মহামারি আর খরচের চাপ থেকে রক্ষা পাবে না ভারতীয় কোম্পানিগুলোর মুনাফা
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর থেকে চারিদিকের দুঃসংবাদের স্রোতে ভারতে আনন্দিত হওয়ার মতো সংবাদের বড়ই অভাব ইদানীং। বাণিজ্যিক অঙ্গনের আরেকটি ঘটনাও তেমন অশনি ইঙ্গিত দিচ্ছে। মহামারির বৈশ্বিক কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠা দেশটির শীর্ষস্থানীয় পরিচর্যা পণ্য ও প্রসাধনী প্রস্তুতকারক কোম্পানি কোলগেট-পামুলিভ কর্পের সাম্প্রতিক মৃদু প্রবৃদ্ধিই সেই বিপদের দিকটি তুলে ধরে।
মূলত, টুথপেস্ট প্রস্তুতকারক হিসেবে বিখ্যাত কোম্পানিটি চলতি সপ্তাহে তাদের আয় বিবরণী প্রকাশ করে। সেখানে সন্তোষজনক ফলাফল প্রদর্শিত হয়নি, কিন্তু তবুও ৭৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মানবিক দুর্যোগের বাস্তবতা অস্বীকার করে ভারতীয় পুঁজিবাজারে মূল্যায়ন পতন হয়নি কোম্পানিটির, বরং বেড়েছে, যা সত্যিই বিভ্রান্তিকর।
অথচ আগামী আগস্ট নাগাদ ১২ লাখ সম্ভাব্য মৃত্যুর আভাস দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পুরোনো ঘটনা- হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি যোগাড়ের দুর্ভোগ। গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে শত শত শবদেহ, অথচ তারপরও ভারতের শীর্ষ ৫০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত বাজার সূচক নিফটি-৫০ ইনডেক্স ভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বাজারমূল্যের বিপরীতে ৩১ পয়েন্ট আয়ের ভিত্তিতে লেনদেন চলছে।
গেল ফেব্রুয়ারির পর কিছুটা কমলেও, বাজারমূল্য এখনও অনেক বেশি। একমাত্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরেই চলছে এর চেয়ে বেশি দামে লেনদেন। অর্থাৎ, ভারতের বাজারে এখন নতুন বিনিয়োগ করাও ব্যয়বহুল।
বছর শেষে বহুজাতিক কোম্পানি কোলগেটের ভারতীয় শাখার মোট বিক্রি বেড়েছে মাত্র ৭ শতাংশ, কিন্তু তার আগের বছর মাত্র ১.২ শতাংশ বিক্রয় হওয়ায়, দুই বছরের গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৫ শতাংশেরও কম। অথচ কোলগেটের ভারতীয় শাখা ২০১৫ সালের পূর্ববর্তী ৯ বছরে মাত্র একবার ১৩ শতাংশের কম বিক্রয় প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছিল।
কিন্তু, তারপর কোলগেটের ব্যবসায় ভাগ বসাতে আবির্ভূত হন যোগব্যয়াম গুরু বাবা রামদেব তার প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় আয়ুর্বেদ কোম্পানি- পতঞ্জলী নিয়ে। ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদির ৮৬ শতাংশ নোট বাতিলের উদ্ভট পদক্ষেপ ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সঙ্কটের জন্ম দেয়, অর্থনীতির বিকাশও তাতে গতি হারায়। এবং সবশেষে কোভিডের দুই দুটি তরঙ্গের অভিঘাতের মিলিত প্রভাবে মোদির গত ৬ বছরের শাসনামলে একবারও দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি দেখেনি কোম্পানিটি।
তারপরও, মুম্বাই বাজারে নিবন্ধিত কোলগেট-পামুলিভ ইন্ডিয়া লিমিটেডে বিনিয়োগের বিপরীতে বড় অংকের আয়ের এই মার্জিন বিস্ময়কর। আয় পূর্ববতী মুনাফার সুদ, কর প্রদান, মুদ্রাস্ফীতির মতো প্রভাবের পরও মার্চে সমাপ্ত শেষ প্রান্তিকে ৮ শতাংশ পয়েন্ট থেকে বেড়ে কোম্পানিটি ৩৩ শতাংশ মূল্যায়ন অর্জন করে। মহামারির তীব্রতার মধ্যে যখন কাঁচামালের বৈশ্বিক মূল্য বেড়েছে ঠিক তখন একটি টুথপেস্ট, সাবান প্রভৃতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কীভাবে এই মূল্যায়নের অধিকারী হয়- তা বোধগম্য নয়। এবং আগামীদিনে ভোক্তাদের কাছ থেকে কীভাবে তারা মুনাফা ধরে রাখতে বিক্রীত পণ্যে বাড়তি মূল্য যোগ করবে তাও অনিশ্চিত।
অর্থনীতিবিদদের মতেও, এমনটা হওয়া উচিৎ নয়। ভারতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির একটি মূল প্রভাবক পাইকারি দর গেল মাসে সাড়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, ভোক্তা পর্যায়ের মূল্যস্ফীতির গতি মার্চের ৫.৫ শতাংশ থেকে কমে ৪.৩ শতাংশে নেমে আসে।
মুম্বাইয়ের বাজার ব্যবস্থাপক সংস্থা- ইনক্রেড ক্যাপিটালের অর্থনীতিবিদ জয় শঙ্কর বলেন, "এই দুই সূচকের বিশাল ব্যবধানের কথা বাদ দিলেও বলা যায়, দুর্বল চাহিদার কারণে বাড়তি মূল্যের পণ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভোক্তাদের কাছে গছিয়ে দিতে পারবে না।"
শীর্ষ আরেক ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান মতিলাল অসওয়াল-ও মনে করছে, কোলগেটের ভারতীয় শাখা খরচ সাশ্রয়ী নানা পদক্ষেপ যেমন; বিজ্ঞাপন কমানো, কর্মী ছাঁটাই এবং অন্যান্য খরচ কমিয়ে যে রেকর্ড মুনাফা মার্জিন লাভ করেছে- তা বেশিদিন স্থায়ী হবে না। দিনশেষে কাঁচামালের খরচ তাদের মুনাফার ঘরের দেয়ালে ধস নামাবেই নামাবে।
এই আভাসের সত্যতা জানতে, দর বৃদ্ধির পদক্ষেপকে আমলে নিয়ে এক বছর আগে কোম্পানিটির মুনাফা মার্জিনের দিকে নজর দেই। তার সঙ্গে চলতি বছরের পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মূল্যস্ফীতির বার্ষিক হারের ব্যবধান হিসাব করলে দেখা যায়, উৎপাদনের একাধিক খরচ বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু, বর্তমানের দুর্বল আয় প্রবৃদ্ধির পরিবেশে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সেই বাড়তি মূল্যের ভার ক্রেতার ওপর চাপাতে পারছে না। ফলে নিশ্চিতভাবেই লাভ কমে আসছে।
ভারতের আরেক শীর্ষ ভোক্তাপন্য উৎপাদক ইউনিলিভার পিএলসি'র ভারতীয় শাখাও এই দুই বিপরীত মুখী সূচকের ব্যবধান বেড়ে চলায় মুনাফা সংকোচনে পড়বে। সার্বিক অর্থনীতির জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় ধস আরও গভীর ও অন্ধকার ভবিষ্যতেরই বার্তা দেয়।
(সংক্ষেপিত)
লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক অ্যান্ডি মুখার্জি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।
সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত