লকডাউনের দু'মাসে কক্সবাজারের পর্যটনে ক্ষতি আড়াই হাজার কোটি টাকা
মহামারির প্রভাবে চরম সংকটের মুখের পড়েছে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প করোনার সংক্রমণ রোধ ও সর্বাত্মক লকডাউনে জনশূণ্য জনপদে পরিণত হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতের নগরী কক্সবাজার।
লকডাউনের প্রভাবে গত প্রায় দু'মাসে কক্সবাজারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পর্যটন জোন ও শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল–রেস্তোরাঁ, কয়েকশ' শুঁটকি ও শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি পণ্য বেচাবিক্রির দোকানসহ পর্যটনের সকল অনুষঙ্গ মিলিয়ে এই ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বা স্বাস্থ্য বিধি নিশ্চিতের কঠোরতায় পর্যটন ব্যবসা খুলে দেওয়া না হলে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, করোনা পর্যটন নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস অ্যান্ড রিসোর্টের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, "পর্যটক নেই, ২৫০ রুমের হোটেল পুরোই খালি পড়ে আছে। কিন্তু হোটেল খোলা রাখতে হচ্ছে। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ খরচ, ব্যাংক ঋণ কিস্তিসহ নানা খাতে দৈনিক লোকসান যাচ্ছে প্রায় চার লাখ টাকা করে।"
আরেক তারকা হোটেল দ্য কক্স টু ডে'র ব্যবস্থাপক আবু তালেব বলেন, "চলতি লকডাউনের শুরু থেকেই খালি পড়ে আছে হোটেল। কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ খরচসহ নানা খাতে দৈনিক লোকসান যাচ্ছে তিন লাখ টাকা করে।"
শুধু এই দুটি হোটেলই নয়, অন্যান্য তারকা হোটেল এবং গেস্ট হাউজ, মোটেল, কটেজ ও ফ্ল্যাটসহ পর্যটন খাতের প্রায় সাড়ে ৪শ' আবাসন প্রতিষ্ঠানই পর্যটকহীন অবস্থায় খাঁ খাঁ করছে।
হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, "শহরের হলিডে মোড় হতে কলাতলীর দরিয়ানগর সৈকত এলাকা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ রয়েছে চার শতাধিক। পহেলা এপ্রিল থেকে কোনো হোটেলে অতিথি নেই। লকডাউনের ঘোষণা জানতে পেরে অধিকাংশ হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষ ১ এপ্রিলের আগেই ৯৩ শতাংশ কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে। বর্তমানে পাঁচ থেকে সাত শতাংশ কর্মচারী হোটেল–মোটেলে অবস্থান করে সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন।"
ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, "গত ৫২ দিনে সৈকত নগরীর প্রায় সাড়ে ৪০০ আবাসন প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। আর আড়াই শতাধিক খাবার হোটেলে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩ কোটি টাকা করে। হোটেল সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক অন্যান্য খাতে ক্ষতি প্রায় ৭ কোটি টাকা।"
কক্সবাজারে তারকা মানের হোটেল আছে ৪৫টি, মাঝারি মানের হোটেল আছে ২৩০টি। পৃথক সাতটি হোটেল মোটেল রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মোর্চা এই ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের আওতাধীন হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা ৭০৯টি। ১ এপ্রিল থেকেই সব কটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে।
হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হোয়াইট অর্কিড হোটেলের মহাব্যবস্থাপক রিয়াদ ইফতেখার বলেন, লকডাউনে শহরের মার্কেট, দোকানপাট সবই খোলা রেখে শুধু পর্যটন বন্ধ রাখা হাস্যকর। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সমুদ্রসৈকতে সীমিত আকারে হলেও পর্যটকের ভ্রমণের সুযোগ দেয়া না হলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় চরম ধস নেমে আসবে। এক মাসের লস অন্য মাসে পুষিয়ে উঠা কষ্টকর।
কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সম্পাদক মুকিম খান জানান, এখানে হোটেল–মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে ৫২টি।
তিনি বলেন, হোটেল–মোটেল বন্ধ থাকায় ৫২টি হোটেল ও রিসোর্টের অন্তত পাঁচ হাজার কর্মচারী বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ কর্মচারীর বেতন–ভাতাও পরিশোধ হয়নি। তাই সীমিত আকারে হলেও সৈকত খুলে দেয়া উচিত।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি ওমর সোলতান বলেন, সমিতির আওতাভুক্ত শতাধিক হোটেল ও গেস্টহাউস প্রায় দু'মাস ধরে বন্ধ। ব্যাংকঋণ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে অধিকাংশ হোটেল। ব্যবসায় ধস সামলাতে হলে পর্যটন সচল রাখার বিকল্প নেই।
ট্যুরস ওনার এসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, কক্সবাজারে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধকোটি পর্যটক আসেন। তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন দূরপাল্লার অনেক বাস ও ১০-১২টি ফ্লাইট যাতায়াত করে। পর্যটক সেবায় থাকা হোটেল-মোটেল, কটেজ ও রেস্টুরেন্ট ও বিমান চলাচল সবই বন্ধ রয়েছে গত প্রায় দু'মাস। এতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যবসা ভেস্তে গেছে।
হোটেলের মালিকরা বলছেন, করোনার প্রভাবে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে টানা পাঁচ মাস হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ ছিল। ১৭ আগস্টের পর বন্ধ হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো খোলার প্রস্তুতি নিতেই চলে যায় মাস দুয়েক। নভেম্বর-ডিসেম্বর, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কিছুটা ব্যবসা হয়েছে। কিন্তু মার্চে এসে আবার করোনার প্রাদুর্ভাবে ভাটা পড়ে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়। আর এপ্রিলের শুরু হতে লকডাউন সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়েছে। এতে পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল ও আড়াই শতাধিক রেস্তোরাঁ আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে লোকসান গুনতে গুনতে সংশ্লিষ্টরা হয়রান।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি লায়ন এমএন করিম বলেন, পর্যটন শিল্পে অশনিসংকেত এনে দিয়েছে করোনা। ব্যাংক ঋণেই তারকা হোটেলগুলো পর্যটন সেবায় যুক্ত হয়েছে। চক্রবৃদ্ধিতে দিন দিন ঋণের বোঝা বাড়ছে, বাড়ছে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার শংকাও। মাসিক কিস্তির জন্য করোনাকালে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চাপ দেয়নি, কিন্তু আমাদের টেনশন বাড়ছে। সুদের চক্রবৃদ্ধিতে বাড়ছে ঋণের পরিধি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দেউলিয়া হতে হবে।
এ পরিস্থিতি কাটাতে পর্যটন ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলেই কেবল এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, গত বছরের মতো এ বছরেও গত দুটি মাস কক্সবাজারে সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পর্যটনের অর্থনীতি নিম্নমুখী। আমাদের হিসাবে প্রতিদিন ৪৫-৫০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে আরো কিছুদিন চলতে থাকলে আরও ধস নামবে। ইতোমধ্যে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়া গেলে ক্ষতি কিছুটা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, পর্যটন সম্ভাবনাময় শিল্প। এর প্রতি সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে। চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত জানিয়ে রেখেছি।
তিনি আরও জানান, সরকারি সিদ্ধান্তে পর্যটনসেবীদের জন্য কোন বরাদ্দ এলে তা যথাযথভাবে বিতরণ করা হবে। তবে, এখনো পর্যন্ত প্রণোদনা পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।