা চব্বিশ ঘন্টাই আমাদের কারখানা চালু রেখেছি। হাসপাতালগুলো ছাড়াও যে কেউ আমাদের এখানে এসে অক্সিজেন সিলিন্ডার পুনরায় ভরে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের দলের সদস্যরা সর্বদা প্রস্তুত আছেন। যখনই কোনো হাসপাতাল বা সিভিল সার্জনের কাছ থেকে বার্তা আসছে, তখনই তারা অক্সিজেন নিয়ে ছুটছেন।"