দেউলিয়ার পথে ‘দেউলিয়া আদালত’
অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখা ও পূবালী ব্যাংক, মিরপুর শাখার ৪৮ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় রাজধানীর মিরপুর এলাকার অপর্ণা-জাহিদ ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি রেডিমেড গার্মেন্টস কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুল ইসলাম ২০০০ সালের আগস্ট মাসে কোম্পানীটিকে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেন ঢাকার দেউলিয়া আদালতে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা ছিল পুরোই রপ্তানি নির্ভর। ব্যবসা খারাপ হওয়ায় ব্যাংক ঋণে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালের জুনে অবলুপ্ত করা হয়। এর আগের পাওনার ব্যাংক দুইটি ব্যাংক ঋণের টাকা আদায়ে ঢাকার আদালতে মামলা করে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দুইটির প্রধান কার্যালয়ের আইন কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সুদ-আসলে অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা ২৯ কোটি এবং পূবালী ব্যাংকের পাওনা ১৯ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মূলধনের ওপর নির্ভর করে এই ঋণ দেওয়া হয়েছিল।
তারা জানান, ২০০০ সালে ওই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের কাছে খেলাপী হয়ে গেলে ঢাকার আদালতে মামলা করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি অবলুপ্ত হওয়ায় এবং ঋণ পরিশোধে অসামর্থ বিবেচনা করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুল ইসলাম কোম্পানীটিকে দেউলিয়া ঘোষণার মামলা করে। মামলা হওয়ার পর ২০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়নি।
অগ্রণী ব্যাংকের আইনজীবী মীর শওকত হোসেন বলেন, আইন অনুযায়ী যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন/মামলা করে, তখন তার কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণে দায়ের করা মামলা ঋণ আদায়ে অন্যান্য মামলার কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে যায়।
তিনি বলেন, অপর্ণা-জাহিদ ফ্যাশনকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হলে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা হবে।
কিন্তু জাহিদের ওই আবেদন করার দুই বছর পর এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে একবার শুনানি হয়। এরপর আর শুনানি হয়নি। এরপর কয়েকবার তারিখ ধার্য হলেও অপর্ণা-জাহিদ ফ্যাশন লিমিটেডের এমডি জাহিদ আর আদালতে হাজির হননি।
এত বিলম্বের কারণ হিসেবে আইনজীবী মীর শওকত হোসেন বলেন, আইন অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলা জজ বা অতিরিক্ত মহানগর জজ আদালতকে দেউলিয়া বিষয়ক মামলা পরিচালনার এখতিয়ার দেওয়া হয়। এইসব আদালতে আরও অনেক দেওয়ানী মামলা থাকায় এসব মামলা তেমন গুরুত্ব পায় না। আবার যেসব ব্যক্তি বা কোম্পানি দেউলিয়া মামলার সাথে জড়িত তারা নানা কৌশলে শুনানির জন্য সময় নেন। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
সুপ্রিম কোর্ট ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে দেউলিয়া আদালতগুলোতে এখন প্রায় ১৭৯ টি দেউলিয়া মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলাগুলোর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রায় ২৬০০ কোটি টাকা আটকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯৭ সালে দেউলিয়া বিষয়ক আইন প্রণয়নের পর, এখন পর্যন্ত এ আইনে দায়ের হওয়া প্রায় ৬৩৮টি মামলা দায়ের হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানীর বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়ের হয়েছে ১১টি মামলা। তবে গত ৫ বছরে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২টি। আবার ১৭৯টি মামলার মধ্যে ৬১টি দেউলিয়া মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র বলেছে, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাধ্যে একটি মাত্র কোম্পানীকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে গত ১০ বছরে। আর নিষ্পত্তি হওয়া অন্য মামলাগুলোর সবগুলো ছিল ব্যক্তি ঋণ খেলাপীদের বিরুদ্ধে।
কখন দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করা যায়
ব্যাংক কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শাহ মোহাম্মদ আহসানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, যখন কোনো ঋণ খেলাপী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, মর্টগেজ রাখা সম্পত্তিসহ তার নিজের সকল সম্পত্তির মূল্যের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশী হয়, তখন দেউলিয়া আদালতে আশ্রয় নেওয়া যায়।
দেউলিয়া আইনের ১০ ধারা মোতাবেক কোনো ঋণ খেলাপী নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতে মামলা করতে পারে, আবার কোনো ব্যাংক খেলাপীকে দেউলিয়া ঘোণার জন্যও মামলা করতে পারে।
মামলা দায়ের করার পর আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর সংশ্লিষ্ট খেলাপীর সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে রিসিভার নিয়োগ দেন। এরপর আদালত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সম্পত্তি ক্রোক করে ব্যাংকের অনূকুলে নেওয়ার রায় দেন।
এছাড়াও অর্থঋণ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে ঋণগ্রহীতাকে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। কোনো ঋণগ্রহীতা তা না করলে ওই রায় দেউলিয়া আদালতে পাঠানোর বিধান রয়েছে।
ব্যাংক যখন দেউলিয়া আদালতে মামলা করে
সারাদেশে দেউলিয়া আদালতে বিচারাধীন ১৭৯টি মামলার মধ্যে ১১১টি মামলা দায়ের করেছে বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় এই ১১১টির মধ্যে ৬১টি হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম টিবিএসকে বলেন, ব্যাংক যখন কোনো ব্যক্তিকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য মামলা করে, তখনই বিপত্তি বেঁধে যায়। দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ঋণ খেলাপী নানা অযুহাত দেখিয়ে হাইকোর্টে গিয়ে রিট করে সেই মামলা স্থগিত করে নেন।
ঢাকা ব্যাংকের কাছে ৭৭ কোটি টাকার ঋণ খেলাপী হয় চট্টগ্রামের মাবিয়া শিপ ব্রেকিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পত্তি ও মর্টগেজ রাখা সম্পত্তির চেয়ে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশী। ঢাকা ব্যাংক ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানটিকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করে। মামলার পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ওই বছরই হাইকোর্টে রিট করে মামলাটি স্থগিত চেয়ে। হাইকোর্ট ছয় মাসের জন্য মামলা স্থগিত করলে তা বাড়তে বাড়তে এখন পর্যন্ত ওই মামলার শুনানিই শুরু হয়নি।
ব্যক্তি খেলাপীদের কৌশল নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বগুড়ার বড়িয়াহাট শাখা থেকে ১৯৮৯ সালে ৫ লাখ টাকা ঋণ নেয় ওই এলাকার কেশরীপুর গ্রামের সেকেন্দার আলী নামের এক ব্যবসায়ী।
ঋণ পরিশোধ না করলে ২০০০ সালে তার ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকা। মর্টগেজ রাখা সম্পত্তি ও তার অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিমূল্যের চেয়ে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বগুড়ার আদালতে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য মামলা করেন তিনি।
বড়িয়াহাট শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) আশরাফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, ওই ব্যক্তিকে দেউলিয়া ঘোষণার পর আদালত তার সকল সম্পত্তি ক্রোক করে ব্যাংকের অনূকুলে নেওয়ার রায় দেন। কিন্তু আইন অনুসরন করে ব্যাংক তার সম্পত্তি ক্রোক করতে গেলে দেখা যায়, তার একটি জরাজীর্ণ বসতঘর ও ৬ শতক জমি ছাড়া আর কিছুই নেই। আর ভুয়া মর্টগেজ তৈরি করে ঋণ নিয়েছিল ওই ব্যক্তি।
ফলে ব্যাংক সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর লাভবান হয় ওই খেলাপী।
দেউলিয়া ঘোষণার মামলা কম
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ টিবিএসকে বলেন, একসময় দেউলিয়া আদালতে মামলা দায়ের হত বেশ। দেউলিয়া প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খেলাপী ঋণের টাকা উঠানো সম্ভব হয় না। দেউলিয়া প্রক্রিয়ায় ব্যাংক সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়াও খেলাপীদের বাঁচানোর জন্যই দেউলিয়া প্রক্রিয়াটা বেশি কাজ করছিল। সেই প্রক্রিয়ার সাথে ব্যাংকের অনেক অসাধু কর্মকর্তা জড়িত থাকারও নজির আছে।
তিনি বলেন, ২০০০ সালের শুরুর দিক থেকে ব্যাংকগুলো সম্পত্তি মর্টগেজ নেওয়ার পাশপাশি ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে সিকিউরিটি চেক নেয়। ফলে খেলাপী ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করার পাশাপাশি এনআই অ্যাক্টেও মামলা করে ব্যাংক।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, অর্থঋণে মামলা চলাকালীন কোনো খেলাপী নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার মামলা করলে, অর্থঋণের মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর হয়ে যায়। অনেক খেলাপী এই অপকৌশল অবলম্বন করতেন।
দেউলিয়া আদালতের মামলা নিষ্পত্তি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক টিবিএসকে বলেন, দেউলিয়া বিষয়ক আইনে কিছু সমস্যা থাকায় মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগের কথা বলেন তিনি।
ঝুলে আছে দেউলিয়া বিষয়ক আইন সংশোধনের উদ্যোগ
প্রায় চার বছর আগে দেউলিয়া আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার পর একটি খসড়াও প্রণয়ন করা হয়। এখন পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ব্যক্তি ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হলে তিনি নিজ নামে সরকারি সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। ভোটও দিতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন ঋণ নিতে পারবেন না। যিনি দেউলিয়া হবেন তিনি দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না। উঠতে পারবেন না বিমানে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াতও পাবেন না। তবে দেউলিয়ার দায় থেকে মুক্ত হলে আদালতের সম্মতি নিয়ে এসব সুবিধা আবার ভোগ করতে পারবেন। এছাড়াও কোনো ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণার পাশাপাশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেও দেউলিয়া ঘোষণার বিধান রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনের এসব বিষয় ১৯৯৭ সালের আইনে ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ টিবিএকে বলেন, দেউলিয়া বিষয়ক আইনটি সংশোধন করা জরুরি।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে যেসব বিষয় যোগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বেশ যুগোপযোগী। বিশ্বের অনেক দেশেই দেউলিয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে এরকম বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, আইনটির খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা উদ্যোগ নিলেই কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আইনটি সংশোধন করে যুগোপযোগী করার সম্ভব।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব (ব্যাংক সংস্কার আইন) মুঃ শুকুর আলী টিবিএসকে বলেন, প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে কাজ চলছে। শেষ হলেই এটি নিয়ে সামনে এগানো হবে।