রেনেসাঁর অমর শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর আঙ্গুলের ছাপ খুঁজে পেলেন গবেষকরা
ইতালিয়ান রেনেসাঁর কিংবদন্তীর শিল্পী তিনি। ইউরোপ ও মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন অদ্বিতীয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। পুরো নাম- মাইকেলেঞ্জেলো ডি লোদভিকো বুনোরাতি সিমোনি, সংক্ষেপে যাকে সারা দুনিয়ার শিল্পপ্রেমী মানুষ মাইকেলেঞ্জেলো নামেই চেনে।
রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের তীর্থস্থান ভ্যাটিক্যান সিটির সিক্সটিন চ্যাপেলের সিলিঙয়ে অনবদ্য চিত্রটি তারই আঁকা। সৃষ্টি করেছেন ডেভিড অব মাইকেলেঞ্জেলো, পিয়েটার মতো ভাস্কর্য আর দ্য লাস্ট জাজমেন্টের মতো ফ্রেস্কো।
বহুকাল আগে এ শিল্পীর মৃত্যু হলেও; তার শিল্পের মান আজো মুগ্ধতা ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে চলেছে। আর তারই আঙ্গুলের ছাপ খুঁজে পাওয়া তাই শিল্পজগতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। এমন সম্ভাবনার কথা অন্তত জানাচ্ছেন যুক্তরাজ্যের একটি জাদুঘরের বিশেষজ্ঞ গবেষকরা।
মূল ভাস্কর্য বানানোর আগে শিল্পীরা ছোট আকারের স্কেল মডেল তৈরি করে থাকেন। মাইকেলেঞ্জেলোও এভাবে আসল ভাস্কর্য তৈরির আগে মোমের মডেল বানান। বিশেষজ্ঞরা জানান, সেখানে রেনেসাঁসের মহানতম এ শিল্পীর আঙ্গুলের ছাপ পড়েছে।
লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা জানান, পাঁচশ বছর পর মোমের মূর্তিটি লালচে কালো রঙ ধারণ করেছে। মাইকেলেঞ্জেলো এর নাম দিয়েছিলেন 'দ্য স্লেভ' তথা দাস। রোমে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের আরম্ভরপূর্ণ সমাধিক্ষেত্র সাজাতে যেসব শিল্পকলা মাইকেলেঞ্জেলো তৈরি করেছিলেন, তার অংশ হিসেবেই দ্য স্লেভের আদলে একটি অপূর্ব শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য বানানোর পরিকল্পনা ছিল।
গবেষকদের মতে, প্রস্তাবিত ভাস্কর্যটি একজন মানুষের গড় উচ্চতার চাইতে ৪০ গুণ বড় করে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। মোমের দ্য স্লেভের আদলে পরে মাইকেলেঞ্জেলো 'ইয়ং স্লেভ' নামের শ্বেত পাথরের ভাস্কর্যটি তৈরির কাজও শুরু করেন, কিন্তু তা আর শেষ করেননি। কারণ পরে প্রয়াত পোপের সমাধিক্ষেত্র সাজানোর ব্যয় অনেকগুণ কমানো হয়।
তবে খুব সম্ভবত আজো মাইকেলেঞ্জেলোর চিহ্ন ধরে রেখেছে মোমের স্কেল মডেল। এটির গড়নেই আঙ্গুলের ছাপটি আবিষ্কার করেছেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামটির শিল্পবোদ্ধারা।
বিবিসির ডকুমেন্টারি সিরিজ 'সিক্রেটস অব দ্য মিউজিয়াম'- এ চাঞ্চল্যকর এই আবিষ্কারের ঘটনা স্থান পেতে চলেছে। আকর্ষক এ সিরিজটিতে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট (ভিঅ্যান্ডএ) মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞদের প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্পকর্মের রহস্য উন্মোচনের নানা ঘটনা স্থান পাবে। আগামী মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যে সম্প্রচারিত সিরিজটির এবারের পর্বে মাইকেলেঞ্জেলোর মোমের মুর্তি ও বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ থাকার ঘটনা তুলে ধরা হবে।
ছাপটি অমর শিল্পীরই কিনা- সে রহস্য পুরোপুরি ভাঙতে নারাজ ভিঅ্যান্ডএ কর্তৃপক্ষ। জাদুঘরটির জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়কদের অন্যতম পেটা মোত্তুরের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি'র একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, "মোমের উপর মাইকেলেঞ্জেলোর আঙ্গুলের ছাপ এতদিন ধরে রয়ে যাওয়া একটি চাঞ্চল্যকর সম্ভাবনা। এমন চিহ্ন শিল্প গড়ার কালে শিল্পীর শারীরিক অংশগ্রহণকে তুলে ধরবে।"
বিরল প্রতিভার অধিকারী মাইকেলেঞ্জেলো তার মূল কাজের প্রস্তুতির অনেক নকশা ও স্কেল মডেল নিজেই ধ্বংস করেছেন। তাই মোমের মূর্তিতে থাকা আঙ্গুলের ছাপটি তার হলে এ হবে তার শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়া জানার এক অভাবনীয় সুযোগ।
পেটা মোত্তুরে এমন স্কেল মডেল তৈরির সময়ে, 'সৃজনশীলতা ও হাতের কারুকাজ একসঙ্গে কাজ করে' উল্লেখ করে বলেন, "আঙ্গুলের ছাপটি প্রমাণিত হলে তা শিল্পীর সঙ্গে সৃষ্টির সরাসরি সম্পর্ক তুলে ধরবে।"
১৬ শতকে 'লাইফ অব মাইকেলেঞ্জেলো' নামে এ শিল্পীর জীবনী লেখেন তার বন্ধু চিত্রকর জর্জিও ভাসারি। সেখানে তিনি রেনেসাঁসের এ শিল্পগুরু কীভাবে বড় ভাস্কর্য তৈরির আগে মোমের মডেল বানাতেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। তার সূত্র উল্লেখ করে ভিঅ্যান্ডএ জানিয়েছে, পানিতে মোমের মডেলটি ডুবিয়ে রাখতেন মাইকেলেঞ্জেলো। শুধু যে অংশটির আদলে আসল ভাস্কর্যের কাজ চলমান থাকতো সেটুকুই পানির বাইরে চোখের সামনে রাখতেন। এভাবে মূল মডেলের সঙ্গে মিল রেখে শ্বেতপাথরে নিপুণ কাজ করতেন।
সম্প্রতি যে মোমের মডেল ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার উচ্চতা মাত্র সাত ইঞ্চি। ধারণা করা হচ্ছে, ১৫১৬ থেকে ১৫১৯ সালের মধ্যে কোন এক সময় এটি তৈরি করা হয়। এ ধারণার কারণ ওই সময়ে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের সমাধিক্ষেত্রও নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
- সূত্র: সিএনএন