স্মার্ট কার্ড ও রোবটের ব্যবহারে সৌদি আরবের ‘ডিজিটাল হজ’ ব্যবস্থা
বছর ত্রিশেক আগেও হজের সময় সহযাত্রীদের হারিয়ে ভোগান্তির শিকার হতেন হাজিরা। মিসরীয় হাজি ইব্রাহিম সিয়াম-ও তিন দশক আগে হজ পালনে এসে লাখো মানুষের ভিড়ে নিজের সন্তানদের হারিয়ে ফেলেছিলেন, তবে তাঁর ভাগ্য ভালো যে টানা কয়েক ঘণ্টার খোঁজাখুঁজি করে তাদের সন্ধানও পেয়ে যান।
সে যুগ বদলেছে কালের পরিক্রমায়। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন হজে এসে ৬৪ বছরের সিয়ামকে তাঁর সন্তান ও পরিজনকে ভিড়ে হারিয়ে ফেলার দুশ্চিন্তা করতে হয় না।
দিনে দিনে এভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারে উন্নত হচ্ছে হজ ব্যবস্থা, দুর্ভোগ কমছে হাজিদের।
চলতি বছরও টানা দ্বিতীয়বারের ন্যায় মহামারিকালে মূল হজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈশ্বিক সংক্রমণ চিত্র মাথায় রেখে ইসলামের অন্যতম এ ফরজটি পালনে এবার ডিজিটাল 'হজ কার্ড' চালু করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। কার্ডটি ব্যবহারকারীরা এর সাহায্যে ধর্মীয় স্থানগুলোতে ভিড় না করেই যাওয়ার সুযোগ পান, ফলে হজ যাত্রা হয়ে উঠেছে স্পর্শহীন ও ঝুঁকিমুক্ত। আবার হাজিদের থাকার ব্যবস্থা ও পরিবহন সুবিধাও নিশ্চিত করছে কার্ডটির ব্যবহার।
হলুদ রঙা স্মার্ট হজ কার্ড দেখিয়ে সিয়াম বলেন, "১৯৯৩ সালে হজে এসে ছেলেমেয়েদের হারিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম, সাত ঘণ্টা খোঁজার পর অবশেষে তাদের সন্ধান পাই। এখন আর সহযাত্রীদের হারিয়ে ফেলা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না।"
সিয়ামের সহযাত্রী ৪৩ বছরের হাজেম রিহান-ও মহামারির আগে হজের সময় একইরকম অভিজ্ঞতার শিকার হন।
তিনি বলেন, "মিনায় আসার পর আমি এখন ঠিক কোন জায়গায় আছি- তা বুঝতে পারছিলাম না। চারপাশের সবগুলো ক্যাম্পকেই একই রকম মনে হচ্ছিল। তখন আয়োজকদের কাছে সাহায্য চাইতে গেলাম, কিন্তু তারাও আমাকে সাহায্য করতে পারছিলেন না।"
এসব ভোগান্তিকে মহামারির পর স্বাভাবিক সময়েও দূর করবে স্মার্ট হজ কার্ড। সবুজ, লাল, হলুদ ও নীল এই চার রঙে কার্ডটি দেওয়া হচ্ছে।
কার্ডের রঙগুলো হজের নানা পর্ব অনুসারে ভূমিতে অঙ্কিত চিহ্নের প্রতীক, সে অনুসারেই হাজিদের গাইড করছেন কর্তৃপক্ষ। এতে করে হাজিদের কে কখন কোথায় অবস্থান করছেন- তা জানতে পারছেন তারা। স্মার্টকার্ডের চিপ থেকেই জানা যাচ্ছে হাজিদের লোকেশন ও পরস্পরের মধ্যকার দূরত্ব।
কর্তৃপক্ষের মতে, মহামারি শেষ হলে আবার হাজিদের চাপ বাড়বে। কিন্তু, নতুন ডিজিটাল ব্যবস্থায় লাখ লাখ হাজিকে সহজে ও নিরাপদে পরিচালনা করা যাবে। এড়ানো যাবে ভিড়ে পদদলিত হয়ে হাজিদের মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনা। অতীতে অসংখ্যবার এমন ঘটনায় অনেক হাজির মৃত্যু হয়।
মহামারিকালের হজ:
প্রতিটি কার্ডে হাজিদের নিবন্ধন নম্বরসহ, তাদের থাকার জন্য নির্ধারিত স্থান, ফোন নাম্বার ও তাদের গাইডের আইডি নম্বর থাকে।
চলতি বছর টিকা নেওয়া ৬০ হাজার সৌদি নাগরিক এবং দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে বাসকারী নির্বাচিত কিছু বিদেশি নাগরিক হজের অনুমতি পেয়েছেন। তবে মহামারির আগে ২০১৯ সালের হজে ২৫ লাখ মুসলিম অংশ নেন। এবছর সীমিত সংখ্যক হজ প্রত্যাশীদের অনলাইনে আবেদন করে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে।
জেদ্দায় বাসকারী মিসরীয় ফার্মেসিস্ট আহমেদ আচৌর বলেন, "আগের দিনের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রায়ই নামাজে অংশ নিতে আসার সময় হারিয়ে যেতাম বা আসতে আসতে দেরি হয়ে যেতো।"
অতীতের সঙ্গে বর্তমান অভিজ্ঞতার তুলনা করে তিনি বলেন, "এবার অনলাইনে হজ পালনের অনুরোধপত্র পূরণের পর থেকে সব কিছুই মসৃণভাবে হয়েছে। সহজে আবেদনপত্র ও টাকা জমা দিয়ে তারপর অনুমতিপত্রটি প্রিন্ট করাই।"
সময়ের সাথে তাল রেখে চলা:
এব্যাপারে সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব আমরো আল-মাদ্দাহ বলেন, ভবিষ্যতে সকল ধরনের লেনদেন স্পর্শহীন (ডিজিটাল) হবে, ডিজিটাল কার্ডের প্রবর্তন সেদিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই কার্ড হজে খরচ প্রদানের ডিজিটাল ওয়ালেট হিসেবেও কাজ করবে।
এর আগে সৌদি বাদশাহ সালমান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া এক ভাষণে 'ডিজিটাল হজ ব্যবস্থা'র প্রশংসা করে বলেন, "এটি সুষ্ঠুভাবে হজ আয়োজনে দরকারি জনবল কমাতে সাহায্য করলেও একইসঙ্গে হাজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।"
প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাজিদের দেওয়া সেবার মান বৃদ্ধি প্রধান লক্ষ্য বলে জানান সৌদি আরবের হজ প্রতিমন্ত্রী আব্দুলফাত্তাহ বিন সুলাইমান মাশাত।
এবছর সবার জন্য জমজম কুপের পানি সংগ্রহের প্রচলিত ব্যবস্থা বাদ দিয়ে রোবটের মাধ্যমে সবাইকে বোতলজাত পবিত্র পানিটি বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৩৭ বছরের পাকিস্তানী-মার্কিন নাগরিক বার্তা সংস্থা এএফপি'কে বলেন, "বোতলজাত জমজমের পানিই ভালো। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার এজন্য কোথাও লাইন ধরে দাঁড়াতেও হচ্ছে না।"
মিসরীয় হাজি সিয়াম বলেন, "হজ পালনের ব্যবস্থা এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত হচ্ছে।"
- সূত্র: দ্য ডন