জেন্ডার সহনশীল বাজেট মানে কিন্তু শুধু নারীর জন্য বাজেট নয়
আমরা সবাই জানি বছরে একবার সরকার বাজেট ঘোষণা করে, সেই ঘোষণায় কোনো জিনিসের দাম কমে, কোনোটা বাড়ে। বাজেট দেওয়া হয় দেশের সবার কথা ভেবে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নারীবান্ধব বাজেটের দাবি জোরাল হয়ে উঠছে বিভিন্ন নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। তারা মনে করছে, নারীর জন্য জাতীয় বাজেটে একটা বড় অংশ রাখা উচিত। কারণ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- সবক্ষেত্রেই নারীর অবস্থান অধঃস্তন।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল একবার বলেছিলেন, এ দেশের নারীদের দৌড় শুরু করতে হয় একদম শুরুর পয়েন্ট থেকে। যেখানে পুরুষদের করতে হয় মাঝামাঝি পয়েন্ট থেকে। কারণ নারীকে অনেক ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করে পথে নামতে হয়; পুরুষকে তা করতে হয় না।
সুলতানা কামাল এই কথা শুধু বলার জন্যই বলেননি। এটাই সারা বিশ্বের জন্যই সত্য। এ দেশের নারীদের জন্য আরও বেশি প্রযোজ্য। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত নারীকে একটা অসম অবস্থা থেকে প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। নারীর এই পশ্চাৎপদতা থেকে সামনে এগিয়ে আনার সংগ্রাম কিন্তু একদিনের নয় বা একজনের নয়।
আর তাই একটি আধুনিক সরকারের এমনকিছু বাধ্যতামূলক নিয়ম প্রবর্তন করা উচিত, যা নারীর অগ্রযাত্রাকে সহজ ও তরান্বিত করবে। নারীবান্ধব বাজেট এবং জেন্ডার সহনশীল বাজেট ঠিক এমনই একটি পদক্ষেপ।
দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। নারীদের একটা বড় অংশ চাকরি, ব্যবসা ও নানা ধরনের অনানুষ্ঠানিক পেশার সাথে জড়িত। একজন পুরুষের চেয়ে নারীকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আয় অর্জনের পথে নামতে হয়। ফলে সরকার যদি চায় নারীরা বেরিয়ে এসে দেশের অর্থনীতিকে জোরাল করুক, তাহলে তো নারীর জন্য বাজেটসহ বিভিন্ন অবকাঠোমোগত সুবিধা দেওয়াটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
অর্থমন্ত্রী এবার বাজেট দেওয়ার সময় বারবার কোভিডকালের উল্লেখ করেছেন; বলেছেন কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কথা। সরকার কোভিডের কথা মাথায় রেখেই এবারের বাজেটে জনকল্যাণমূলক অনেককিছু যোগ করেছে। কোভিডকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় আছে নারী। গত দেড় বছরে বহু নারী কাজ হারিয়েছেন, নারী উদ্যোক্তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই নারীপ্রধান পরিবারগুলো অর্থনৈতিক অনটনে পড়েছে।
নারীর জন্য বাজেট বরাদ্দের দাবির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে সরকার এ বছর বেশ কিছু বিষয় বাজেটে সংযুক্ত করেছে, যা নারীর জন্য ইতিবাচক। যেমন, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কর রেয়াত। ব্যাংকগুলোর ওপর শর্ত আরোপ করেছে যে, নারী উদ্যোক্তাদের একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ঋণ সুবিধা দিতে হবে। অন্যদিকে, সরকার ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। তবে এটাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে ছোট-বড় সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য। আর নারী স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর থেকে কর কমিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারকে পূর্ণ ভর্তুকি দিতে হবে। নতুবা সবার দোরগোড়ায় এই স্বাস্থ্য সুবিধা নিয়ে যাওয়া যাবে না।
পাঁচটি বেসরকারি সংস্থা বিশিষ্ট ফোরাম "ফরমাল রিকগনিশন অফ দ্য উম্যান'স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক"-এর উদ্যোগে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কাজে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে শতকরা ৯১.৩ জন অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন এবং এদের শতকরা ৯৬.৭ জন নারী। এছাড়া দেশে নারীপ্রধান পরিবারগুলো অধিকাংশই অনানুষ্ঠনিক খাতের।
'বাংলাদেশে ২০২০-এ করোনা চলাকালে সংসারের সেবাকাজের দ্রুত বিশ্লেষণ' শীর্ষক এক জরিপ উপস্থাপনকালে এই তথ্যগুলো উঠে এসেছে। এই সময়ে গ্রাম ও শহরের পরিবারগুলোতে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, দারিদ্রের হার কতটা বেড়েছে, নারীর আয় কতটা কমেছে, ঘরে নারী-পুরুষের কাজের আনুপাতিক হিসাব ইত্যাদি তুলে ধরার লক্ষ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়।
এছাড়াও পুরুষপ্রধান পরিবারগুলোতেও যখন অভাবের কারণে একটার পর একটা সম্পদ হাতছাড়া হতে থাকে, তখন এর মধ্যে জেন্ডার ব্যয়ের ইস্যুটা লুকিয়ে থাকে। কারণ, অভাব-অনটনের সময় নারীর সম্পত্তিই প্রথমে হাতছাড়া হয়। অর্থনৈতিক সংকট হলে প্রথমে পাড়া-প্রতিবেশীর থেকে ধার করে মানুষ। এরপর ছোটখাট জিনিস, যেমন স্বর্ণালংকার ও ছোট পশু-প্রাণী বন্ধক রাখা হয়, যেগুলোর মালিক সাধারণত নারীই হয়ে থাকে। এরপর আসে বাড়ি, জমি বা গরু বিক্রি।
অভাবের সময় যৌক্তিক কারণেই নারীর মালিকানাধীন ছোটখাট জিনিস আগে বিক্রি করা হয়। সেক্ষেত্রে সবদিক থেকেই নারীই সর্বস্বান্ত হয় প্রথমে। এই করোনাকালে এবং আরও অনেক বিপদ-আপদে তাই ঘটে থাকে।
করোনাকালে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর কাজের চাপ অনেকটা বেড়েছে। শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মজীবী নারী অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজে অনেকটা সময় দিয়েছেন, অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নারীর মানসিক স্বাস্থ্য খুব জরুরি একটি বিষয় হলেও পরিবার বরাবরই একে উপেক্ষা করে এসেছে। এখানেও সরকারের বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত।
জাতীয় বাজেট যেন নারীর বাজেট হতে পারে, জাতীয় বাজেটে যেন সব ধরনের কাজে নিয়োজিত নারীর প্রয়োজনের দিকটাকে মূল্য দেওয়া হয়, সরকার যেন জেন্ডার বান্ধব একটি বাজেট প্রণয়ন করতে পারে, সেজন্য 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'সহ বেশ কয়েকটি সংস্থা নারীর অস্বীকৃত ও অমূল্যায়িত গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন করার আহ্বান জানিয়ে আসছে বহু বছর ধরে।
সেইসাথে জাতীয় জিডিপিতে তা অন্তর্ভুক্ত করা এবং সে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার লক্ষ্যে, জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি (এসএনএ) সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে নারীর অবমূল্যায়িত কাজকে তুলে ধরারও কথা বলছে।
জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে এসডিজি ৫ অর্জন করতে চাইলে অবশ্যই নারীর এই অস্বীকৃত গৃহস্থালির কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে, যা টার্গেট ৫.৪ এবং সূচক ৫.৪.১-এ সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে।
এমজেএফ জেন্ডার লেন্স দিয়ে ৬টি মন্ত্রণালয়ের বাজেট পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছিল (জুলাই ২০১৮-জুন ২০১৯)। এর মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে যে, ৪টি ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া দরকার; যেমন- নারীবান্ধব অবকাঠামোগত বরাদ্দ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা, জনসেবা এবং ঘরের ভেতরের কাজ বা দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া। বর্তমানে সরকার তার ৪৩টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার বান্ধব বাজেটের সূচনা করেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কোনো দেশ যদি অধিকতর বাস্তবসম্মত শ্রম ও কর্মসংস্থান নীতি গ্রহণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই নারীর অ-অর্থনৈতিক কাজকে শ্রমবাজার অর্থনীতির আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এসডিজি লক্ষ্য ৫.৪-এ স্পষ্টতই বলা হয়েছে পরিবারে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার, পুরুষকে কাজে নিয়োজিত করা এবং প্রজন্মান্তরে কর্ম বিভাজনের ধারার কথা।
জেন্ডার বান্ধব বাজেটের আওতায় অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যেন গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজে নারীর দায়িত্ব সহজ করা যায়। পাশাপাশি নারীর জন্য বিকল্প সুবিধাদির ব্যবস্থা করতে হবে। মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি এবং কাজের শিথিল টাইমিং অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।
মোট কথা, অমূল্যায়িত সেবাকাজকে জেন্ডার রেসপনসিভ বাজেটিংয়ের সাথে একীভূত করতে হবে। সরকার যেমন সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্যোগ নেবে, তেমনি এনজিও, করপোরেট, বাণিজ্যিক ও গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারকেও সনাতনি ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
নারী অভিবাসীদের অনেকেই কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। এমনকি তারা বেতনও পাননি। অর্থনৈতিক এই ক্ষতি ও স্টিগমা কাটিয়ে ওঠার জন্য নারী অভিবাসীকর্মীদের জন্য আলাদা একটা বরাদ্দ রাখা উচিত ছিল, যেন তারা দেশে এসে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে পারেন। এছাড়া সরকার নারীদের জন্য ট্রেনিং ফ্যাসিলিটি আরও বাড়াতে পারে, যাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ পেয়ে মেয়েরা আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করে অর্থ আয় করতে পারেন।
সরকার সোশ্যাল সেফটি নেটে ব্যয় বাড়িয়েছে, কাজেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীদের এর আওতায় নিয়ে আসা গেলে খুব ইতিবাচক হবে। একটা জাতীয় ড্যাটা বেস তৈরি করা দরকার প্রান্তিক এলাকায় কর্মরত নারীদের কাছে সুবিধাদি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বাজেট করার সময় নারীর ক্ষমতায়ন ও বৃহত্তর উন্নয়ন অগ্রাধিকারের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকল্প বাছাই ও টাকা বরাদ্দের বিষয়টা ধার্য করা উচিত।
জেন্ডার বাজেটিংয়ের মাধ্যমে নারীর জন্য আলাদা বাজেট নয়, বরং মূল বাজেটে এমন করে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে, যেন সেটা নারী পুরুষ সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছে। নারীর জন্য সেবামূলক ফ্যাসিলিটি বাড়াতে হবে, যেন নারী সংসার সামলে, সন্তানকে নিরাপদে রেখে কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারেন। আশা করছি, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে জেন্ডার বাজেটিং ইস্যুকে আরও কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
-
৫ জুলাই, ২০২১ - লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন