ব্রহ্মপুত্র-যমুনার উৎপত্তিস্থল তিব্বতে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা চীনের
তিব্বত মালভূমির বিশালতা উপলদ্ধি করাও বেশ কঠিন এক কাজ। পর্বতশৃঙ্গগুলো কয়েক কিলোমিটার ধরে ওপরে উঠতে উঠতে প্রায় আকাশে গিয়ে পৌঁছেছে। খাদগুলো এত গভীর যে আজ অবধি খুব কম মানুষই সেখানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
কেবল দুর্গম আর দৃষ্টিনন্দন বলেই নয়, বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির অভাব পূরণ করে চলায় এই মালভূমির গুরুত্ব অপরিসীম।
বরফের আচ্ছাদ্দন এখানে এতটাই বিস্তৃত যে হিম বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই তিব্বতের এই মালভূমিকে অ্যান্টার্কটিকা এবং আর্কটিকের পর তৃতীয় মেরু বলে ডেকে থাকেন। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর পর এখানে বিশ্বের সবথেকে বৃহদাকার সুপেয় পানির মজুদ আছে।
মালভূমির হিমবাহ থেকে এশিয়ার প্রধান দশটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলে জীবন ধারণে নদীগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
তবে, বিগত কয়েক দশকে নদীগুলো সুপেয় পানির উৎস হওয়া ছাড়াও বিশ্বের বৃহত্তম জনবহুল দেশের জন্য অন্যতম প্রধান শক্তির উৎসে পরিণত হয়েছে। ১৯৫০ সালের পর থেকে দেশটিতে ১৫ মিটারের উঁচু ২০ হাজারের বেশি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ইয়াংসি নদীর বুকে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ থ্রি গর্জেস ড্যাম বা তিন গিরিসঙ্কটের বাঁধ।
কয়লার পর চীনের শক্তিখাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হলো জলবিদ্যুৎ। মোট শক্তি উৎপাদনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এখান থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে। বাঁধগুলোর দম ফেলার মতো ফুরসৎ নেই।
২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চীন। আর সে উদ্দেশ্যেই দেশটি এখন তিব্বত মালভূমির দুর্গম অঞ্চলে লক্ষ্য নিবিষ্ট করেছে।
সেখানে থ্রি গর্জেসের চাইতেও তিনগুণ বেশি উৎপাদনক্ষম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে চীন।
গতবছর, কোভিডের মাঝে চীনা সরকার ইয়ারলুং সাংপো নদীর পাদদেশের বৈভব ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দেয়। একাধিক দেশের সীমা অতিক্রমকারী নদী ইয়ারলুং সাংপো ভারতে প্রবেশের পর ব্রহ্মপুত্র হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে আরও কিছুদূর যাওয়ার পর নদীটি যমুনায় রূপ নেয়।
চীনা সরকারের চতুর্দশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই ঘোষণা আসে। এসময় চীনের আর্থ-সামাজিক প্রাধান্যগুলোকে বিশদভাবে ব্যখ্যা করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রকল্পটি বিশ্বের সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামোগত নির্মাণ হতে চলেছে। তবে, বিষয়টি শুধু ভূমিধস বা সবথেকে শক্তিশালী মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ডকৃত অঞ্চলে অবস্থানের জন্য নয়। জায়গাটি ভারত ও চীনের মধ্যকার সংঘাতপূর্ণ সীমান্তেরও খুব কাছে অবস্থিত। অর্থাৎ, যেকোনো বড় প্রকল্প বিশ্বের সবথেকে জনবহুল দুই দেশের মধ্যকার আঞ্চলিক বিবাদ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
হিমালয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সর্পিল পথ ধরে চলতে থাকা নদীটি ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সংঘাতপূর্ণ সীমান্তের কাছাকাছি ইউ-আকৃতির একটি নাটকীয় মোড় নেয়।
মোড়টি এতটাই নাটকীয় যে বিংশ শতাব্দীর শুরুর আগ অবধি পশ্চিমা ভূতাত্ত্বিক এবং অনুসন্ধানকারীরা ইয়ারলুং সাংপো এবং ব্রহ্মপুত্র যে একই নদী, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না।
এই অঞ্চলের মানচিত্র অঙ্কনে অপর যে বিষয়টি বিভ্রান্তিকর ছিল, তা হলে হল দুই নদীর উচ্চতা। ইয়াংলুং থেকে হাজার হাজার মিটার নিচে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র নদ।
এক সময় তিব্বতে পশ্চিমা অনুসন্ধানকারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তারা অনুমান করেছিলেন যে, নদীগুলো কোথাও গিয়ে হয়তো বিশাল জলপ্রপাতের উৎসে মিলিত হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম জল্প্রপাত আবিষ্কারের নেশাই সম্ভবত হিমালয়ের একাধিক দুঃসাহসী অভিযানের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
'আ মাউন্ট্যান ইন তিবেট' বইতে চার্লস অ্যালেন ১৯ শতকের শেষের দিককার এক অভিযানের কথা উল্লেখ করেন। সেসময় গোপনে ধাতব রড দিয়ে চিহ্নিত ৫০০টি গাছের গুঁড়ি তিব্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভারতে যেখানে নদী প্রবেশ করেছে সেখানে এই গুঁড়িগুলোর দেখা মিলে কি না, তা দেখতেই নেওয়া হয়েছিল এই উদ্যোগ।
পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। কিন্তু, কয়েক দশক পর সেই অভিযান থেকে প্রাপ্ত তথ্য দুই নদীর সংযোগ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
এদিকে, বিশাল এক জলপ্রপাতের পরিবর্তে অনুসন্ধানী অভিযাত্রীরা হিমালয়ের দুই বৃহৎ পর্বতশৃঙ্গ নামচা বারওয়া (৭,৭৮২ মিটা) এবং গায়লা পেরির (৭,২৯৪) মাঝে বিশাল এক গিরিখাত খুঁজে পায়।
চীনা বিজ্ঞানীরা ১৯৯০ সালে পায়ে হেঁটে পুরো অঞ্চলটিতে নিরীক্ষা চালিয়ে ৫০০ কিলোমিটারের চেয়েও দীর্ঘ ইয়ারলুং সাংপোকে দুনিয়ার দীর্ঘতম গিরিখাত হিসেবে উত্থাপন করেন। শুধু তাই নয় তারা একে বিশ্বের গভীরতম খাদ হিসেবেও দাবি করেন। সেখানে ৫,৩০০ মিটারের চেয়েও গভীর একটি খাদের সন্ধান পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে যা প্রায় তিন গুণ বেশি গভীর।
নতুন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নেতৃত্বদানকারী সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়নার প্রধানের বরাতে চীনা গণমাধ্যম এক প্রতিবেদনে জানায়, গিরিখাতটিতে ৬০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। যা হবে থ্রি গরজেস ড্যামের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
প্রকল্পের নকশা এখন পর্যন্ত প্রকাশিত না হলেও, পাঁচ বছরমেয়াদী পরিকল্পনায় বিষয়টি উত্থাপিত হওয়াকে নিশ্চিত ভাবেই প্রকল্পের শুরু বলে মনে করছেন ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের অধ্যাপক মার্ক ওয়াংয়ের মতো চীনা বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, "তারা যদি কোনোকিছু তালিকাভুক্ত করে, তাহলে তা অসম্ভব হলেও বাস্তবায়িত হবে। আমি এ বিষয়ে ১২০ ভাগ নিশ্চিত।"
- সূত্র-এবিসি ডট নেট