জেলাগুলোতে অক্সিজেন সংকট কাটলেও চিকিৎসক সংকট বাড়ছে
জেলা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সংকট এখন সমাধান হলেও রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংকট দেখা দিয়েছে অনেক হাসপাতালে। অতিরিক্ত বেড বাড়িয়েও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল। এ অবস্থার কারণ দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি; এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনা রোগী ও মৃত্যু বেড়েছে যথাক্রমে ৫১ ও ৪৬ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের নতুন হটস্পট খুলনা বিভাগে আজ রোববার (৪ জুলাই) রেকর্ড ৪৬ জন মারা গেছে। রোগী বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। খুলনার হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও অক্সিজেনের সংকট কাটতে শুরু করেছে। গত দুই সপ্তাহ থেকে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছিলো। তবে এখন সে সংকট কেটেছে।
খুলনায় অক্সিজেন সংকটের সামাধান তবে বাড়ছে রোগী:
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোডিভ রোগীরদের জন্য নির্ধারিত ১৩০ বেডের বিপরীতে রোববার রোগী ভর্তি ছিলো ১৯৭ জন। ১৩০ শয্যার মধ্যে ৭৭টি শয্যায় রয়েছে কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি রোগীদের ভরসা সিলিন্ডালের অক্সিজেনের ওপর।
হাসপাতালের ফোকালপার্সন ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার জানান, অতিরিক্ত রোগীর চাপ থাকলেও বর্তমানে এই হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। হাসপাতালটিতে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে ৫৩টি।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের মুখপাত্র ডা. কাজী আবু রাশেদ জানান, জেনারেল হাসপাতালের ৭০ শয্যা বিশিষ্ট করোনা ইউনিটকে রোববার দুপুর ২টা থেকে ৮০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই।
শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১০টি আইসিইউসহ ৪৫টি বেড রয়েছে। রোববার সেখানে ২৮ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।
হাসপাতালের করোনা ইউনিটের মুখপাত্র ডা. প্রকাশচন্দ্র দেবনাথ জানান, "আবু নাসের হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। এ হাসপাতালে নিজস্ব সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। লিকুইড অক্সিজেন প্লান্টও আছে। তাছাড়া সরকারিভাবে স্পেকট্রা কোম্পানির অক্সিজেন সিলিন্ডারের সরবরাহ রয়েছে।"
বেসরকারি গাজী মেডিকেল হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী ডা. গাজী মিজানুর রহমান জানান, গত সপ্তাহে তার হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকট ছিল। তবে এ সপ্তাহ থেকে সেই সংকট কেটে গেছে। চাহিদার কারণে বর্তমানে ঢাকা থেকে বড় বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার আনা হচ্ছে। তিনি জানান, এই হাসপাতালে ৯টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
সাতক্ষীরাতেও রোগীর চাপে স্বাস্থ্য কর্মীর সংকট:
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত ২৫০ বেডের বিপরীতে ২৭০ জন রোগী ভর্তি আছে। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী সংকট দেখা দিয়েছে।
সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই-খোদা জানান, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৯০টি বেড ধাপে ধাপে বাড়িয়ে বর্তমানে ২৫০টি করা হয়েছে। কিন্তু, রোগীর সংখ্যা আরও বেশি। প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল কম হওয়ায় চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়সহ সংশ্লিষ্টরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে চালু থাকা ১৮টি ইউনিটে চিকিৎসক প্রয়োজন ৫৮ জন। কিন্তু, চিকিৎসক রয়েছে ৩১ জন। ২৭ জন চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। এছাড়া, ৫০ জন সুইপার, ৫০ জন আয়া ও ৫০ জন ওয়ার্ডবয় প্রয়োজন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
গত ৩০ জুন অক্সিজেনের অভাবে এ হাসপাতালে কয়েকজন রোগী মারা গেছে। ডা. কুদরত-ই-খোদা জানান, অক্সিজেন পর্যাপ্ত ছিল, তবে প্রেশার কমে যাওয়ার কারণে চারজন মুমূর্ষু রোগী মারা যায়। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমনটি হয়েছে। তবে কী কারণে অক্সিজেনের প্রেশার কমে গিয়েছিল? সেটি অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমানে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট নেই, তবে হাই-ফ্লো নেজাল ক্যানুলা সংকট রয়েছে। বর্তমানে ২০ হাজার ইউনিট অক্সিজেন রয়েছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনে। সেখান থেকেই অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে রোগীদের।
রাজশাহী প্রতিদিন গড়ে ৭০ জন নতুন রোগী আসছে:
রোগীর চাপ বাড়ায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনসহ নির্ধারিত বেড ৪০৫টি থেকে বাড়িয়ে ৪৫৫টি করা হয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা শামীম ইয়াজদানী জানান, আমাদের হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। এখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে। হাসপাতালে প্রতিদিন ৬ হাজার লিটার অক্সিজেনের প্রয়োজন থাকলেও, আমাদের সরবরাহ আছে ১০ হাজার লিটার। এছাড়া, ১৪ হাজার লিটার অক্সিজেনের একটি ট্যাংকার গাড়ি বাড়তি রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়। ১,১২২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ২৩৩টি অক্সিজেন কনসুলেটর রয়েছে। এছাড়া ৬৯টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
ডা শামীম ইয়াজদানী জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৭০ জন করে নতুন রোগী ভর্তি হলে; যত ব্যবস্থাই থাকুক না কেন তা ভেঙে পড়তে বাধ্য হবে।
বগুড়ায় বেসরকারি উদ্যোগে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ:
উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন সরবরাবডপ অভাবে কয়কজন রোগী মারা যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে উঠে আসার পর বগুড়ার কোভিড ডেডিকেটেড দুই সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি উদ্যোগে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এখন দুই হাসপাতালে যে পরিমাণ হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে তাতে রোগীদের চিকিৎসার কোনো সমস্যা হবে না। ফলে গুরুতর অসুস্থ রোগীর মৃত্যু কমে আসবে।
গত শুক্রবার অক্সিজেনের অভাবে বগুড়ায় ১৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এনিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এরপর শনিবার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০টি এবং বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ১০টিসহ মোট ২০টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাসহ আনুষাঙ্গিক উপকরণ দেয় এস আলম গ্রুপ।
বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগে ১২টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যালুনা ছিলো। শনিবার (৩ জুলাই) এস আলম গ্রুপ থেকে ১০টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দেয়া হয়। রোববার নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি থেকে তিনটি ও এসআর ট্রাভলেস দুইটি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়েছে হাসপাতালটিতে। হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ২০০টি করা হয়েছে।
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, হাসপাতালে রোববার করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১০২ জন রোগী র্ভতি ছিলেন। তাদের মধ্যে ১২ জনকে হাই-ফ্লো অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে তাতে রোগীদের ভালোভাবে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।
বাগেরহাট থেকে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের খুলনায় আইসিইউ সেবার জন্য পাঠানো হয়েছে:
বাগেরহাটের ৫০ বেডের কোভিড ডেডিকেটেড সদর হাসপাতালে রোববার রোগী ভর্তি ছিলো ৫৬ জন। মাত্র ১০ জন চিকিৎসক ও ১২ জন নার্সকে এই রোগীদের সেবা দিতে হচ্ছে। সংকট রয়েছে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরও। সিকিউরিটি গার্ড ওয়ার্ডবয়ের কাজ করছে। জনবল সংকট মোকাবেলায় খুলনা থেকে ৬ জন নার্স ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে থেকে অতিরিক্ত চারজন চিকিৎসক আনা হয়েছে। তারপরও রোগীর চাপ সামলাতে হিশশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কোভিড হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন থাকলেও আইসিইউ নাই। আইসিইউয়ের জন্য সঙ্কটাপন্ন অবস্থার রোগীদের খুলনায় পাঠাতে হয়।
জেলা সিভিল সার্জন ডা কে এম হুমায়ুন কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রোগী বাড়ায় কোভিড হাসপাতালের শয্যা ৫০টি থেকে বাড়িয়ে ৭০টি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ২০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আনা হয়েছে। কিন্তু, পরিস্থিতি যদি বেশি খারাপ হয়, তাহলে আমাদের পক্ষে সেবা দেওয়া কঠিন হবে। সাধারণ মানুষকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
রোগীর সংখ্যা বাড়লে অক্সিজেন সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জ হবে: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
এদিকে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অক্সিজেন সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তদের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম।
রোববার দুপুরে আয়োজিত ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিদিনের চাহিদার তুলনায় অক্সিজেনের উৎপাদন বেশি। তবে, রোগীর সংখ্যা চাহিদার তুলনায় বৃদ্ধি পেলে অক্সিজেন সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
অক্সিজেনের সামগ্রিক উৎপাদন ও চাহিদার সংকট এই মুহুর্তে নেই বলেও জানান তিনি৷
"যারা অক্সিজেন উৎপাদন করে তাদের সাথে আমাদের প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে। আমরা আমাদের চাহিদা জানাচ্ছি৷ তবে রোগী বাড়লে চ্যালেঞ্জ হবে," বলেন তিনি।"
নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, "দেশে কোন কিট সংকট নেই। প্রতিটি জায়গায় অ্যান্টিজেন ও আরটিপিসিআর টেস্ট করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০ হাজার টেস্টের সক্ষমতা আছে। মানুষ টেস্ট করাতে গেলেই টেস্ট করাতে পারবে।"
শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রদানের বিষয়ে তিনি বলেন, "ইউজিসি ভ্যাকসিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠালে সেই তালিকা আইসিটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। তালিকা আসলে তারা ভ্যাকসিন পাবেন। পর্যায়ক্রমে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ভ্যাকসিন পাবেন, তবে সময় লাগে।"
অক্সিজেন সংকটের কারণে যেসব মৃত্যুর অভিযোগ এসেছে তা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"তদন্তের পর আমরা জানাবো। তবে সামগ্রিকভাবে এখন অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহে সংকট নেই," বলেন অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম।