ইউরো ফাইনাল: ইংল্যান্ড কি পারবে ইতালির বাধা পেরোতে?
দীর্ঘ ৫৫ বছর পর বড় কোনো টুর্নামেন্টে সেরার মুকুট নিজেদের দখলে নেওয়া থেকে আর মাত্র এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে ইংল্যান্ড। কিন্তু ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে থ্রি লায়ন্সদের চূড়ান্ত সফলতার পথে বাধা ইউরোপীয় ফুটবলের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র ইতালি। যে ইতালি আগের চেয়ে দুর্দান্ত ও অপ্রতিরোধ্য।
২০১৮ বিশ্বকাপে গ্যারেথ সাউথগেটের দল নিজেদের সম্ভাবনার জানান দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে হেরে যায়। অন্যদিকে, ২০১৬ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের পর এবারই বড় কোনো টুর্নামেন্টে খেলছে ইতালি। বাছাই পর্ব বাধা না টপকাতে না পেরে ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলা হয়নি চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
রাশিয়া বিশ্বকাপই ছিল একমাত্র জায়গা, যেখানে ৬০ বছর পর ইতালি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু ২০১৮ সালে রবার্তো মানচিনিকে কোচের আসনে বসানোর পর থেকেই ইতালির ভাগ্যের নক্ষত্র সুপ্রসন্ন হয়। ৩৩ ম্যাচে অপরাজিত থেকে ইউরোর ফাইনালে পৌঁছেছে তারা।
নতুন রূপে ইতালি কি পারবে ইংল্যান্ডের স্বপ্নকে থামিয়ে দিতে? বিশেষ কি আছে এবারের ইতালি দলে? উত্তর জানতে চলুন একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক আজ্জুরিদের ইতিবাচক বিষয়গুলোর দিকে।
দ্য মানচিনি ইফেক্ট:
জিয়ান পিয়েরো ভেন্তুরার অধীনে ২০১৮ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে না পারার ছয় মাস পরই আজ্জুরিদের দায়িত্ব নেন রবার্তো মানচিনি। আর মানচিনির আগমনের পর থেকে ইতালি যেন শুধু প্রস্ফুটিত হচ্ছে।
ইতালির হয়ে ৩৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা অনবদ্য পোশাকসজ্জায় সজ্জিত মানচিনি যেন এক আইকন হয়ে উঠেছেন ইতালিয়ানদের কাছে। সাবেক ম্যানসিটি বসের অধীনে ইতালি ২৮টি জয় পেয়েছে, ড্র করেছে ৮টি ম্যাচে এবং হেরেছে মাত্র দুটিতে।
কড়া ডিফেন্ডিং এবং খোলামেলা খেলার অনিচ্ছাই ইতালির ফুটবলে সাধারণত দেখা যায়। এই গ্রীষ্মের আগে ইতালি কখনও ইউরোর ম্যাচে একটির বেশি গোল করতে পারেনি। তবে মানচিনির সাহসী কৌশলের কারণে তুরস্ক ও সুইজারল্যান্ডকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয় ইতালি।
কিয়েলিনি যখন যোদ্ধা:
লিওনার্দো বোনুচ্চির পর ৩৬ বছর বয়সী ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনির দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা ইতালিকে করেছে আরও শক্তিশালী। তরুণ খেলোয়াড়ে ঠাসা এবারের ইতালি দলে হাতেগোনা কয়েকজন পুরনোদের মধ্যে বহাল তবিয়তে টিকে আছেন তিনি।
দুটি বিশ্বকাপ, দুটি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, অবসর ঘোষণা, আবার অবসর থেকে ফিরে আসা, উরুগুয়ের তারকা লুইস সুয়ারেজের কামড় হজম করা কিয়েলিনি দলকে ফাইনালে তুলতে অসামান্য অবদান রেখেছেন ইউরোর ফাইনালে।
এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ইতালির দেখা মিললেও কিয়েলিনির অধীনে নিজেদের পুরনো অনেক রক্ষণ কৌশলও প্রয়োগ করতে দেখা গেছে ইতালিকে।
আশা করা যাচ্ছে, আজ রাতে কিয়েলিনির সঙ্গে হ্যারি কেইনের সম্মুখ লড়াইটা ভালোই জমবে। কারণ ইউরোর শিরোপা জিততে গেলে ইংল্যান্ডকে ইতালির গত ২০ বছরের সেরা ডিফেন্ডারদের একজনকে পার হতে হবে।
সময়কে ছাড়িয়ে গেছেন কিয়েসা:
এনরিকো কিয়েসা ও ফেদেরিকো কিয়েসাই প্রথম বাবা-ছেলে, যারা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ইতালির হয়ে গোল করেছেন। তবে পার্থক্য একটাই, এনরিকোর ইতালি ১৯৯৬ ইউরোতে গ্রুপ পর্বই পার হতে পারেনি। অন্যদিকে ইতিহাস গড়ার পথে আছেন ফেদেরিকো।
২৩ বছর বয়সী জুভেন্টাস তারকা কিয়েসা এরই মধ্যে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টে দুটি গোল করার পাশাপাশি স্পেনের বিপক্ষে চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছেন ইতালিয়ান এই উইঙ্গার ।
এমনকি গ্যারেথ সাউথগেটকেও কিয়েসার বাবার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে রোমে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়। সাউথগেট নিশ্চয়ই এবার চাইবেন না যে, পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বীর ছেলে ফেদেরিকো কিয়েসা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গোল করুক।
ফ্রি এজেন্ট ডোনারামা:
২০১৬ সালে ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ইতালির জাতীয় দলে ডাক পান জিয়ানলুইজি ডোনারামা। জিয়ানলুইজি বুফনের বদলি হিসেবে খেলতে নামার পর থেকে আজ্জুরিদের হতাশ করেননি তিনি। এক নম্বর গোলরক্ষক হিসেবে ইতালির গোলপোস্টের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আছেন ২২ বছর বয়সী ডোনারামা।
টুর্নামেন্টজুড়ে মাত্র তিনটি গোল হজম করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্পেনের বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে আলভারো মোরাতার পেনাল্টি ঠেকিয়ে রীতিমতো নায়ক বনে যান ডোনারামা।
১৪ বছর বয়স থেকে এসি মিলানের হয়ে খেললেও এই গ্রীষ্মে ফ্রি এজেন্ট হয়ে গেছেন ডোনারামা। ইউরো ২০২০-এর পারফর্মেন্সের পর হয়তো তাকে দলে ভেড়াতে চাওয়ার ক্লাবের অভাব হবে না।
সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এসেছেন ইনসিনে:
লরেঞ্জো ইনসিনে প্রমাণ করে দিয়েছেন তার ছোটখাটো শারীরিক গড়ন তার প্রতিভার বিকাশের পথে বাধা হতে পারেনি। এই আকৃতি নিয়ে শীর্ষে উঠতে পারবেন না, এমনটাই বলা হয়েছিল তাকে।
বারবার প্রত্যাখাত হয়ে ফুটবল জগত নিয়ে আশা ছেড়েই দিচ্ছিলেন প্রায় ইনসিনে। এর পর ১৫ বছর বয়সে নাপোলিতে জায়গা হয় তার, যেখানে এখনও খেলছেন ইতালিয়ান এই ফরোয়ার্ড।
৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার খেলোয়াড় ইনসিনে হয়তো হেডার জিতবেন না, কিন্তু প্রতিপক্ষের রক্ষণ দেয়াল ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার দারুণ ক্ষমতা রাখেন তিনি। যেমনটা বেলজিয়ামের বিপক্ষে করেছেন তিনি।
ইতালির ক্ষমতার দিকগুলো তো জানা হলো, এবার দেখা যাক সাউথগেটের শিষ্যরা ঘরের মাঠে ইতালিকে হারিয়ে ভক্তদের হৃদয় জয় করতে এবং শিরোপার দখল নিতে পারে কি না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, এরপরই ওয়েম্বলিতে নির্ধারণ হয়ে যাবে কে হচ্ছে ইউরোপ সেরা।
সূত্র: বিবিসি