করোনার চিকিৎসায় ভারতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে মারাত্মক হচ্ছে ‘সুপারবাগ’ সংক্রমণ
পরজীবী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের সংক্রমণ রোধে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার চলে আসছে। সময়ের সাথে সাথে পরজীবীগুলোর পরবর্তী বংশজ বা স্ট্রেইন এমন ওষুধের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতাও অর্জন করছে, বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই এমন সতর্ক বাণী দেন। এমন স্ট্রেইনকে তারা 'সুপারবাগ' নাম দিয়েছেন।
প্রতিবেশী ভারতেও সুপারবাগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে শঙ্কা করা হচ্ছে। কোভিড চিকিৎসায় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহারই এজন্য দায়ী। তাই কোভিড রোগীর সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুপারবাগের বিস্তারও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ যেন মহাদুর্যোগের মধ্যে নতুন আতঙ্কের পদধ্বনি।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তাদের একটি ছোট কিন্তু উদ্বেগজনক সংখ্যার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস (ছত্রাক) সংক্রমণ ঘটছে, এসব পরজীবীর স্ট্রেইন একাধিক ওষুধের কার্যকারিতা সহনশীল।
পরিস্থিতি শোচনীয় রুপ নেওয়ার একটি প্রধান কারণ, কোভিডে গুরুতর আক্রান্তদের জীবন বাঁচানোর লড়াই চিকিৎসা বিজ্ঞানে একেবারেই নতুন এক অধ্যায়। তাই হাতের কাছে সহজলভ্য এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর প্রমাণিত যেকোনো ওষুধই চিকিৎসকরা রোগীদের দিতে বাধ্য হন।
তবে, ভারতে এমন কিছু অ্যান্টিবায়োটিক রোগীদের দেওয়া হয়েছে, যা অন্যান্য দেশে কোভিড চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত নয়। তার চেয়েও মর্মান্তিক ঘটনা, সক্ষমতার পূর্ণ ভারে বিশৃঙ্খল দশা হাসপাতালের, তাই সেখানকার কর্মীরাও সুপারবাগ সংক্রমণ যেন এক রোগী থেকে আরেকজনের দেহে না ছড়ায়- সেটি নিশ্চিত করার মতো দরকারি বাড়তি সতর্কতা নিশ্চিত করতে পারছেন না।
ভারতে কোভিড চিকিৎসায় যেসব অ্যান্টিবায়োটিক হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে; তারমধ্যে কয়েকটিকে শুধুমাত্র মারাত্মক সংক্রমণে আক্রান্তদের ওপর ব্যবহারের পরামর্শ দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। "মহামারির আগেই ভারতে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিরুদ্ধে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিসটেন্স উদ্বেগজনক অবস্থায় ছিল, মহামারি হানা দেওয়ার পর, এগুলোর নির্বিচার ব্যবহারই সম্ভবত সুপারবাগ বিস্তারের দাবানলে জ্বালানি দিচ্ছে," বলে জানান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের মাইক্রোবায়োলজিস্ট কামিনি ওয়ালিয়া।
"আমরা ভয় পাচ্ছি যে, মহামারি মোকাবিলার যুদ্ধে ব্যস্ত চিকিৎসকদের নজর এড়িয়ে সেকেন্ডারি ইনফেকশন বা অন্যান্য ওষুধ সহনশীল পরজীবীর সংক্রমণ বিস্তার লাভ করছে। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি (থেরাপি) অনুপস্থিত থাকায় অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যান্টি-বায়োটিকও প্রেসক্রাইব করা হচ্ছে," গত সোমবার সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক চিকিৎসা বিজ্ঞান সাময়িকী- জার্নাল ইনফেকশন অ্যান্ড ড্রাগ রেসিসটেন্স- এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এমন কথাই জানিয়েছেন কামিনি ও তার সহ-গবেষকরা।
ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিলের পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত ১০টি হাসপাতালে ভর্তি ১৭,৫৩৪ জন কোভিড রোগীর স্বাস্থ্যগত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়। গবেষণার মেয়াদ ছিল, গেল বছরের ১ জুন থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত। বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার আওতাভুক্ত রোগীদের ৬৪০ জন বা ৩.৬ শতাংশের ভেতর সেকেন্ডারি ইনফেকশন লক্ষ্য করা যায়। কিছু কিছু হাসপাতালে অবশ্য ২৮ শতাংশের মতো উচ্চহারে এমন ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। প্রায় অর্ধেক সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে একইসঙ্গে করোনাভাইরাস ও অন্য পরজীবীর স্ট্রেইনের সহ-সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে একাধিক ওষুধের কার্যকারিতা সহনশীল অণুজীবের আক্রমণেই।
অর্থাৎ, গেল বছর মহামারির প্রথম ঢেউয়ের সময়েই গবেষকরা সুপারবাগ উপদ্রুপের ইঙ্গিত পান, যা এখন দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে শুরু করে অন্যান্য পরজীবীর সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। তাতে অনেক রোগীসহ কোভিড থেকে সেরে ওঠাদের অনেকেরই মৃত্যুর সংবাদও জানা যাচ্ছে।
মৃত্যুহার:
গবেষণা চলাকালে, সেকেন্ডারি সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের ৬০ শতাংশ মারা যান। সেই তুলনায় শুধু করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে এই হার ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। মৃতদের বেশিরভাগ আবার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত ছিলেন। কোভিড আক্রান্ত হয়ে তাদের শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়। তার সাথে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয় দুর্বল স্বাস্থ্যে শক্তিশালী ভিন্ন পরজীবীর আক্রমণ।
নয়াদিল্লি ভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিস ডায়নামিক্স, ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি'র পরিচালক রামানন লক্ষ্মীনারায়ণ বলেন, "এর মধ্য দিয়ে উঠে আসছে যে, কোভিডে কারো মৃত্যু যদি নাও হয়, অন্য সুপারবাগ সংক্রমণের কারণে অবশ্যই সেটা ঘটবে।" তার সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সহনশীল পরজীবীর উৎপত্তির ওপর গবেষণা করে থাকে।
ভারতে গত বছর যখন কোভিড সংক্রমণ বাড়ছিল তখনই গবেষণার তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়। "ওই সময় চিকিৎসকদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রে অতিরিক্ত পরিমাণ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ ছিল, গবেষণার ফলাফলও সেটাই প্রমাণ করছে।"
ভারতে মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ জনের আক্রান্ত হওয়ার কথা জানানো হলেও, এরমধ্যে ১ কোটি মানুষ শুধু গত এক মাসে আক্রান্ত হন। ফলে হাসপাতাল ব্যবস্থায় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি দেখা দেয় মেডিকেল অক্সিজেনসহ অন্যান্য চিকিৎসা উপকরণ নিয়ে হাহাকার।
"দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ভারতে এখন শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। এতে করে, সুপারবাগ শ্রেণির বিভিন্ন পরজীবীর হাতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা কী মাত্রায় পৌঁছেছে- তা কেউ জানে না।," বলেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় সেনানায়েক।
কোভিড চিকিৎসায় ভারতে নানা রকম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হলেও গবেষকরা দেখেন কার্বাপেনেম-এর মতো সবচেয়ে শক্তিশালী একটি ব্যাকটেরিয়া নিরোধী ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, শুধুমাত্র অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ অতিমাত্রায় সহনশীল পরজীবীর ওপর ব্যবহার করা উচিৎ, এমন আরেকটি ওষুধ কলিস্টিনকেও চিকিৎসকরা কোভিড রোগীদের গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ