ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি
'নাথিং সিনস ১৯৬৬'; অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের পর কিছুই মেলেনি। এই প্ল্যাকার্ডটা হাতে নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছে টিভি ক্যামেরায় গ্যালারিতে ধরা পড়া সেই ইংলিশ ভক্তকে। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়নি ইংল্যান্ডের। দম বন্ধ করা লড়াইয়ের পর টাইব্রেকারে নায়ক হয়ে ইতালির দীর্ঘ অপেক্ষায় ইতি টেনেছেন গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোনারুমা। উত্তেজনায় ঠাসা ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ৫৩ বছর পর ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে ইতালি। হোমে নয়, রোমে গেল শিরোপা।
রোববার রাতে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের পর টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে হারিয়েছে ইতালি। ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়েও ম্যাচ ১-১ গোলে সমতায় থাকে। ইংল্যান্ডের হয়ে শুরুতেই গোল করেন লুক শ। লিওনার্দো বোনুচ্চির গোলে সমতায় ফেরে ইতালি।
দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোর শিরোপা জিতলো ইতালি। সর্বশেষ ১৯৬৮ সালে এই আসরের শিরোপা ঘরে তুলেছিল চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। ওটাই ছিল ইতালির প্রথম ইউরো। এরপর কেবল সময়ই গেছে, দুটি আসরে ফাইনালও খেলেছে আজ্জুরিরা; কিন্তু শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি। অবশেষে ফুরালো তাদের অপেক্ষা।
টাইব্রেকারে ইতালির হয়ে গোল করেন দমেনিকো বেরার্দি, লিওনাদ্রো বোনুচ্চি ও ফেদেরিকো। ইংল্যান্ডের পক্ষে গোল করেন অধিনায়ক হ্যারি কেইন ও হ্যারি মাগুইরে। মার্কাস রাশফোর্ডের শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। জ্যাডন সানচো ও বুকাইয়ো সাকার শট ফিরিয়ে দেন দোনারুমা।
ম্যাচের বল দখলের লড়াইয়ে অনেক এগিয়ে ছিল ইতালি। ৬৬ শতাংশ সময় বল নিজেদের পায়ে রাখে তারা। ইউরোর নতুন চ্যাম্পিয়নরা গোলমুখে শট নিয়েছে ১৯টি, এর মধ্যে ৬টি ছিল লক্ষ্যে। গোলমুখে শট নেওয়াতেও অনেক পিছিয়ে ছিল ইংল্যান্ড। তাদের নেওয়া ৬টি শটের ২টি ছিল লক্ষ্যে।
ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজতেই আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। জালের ঠিকানা পেতে একেবারেই সময় লাগেনি ইংল্যান্ডের। দ্বিতীয় মিনিটেই এগিয়ে যায় ঘরের মাঠের দলঠি। মাঝ মাঠ থেকে লম্বা করে বাড়ানো পাস খুঁজে নেয় কাইরান ট্রিপিয়ারকে। ইংলিশ এই রাইট ব্যাক ডান প্রান্ত দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দারুণ এক ক্রস করেন। বাম পাশে অরক্ষিত থাকা লুক শ উড়ে আসা বলে সরাসরি নেওয়া অসাধারণ শটে বল জালে জড়ান। ইউরোর ইতিহাসে ফাইনালে এটাই সবচেয়ে দ্রুততম গোল।
শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে খেলার গতি বাড়ায় ইতালি। অষ্টম মিনিটে ইংল্যান্ডের ডি-বক্সের একটু বাইরে ফ্রি-কিক পায় ইতালি। লরেঞ্জো ইনসিনের নেওয়া শট উপর দিয়ে চলে যায়। দশম মিনিটে ইতালির ডি-বক্সে ঢুকেও ভালো আক্রমণ সাজাতে পারেনি ইংল্যান্ড। সহজেই ইংলিশদের আক্রমণ রুখে দেয় ইতালির রক্ষণভাগ।
১২তম মিনিটে ইংলিশ অধিনায়ক হ্যারি কেইনের বাড়ানো পাস খুঁজে নেয় ট্রিপিয়ারকে। দারুণ একটি ক্রস বাড়ান তিনি। কিন্তু বাম প্রান্ত থেকে কেউ বলের সংস্পর্শে যেতে পারেননি। ১৪তম মিনিটে ম্যাসন মাউন্টের আক্রমণ কর্নারের বিনিময়ে ফেরান ইতালির মিড ফিল্ডার জর্জিনো। ২৮তম মিনিটে ইনসিনের দূরপাল্লার শট অনেক বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
৩৪তম মিনিটে ওয়ান টু ওয়ানে ইতালির ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন ম্যাসন মাউন্ট ও রাহিম স্টার্লিং। কিন্তু মাউন্টের শেষ পাস স্টার্লিংয়ের কাছে পৌঁছাতে দেয়নি ইতালির রক্ষণ দেয়াল। পরের মিনিটেই পাল্টা আক্রমণে যায় ইতালি। মাঝ মাঠের একটু দূর থেকে দারুণ দক্ষতায় বল নিয়ে বাঁ পায়ে জোরালো শট নেন ফেদেরিকো কিয়েসা। ইতালি উইঙ্গারের শট একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
৩৬তম মিনিটে আক্রমণ সাজায় ইংল্যান্ড। বাম প্রান্ত থেকে দারুণ একটি ক্রস বাড়ান লুক শ। কিন্তু ইংল্যান্ডের কোনো খেলোয়াড়ের পায়ে বল পৌঁছায়নি। যোগ করা সময়ে দারুণ সুযোগ তৈরি করে ইতালি। চিরো ইমোবিলের শট ইংল্যোন্ডের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে শট নেন কিয়েসা। কিন্তু তার দুর্বল শট সহজেই ধরে ফেলেন ইংলিশ গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড। ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ইংল্যান্ড।
বিরতি থেকে ফিরে প্রথম সুযোগটি তৈরি করে ইতালি। ৫০ তম মিনিটে ইংল্যান্ডের ডি-বক্সের একটু বাইরে ফ্রি-কিক পায় ইতালি। লরেঞ্জো ইনসিনের নেওয়া শট একটুর জন্য লক্ষভ্রষ্ট হয়। ৫৬তম মিনিটে লুক শয়ের ফ্রি-কিকে হ্যারি মাগুইরের নেওয়া হেট গোল বারের উপর দিয়ে চলে যায়। পরের মিনিটে বাম প্রন্ত থেকে আক্রমণ সাজিয়ে শট নেন কিয়েসা। ফিরে আসা বলে শট নেন ইনসিনে। ফিরিয়ে দেন পিকফোর্ড।
৬২তম মিনিটে ইংলিশ রক্ষণভাগ ও গোলরক্ষকের পরীক্ষা নেন কিয়েসা। বাম প্রান্ত থেকে ইংল্যান্ডের তিনজন ফুটবলারকে কাটিয়ে ডান পায়ে অসাধারণ এক শট নেন ইতালির এই উইঙ্গার। ঝাঁপিয়ে পড়ে ফেরান পিকফোর্ড। ৬৭তম মিনিটে সমতায় ফেরে ইতালি। কর্নার কিকে হেড নেন মার্কো ভেরাত্তি। ফেরান পিকফোর্ড, কিন্তু দলকে বিপদমুক্ত করতে পারেননি তিনি। পাশেই থাকা লিওনার্দো বোনুচ্চি বাঁ পায়ের শটে বল জালে জড়ান। ইউরোর ফাইনালে সবচেয়ে বেশি বয়সে গোল করলেন ৩৪ বছর ৭১ দিন বয়সী বোনুচ্চি।
৭২তম মিনিটে মাঝমাঠ থেকে লম্বা করে তুলে পাঠানো পাস থেকে ইংল্যান্ডের ডি-বক্সে শট নেন দমেনিকো বেরার্দি। তার শট উপর দিয়ে চলে যায়। ৮৪তম মিনিটে বাম পাশ দিয়ে ইতালির ডি-বক্সে ক্রস বাড়ান ম্যাসন মাউন্ট। বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি স্টার্লিং। তার গায়ে বল লেগে দূরে চলে যায়। বাকি সময়ে আর গোল হয়নি। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
৯৫তম মিনিটে লম্বা করে বাড়ানো পাস থেকে বল পান রাহিম স্টার্লিং। বাম পাশ দিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে ক্রস বাড়ান তিনি। কর্নারের বিনিময়ে দলকে বিপদমুক্ত করেন কিয়েলিনি। ৯৭তম মিনিটে ক্যালভিন ফিলিপসের শট বাইরে দিয়ে চলে যায়। ১০৩তম মিনিটে অল্পের জন্য রক্ষা পায় ইংল্যান্ড।
১০৭তম মিনিটে ইতালির ২০ শট ফেরালেও নিয়ন্ত্রণ ছিল না পিকফোর্ডের। ফিরতি বল প্রতিপক্ষের পায়ে যাওয়ার আগেই ধরে নেন তিনি। ১১১তম মিনিটে বড় বাঁচা বেঁচে যায় ইতালি। ম্যাচের বাকি অংশে আর গোল হয়নি। পরে টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডের স্বপ্ন চূর্ণ করে শিরোপা উঁচিয়ে ধরে ইতালি।