সুশান্তের মৃত্যুবার্ষিকী: ফিরে দেখা অভিশপ্ত ১৪ জুনের ঘটনাক্রম
২০২০ সালের ১৪ জুন ওই অভিশপ্ত দুপুরে ঠিক কী হয়েছিল ভারতের মুম্বাইয়ের বান্দ্রার কার্টার রোডের মাউন্ড ব্লাঙ্ক অ্যাপার্টমেন্টে? সেই প্রশ্নের উত্তর ঘটনার এক বছর পরেও অধরা।
মুম্বাই পুলিশ প্রথম দিন থেকেই দাবি করে এসেছে 'আত্মহত্যা' করেছেন বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুত। গত বছর আগস্টে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সুশান্তের মৃত্যু মামলার ভার যায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে। তবে প্রায় ১০ মাস পরেও এখনো সিবিআই স্পষ্টভাবে জানায়নি, আত্মহত্যা নাকি খুন? সুশান্তের মৃত্যুর সঙ্গে কি আদৌ কোনো ফাউল প্লে জড়িয়ে রয়েছে? গোটা বিষয় নিয়ে মুখে কুলুপ সিবিআই কর্মকর্তাদের।
১৪ জুনের ওই কালো দিনে সুশান্তের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে উপস্থিত ছিলেন আরও চারজন। প্রয়াত অভিনেতার ক্রিয়েটিভ ম্যানেজার সিদ্ধার্থ পিঠানি, সুশান্তের রাঁধুনি নীরজ এবং দুই পরিচালক কেশব ও দীপেশ সাওয়ান্ত। একাধিক মিডিয়া ইন্টারভিউ এবং সিবিআই ও মুম্বাই পুলিশকে দেওয়া বয়ানে সিদ্ধার্থ পিঠানি ও সুশান্তের রাঁধুনি নীরজ ১৪ জুনের ঘটনাক্রম সম্পর্কে কী জানিয়েছেন, চলুন ফিরে দেখি:
পিঠানির বয়ান
'সকাল ১০ থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে আমি হলে ছিলাম এবং গান শুনছিলাম। সেই সময় সুশান্তের স্টাফ কেশব এসে আমায় জানায়, স্যার (সুশান্ত) দরজা খুলছেন না। এরপর আমি এই কথাটা দীপেশকে (সাওয়ান্ত) বলি এবং আমরা দুজনে সুশান্তের ঘরের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিই, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ মেলেনি।'
সিদ্ধার্থ পিঠানি এরপর জানান, ওই সময়ই মিতু সিং (সুশান্তের দিদি) তাকে ফোন করে জানান, তিনি সুশান্তকে ফোন করছেন কিন্তু জবাব মিলছে না। দরজা ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও উত্তর না মেলার কথা সিদ্ধার্থ জানান মিতু সিংকে, এবং যত দ্রুত সম্ভব সুশান্তের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে বলেন। এরপর দীপেশ বিল্ডিংয়ের গার্ডের কাছ থেকে চাবিওয়ালার খোঁজ নেন। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া না মেলায়, ইন্টারনেট ঘেঁটে মহম্মদ রফি নামে এক চাবিওয়ালার নম্বর জোগাড় করে ফোন করেন পিঠানি।
দুপুর ১.০৬ নাগাদ মহম্মদ রফিকে ফোন করেন পিঠানি। দুপুর ১.২০ নাগাদ সেই চাবিওয়ালা এসে জানান, চাবি তৈরিতে অনেক সময় লাগবে, তাই তালা ভাঙার নির্দেশ দেন পিঠানি। সেই কথা ফোন মারফত মিতু সিংকেও জানান সিদ্ধার্থ পিঠানি।
সুশান্তের ক্রিয়েটিভ ম্যানেজারের কথায়, তালা ভাঙা হলে রফির প্রাপ্য ২০০০ টাকা দিয়ে তাকে ফ্ল্যাট থেকে বিদায় জানানোর পর, ওই ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি ও দীপেশ।
সুশান্ত মামলার অন্যতম বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব পিঠানি যোগ করেন, ঘর অন্ধকার ছিল, বাঁদিকের সুইচ বোর্ডে হাত দিয়ে আলো জ্বালান তিনি। এরপরই দেখেন সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। সিলিং ফ্যানে ফাঁস লাগানো অবস্থায় সুশান্তের দেহ দেখতে পান তারা দুজনে। অভিনেতার পা দুটো বিছানার একপাশে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল, মুখ জানালার দিকে ছিল।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন মিতু সিংকে। এবং গোটা ঘটনা জানান। এরপর ১০৮ নম্বর ডায়াল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। এরপর তার ফোনে সুশান্তের অপর দিদি নীতু সিংয়ের ফোন আসে। এবং তাকেও গোটা ঘটনা জানান পিঠানি।
কিছু সময় পর ফের ফোন করেন নীতু। এবং তার স্বামী ওপি সিং (যিনি একজন আইপিএস অফিসার) সুশান্তের ঝুলন্ত দেহ নামাতে বলেন। তার কথা মতোই নীরজকে ছুরি আনার নির্দেশ দেন পিঠানি এবং তিনি ও দীপেশ বিছানার উপর উঠে সুশান্তের দেহ নীচে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন।
ততক্ষণে মিতু সিং সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তার কথা মতোই সুশান্তের নিথর দেহে প্রাণ আছে কি না দেখবার চেষ্টা করেন পিঠানি। সিপিআইর দেওয়ারও চেষ্টা চালান; কিন্তু কোনোরকম প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
এরপর বান্দ্রা পুলিশের একটি টিম অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছায়।
নীরজের বয়ান
নীরজের কথায়, ১৪ জুন দুপুর দেড়টা নাগাদ দুজন তালা চাবি নির্মাতা সুশান্তের ফ্ল্যাটে আসেন। অভিনেতার শোয়ার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। ইতোমধ্যে অনেকবার ডাকাডাকি করেও ঘরের ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় চাবিওয়ালাকে ফোন করে ডেকেছিলেন সিদ্ধার্থ পিঠানি। কম্পিউটারাইসড লকের ডুপ্লিকেট চাবি তৈরিতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে জেনে চাবিওয়ালাকে বাইরে থেকে লক ভাঙতে বলা হয়। তারা তখন সেইমতো কাজ করেন ও দু হাজার টাকা দিয়ে সুশান্তের কর্মচারী দীপেশ তাদের বিদায় জানান।
নীরজ এরপর যোগ করেন, "আমি দেখলাম, গলায় সবুজ রঙের একটা কুর্তা পেঁচানো অবস্থায় সুশান্ত স্যারের দেহটা ঝুলছে সিলিং থেকে। তার মুখটা ফেরানো ছিল জানালার দিকে। এই দৃশ্য দেখে আমি আতঙ্কে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসি। এরপর সিদ্ধার্থ, স্যারের দিদি মিতুকে খবর দিয়ে ঘটনার কথা জানান। তারপরে উনি আমায় বলেন অবিলম্বে একটা ছুরি জোগাড় করতে। আমি ছুরি আনার পরে আমরা দুজনে কুর্তা কেটে আস্তে আস্তে স্যারের দেহটা নিচে বিছানায় নামাই। ওনার পা বিছানার বাইরে ঝুলছিল এবং শরীরের উর্ধাংশ ছিল খাটের ওপর। ঠিক এই সময় মিতু দিদি ঘরে প্রবেশ করেন এবং ভাইয়ের দেহ দেখে চিৎকার করে বলে ওঠেন 'গুলশন, তুই এটা কী করলি?' এরপর উনি আমাদের বলেন স্যারকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতে।"
'…এই ঘটনার পরে সিদ্ধার্থ সুশান্তের বুকে চাপ দিয়ে তার হৃদস্পন্দন চালু করার চেষ্টা চালান। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যাওয়ায় হাল ছেড়ে দিয়ে পুলিশে খবর দিতে বলেন।'
গত বছর আগস্টে সিবিআইয়ের বিশেষ তদন্তকারী দল পিঠানি, নীরজ, কেশব ও দীপেশ সাওয়ান্তকে একটানা জেরার পাশাপাশি ১৪ জুনের ঘটনাক্রম পুনঃনির্মাণও করে একাধিকবার। তবে গোটা মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে আজ পর্যন্ত কিছুই জানায়নি কেন্দ্রীয় সংস্থা।