লোকে লোকারণ্য মার্কেট, স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই
ঈদের বাকি মাত্র আর মাত্র কয়েকদিন। রমজানের মধ্যে ঈদের আগে শেষ শুক্রবারে তাই রাজধানীর মার্কেটগুলো ছিল লোকে লোকারণ্য। দোকানগুলোর মধ্যে এবং মার্কেটের রাস্তাগুলোতে হাঁটার মতো অবস্থা ছিল না। রমজানের মধ্যে শুক্রবারই সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করেছেন ক্রেতারা এমনটাই বলছেন দোকানীরা।
ক্রেতাদের ভিড় বেশি থাকায় এবং বিক্রি ভালো হওয়ায় দোকানীদের মনে কিছুটা স্বস্তি আসলেও কারো মধ্যেই ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা। অধিকাংশ ক্রেতারা মাস্ক পড়লেও হয়তো কারো থুতনিতে কিংবা নাকের নিচে নামানো ছিল মাস্ক। মার্কেটগুলোতে ভিড়ের মধ্যে কারো মধ্যেই ছিল না সামাজিক দূরত্ব মেনে অবস্থান করা কিংবা চলাচল করা।
ক্রেতাদের এতো বেশি সমাগমের কারণে মার্কেটগুলোর সামনের রাস্তাতে দেখা যায় দীর্ঘ যানজট। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গিয়েও বেগ পেতে হয় পথচারীদের।
শুক্রবার রাজধানীর নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউসিয়া, নূর ম্যানশন, চন্দ্রিমা মার্কেট, বসুন্ধরা শপিং সেন্টার, মোতালেব প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি শপিং সেন্টার এবং নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ফার্মগেট, মিরপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানের মার্কেট ঘুরে এ চিত্রই দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের এভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেনাকাটা এবং অসচেতনতার কারণে সাময়িকভাবে সংক্রমণের হার তেমন না বাড়লেও এর প্রভাব পড়বে জুন মাসের দিকে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'শপিংমলগুলোতে ক্রেতাদের এমন অবাধ গমনের জন্য এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাচলের জন্য সর্বপ্রথম সরকারই দায়ী। শপিংমলগুলো এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্র না যে এগুলো বন্ধ থাকলে মানুষ প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে পারবে না। খুলে দিয়েই সবচেয়ে বড় ভুলটি হয়েছে'।
তিনি আরও বলেন, 'সরকার চাইলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। এই ভিড়ের কা্রণে করোনার সংক্রমণ বহুগুণে বাড়বে, তবে এর প্রভাব হয়তো এ মাসে দেখা যাবে না। জুন মাসে গিয়ে এই অনিয়ন্ত্রিত জনসমাগমের জন্য আমাদেরকে ভুগতে হবে'।
১০ বছরের মেয়ে এবং কোলে দেড় বছরের এক ছেলে বাচ্চাকে নিয়ে নিউ মার্কেটের চাঁদনী চকে কেনাকাটা করতে এসেছেন শুভ হাসান এবং তার স্ত্রী। সন্তানদের কারো মুখেই নেই মাস্ক। ক্রেতাদের ভিড়ে দুই সন্তানকে নিয়ে এক প্রকারের বিপদেই পড়েছেন কেনাকাটা করতে এসে।
শুভ টিবিএসকে বলেন, 'বাসায় কেউ নেই যে বাচ্চাদের রেখে আসবো। আর ঈদ এলেই তো বাচ্চাদের একটা চাহিদা থাকে নতুন কাপড়ের তাই ওদেরকে নিয়ে বের হয়েছি কিন্তু মার্কেটে এসে এত ভিড় দেখে রীতিমতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছি। এতো ভিড় হবে জানলে হয়তো আসতাম না'।
এ চিত্র শুধু নিউমার্কেটের নূর ম্যানশনে নয়। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি শপিং সেন্টারেই একই চিত্র।
নিউ মার্কেটের কাপড় বিক্রেতা তাসনিম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'গত দুই-তিনদিন ধরে ক্রেতাদের চাপ একটু বেশি। ঈদের আগে শেষ শুক্রবার হওয়ায় আজ ভিড় একটু বেশিই। মার্কেটের মধ্যে কিছুক্ষণ পর পর মাইকিং এবং গার্ডরা সতর্ক করলেও ক্রেতাদের চাপের কারণে স্বাস্থ্যবিধি চাইলেও মানা সম্ভব নয়'।
২০১৯ সালের ঈদের আগের বিক্রির মতো শুক্রবার বিক্রি হয়েছে উল্লেখ করে নূর ম্যানশনের কাপড়ের দোকানী দ্বীন ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আজকে মনে হচ্ছে যে কয়েকদিন পরে ঈদ। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক দিতে পারছি না। লকডাউন এবং গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দোকানে খুব বেশি মালামাল আনা হয়নি। তাই অনেক ক্রেতাদেরই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় দিতে না পারায়'।
নিউ মার্কেটের চুড়ি বিক্রেতা মাকসুদ আলম বলেন, 'অন্য ঈদের মতোই আজ (শুক্রবার) বিক্রি হচ্ছে। অন্য ঈদে প্রতিদিন ১৭-২০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হতো আজও এমনটা বিক্রি হবে বলে আশা করছি'।
বসুন্ধরা শপিং সেন্টার, মোতালিব প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাজা ঘুরে দেখা যায়, শপিংমলের লিফটগুলোতে ছিল মানুষের তীব্র জটলা। তীব্র গদাগাদি ও অনেকটা প্রতিযোগিতা করেই লিফটগুলোতে চলাচল করছেন কাস্টমাররা। ক্রেতা-বিক্রেতার অনেককেই দেখা গেছে মাস্ক ছাড়া। কারো কারো থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে রাখতেও দেখা গেছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জোবায়ের আহমেদ সহকর্মীদের সাথে এসেছেন বসুন্ধরা শপিংমলে ঈদের কেনাকাটা করতে। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'মাস শেষে বেতন পেয়েছি, তাই নিজের বাবা-মা ও ছোট ভাই বোনের জন্যও কিছু পোশাক কিনেছি। দুই-একদিন পর গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম চলে যাব, তাই আজকেই শপিং করতে এসেছি'।
স্বামী ও দুই সন্তানসহ কেনাকাটা করতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা হাবিবা আলভি টিবিএসকে বলেন, 'কিছু দিন পরে ঈদের মার্কেটে তেমন ভালো মানের জিনিস পাওয়া যাবে না। তাই আজকের ছুটির দিনেই কেনাকাটা করে ফেলেছি'। তবে তিনি অভিযোগ করেন জিনিসপাত্রের দাম এবার একটু বেশি হাঁকাচ্ছে দোকানিরা।
এদিকে মার্কেটে ক্রেতাদের সমাগম বেড়ে যাওয়া খুশি বিক্রেতারা। বিক্রিও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন দোকানী।
ইজি ফ্যাশনের বিক্রয়কর্মী রবিউল ইসলাম বলেন, 'এবারের ঈদের বাজারে আজকেই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সকাল থেকেই দোকানে কাস্টমারের মোটামুটি ভালোই ভিড়'।
মিরপুর-১ এর মুক্তি প্লাজা, হক প্লাজা ও অল ইন অল ফ্যাশন এন্ড ফেব্রিকস হাউজগুলোতেও দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়।
তবে এত ভিড়ের মধ্যেও অনেক ব্যবসায়ী বলছেন যেমনটা বিক্রি হওয়ার কথা ছিল তেমন হচ্ছে না।
মোতালিব প্লাজার এক দোকানী শরিফ ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'দোকানে ভিড় আছে কিন্তু বিক্রি ঈদের মতো নেই। দেখা যায় একজনের সাথে পাঁচ জন আসছে তাই ভিড় বেশি দেখা যাচ্ছে'।
উল্লেখ্য, প্রথম রমজান থেকেই দেশব্যাপী চলমান সর্বাত্মক লকডাউনে সারাদেশের সব দোকান ও শপিংমল বন্ধ থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে গত ২৫ এপ্রিল থেকে খুলে দেয়া হয়। এছাড়া গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও তা গত ৬ মে থেকে পুনরায় চালু করা হয়।