এবার ঋণ শোধের চিন্তায় খামারিরা
কেউ ঋণ করে গরুর খামার দিয়েছে, কেউ আবার জমি বিক্রি করে। এত খরচ করে গরু পালন করে ঢাকায় এসে বিক্রি করতে হয়েছে লোকসানে। অনেকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে যেখানে গরুপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। এখন কিভাবে ঋণ শোধ করবে সেই চিন্তা পেয়ে বসেছে খামারি ও বিক্রেতাদের।
কোরবানির পশুর বাজার এবার মন্দা গেছে। রাজধানীতে বিক্রি করতে আনা প্রায় অর্ধেক গরুই বিক্রি হয় নি। রাজধানীর গাবতলী হাটে বেশ কয়েকজন খামারি ও গরুর ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তাদের অনুরোধ, সরকার যেন ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহায়তা করে।
৫০ লাখ টাকা ঋণ কিভাবে শোধ করবো
গাবতলী হাটের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই বাম দিকে বড় কয়েকটি গরু দেখা গেছে কোরবানির পশুর হাটের শুরুর দিন থেকে। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের 'বাবু ক্যাটেল এগ্রোর' ৬০টি গরু রাখা হয়েছিল এখানে।
ঈদের দিন দুপুরে হাটে বসে কথা হয় বাবু ক্যাটেল এগ্রোর মালিক ওমর ফারুকের সঙ্গে। বিষণ্ণ মনে বলেন, "ভাই কি বলবো, ৩ লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনে এক বছর পালার পর সেই গরুর দাম যদি বলে দুই লাখ টাকা, কেমন লাগে বলেন? মাথাটাই ঠিক নাই আমার। খামারে বসেই গরুটির ৫ লাখ টাকা দাম বলেছিল, বিক্রি করিনি। ১৬ মণের বেশি মাংস হবে এটায়"।
ওমর ফারুক ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন কিভাবে সেই ঋণ শোধ করবেন তাই চিন্তা করছেন তিনি। বলেন, "৫০টি গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কসাইয়ের কাছে কেজি দরে বিক্রি করতে হবে। দেখি কত টাকা হয়। এরপর ঋণ শোধ করবো"।
নতুন করে ঋণ পাওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তায় ওমর ফারুক।
"যাদের টাকা আছে তাদেরই ব্যাংক ঋণ দেয়। আমি তো এবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, আমাকে তো আর ঋণ দিবে না।"
প্রতিটি গরু মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে গাবতলী হাটে আনতে ও নিয়ে যেতে ৭ হাজার টাকা করে খরচ হবে তার। হাটে প্যান্ডেল ভাড়া দিয়েছেন ৩ লাখ টাকা। ওমর ফারুক বলেন, "আমার প্রতিটি গরুর দাম ৩ লাখের উপরে, অথচ ক্রেতা দাম বলে দুই লাখ টাকা"।
সরকার যেন ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ দেয় এ অনুরোধ জানান ওমর ফারুক। বলেন, "এটা না করা হলে খামারিরা গরু পালনে উৎসাহ হারাবে"।
'একটিভ এগ্রো' ৩৫টি গরু এনেছে গাবতলী হাটে। নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলা থেকে আসতে যানজটেই ৩টি গরু মারা গেছে তার। আর গাবতলী হাটে মাত্র ৬টি গরু বিক্রি হয়েছে।
একটিভ এগ্রোর মালিক আব্দুল গাউয়ুম মোহাম্মদ হাদি বলেন, "৩টি গরু মারা গেছে সেখানে ১৩ লাখ টাকার ক্ষতি। আর যে ছয়টি গরু বিক্রি করেছি সেখানে ৬ লাখ টাকা লস। ৮০০ কেজি, ৯০০ কেজি ওজনের গরুর দাম বলে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা। যে যা পারছে দাম বলেছে। মনে হচ্ছে আমাদের সঙ্গে উপহাস করছে। যাবার পথে আবার যানজটে পড়লে গরু মারা যায় কিনা সেই চিন্তায় আছি"।
আব্দুল গাউয়ুম বলেন, "আমাদের কথা যেন সরকার বিবেচনা করে। আমরা তো আর ফ্রি টাকা চাচ্ছিনা। সরকারের কাছে সহজ শর্তে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ চাচ্ছি"।
৩৫টি গরুর একটি বিক্রি
ঈদের দিন দুপুর ২টায় গাবতলী হাটে উল্লাস করে উঠেন আশানুর। বলেন, "রেকর্ড ভেঙেছি, একটি গরু বিক্রি করেছি। এ উল্লাস আনন্দের নয়, এটা ক্ষোভের উল্লাস"।
আশানুর বলেন, "৩৫টি গরু নিয়ে এসেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ভেবেছিলাম একটাও বিক্রি হবে না। তবুওতো একটা বিক্রি করতে পারলাম"।
৩০ হাজার টাকা লোকসানে বিক্রি হয়েছে জানিয়ে আশানুর বলেন, "যশোরের সাহাজাহান এগ্রোর গরু এখন আবার যশোর ফেরত নিয়ে যেতে হবে। এত খরচ করে পালা হয়েছে, এখন কম দামে খামারে নিয়ে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করতে হবে"।
বিদেশফেরত রফিকুল ক্ষতি পোষাবেন কিভাবে
নরসিংদীতে আল-ইয়াসিন এগ্রো নামের খামার গড়ে তুলেছেন রফিকুল ইসলাম। ২৫ বছর সৌদি আরবে ছিলেন তিনি। দেশে এসে নিজের জমানো টাকা ও কিছু জমি বিক্রি করে গড়ে তুলেন খামারটি। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হয়েছে তার। রফিকুল ইসলাম বলেন, "এবার যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুষিয়ে খামার চালাতে পারবো কি না, সেই চিন্তায় আছি।
ফোনে টিবিএসকে তিনি বলেন, "ঢাকার হাজারীবাগ হাটে ২৬টি গরু নিয়েছিলাম। যে গরু পালনে খরচ হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা, সেই গরু বিক্রি করেছি এক লাখ ২০ হাজার টাকায়। ছয়টি গরু আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। খামারে এখনও বেশ বিছু গরু অবিক্রিত আছে। একদিকে গরুর খাবারের দাম বেশি, আবার অন্যদিকে বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না"।
হান্নান মন্ডল পাবনা থেকে ১৪টি গরু আনেন হাটে। বলেন, "আমার প্রতিটি গরু কেনা ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে। দাম বলছে, ১ লাখ ২০ হাজার। ছোট দুইটা গরু বিক্রি করেছি। বাকি গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। পাবনা থেকে ট্রাকে করে গরু আনা, আবার ফিরিয়ে নেয়ায় প্রতি গরুতে আমার ১০ হাজার খরচ হবে। এই ক্ষতি কিভাবে মিটাবো! আমাদের কষ্ট কেউ বুঝবে না। নিজের সঞ্চয় ছিল তার সঙ্গে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গরু কিনেছি। ভেবেছি কিছুটা লাভ করতে পারবো। এখন তো আমার ঋণ শোধ করতেই কষ্ট হবে"।
ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা
নিজের সঞ্চয় ও ৫২ লাখ টাকা ঋণ করে মোট ৪৮টি গরু ও মহিষ কিনেছেন দেলোয়ার হোসেন। গাবতলী হাটে বিক্রি করতে এনেছিলেন।
বুধবার দুপুরে হাটে বসে দেলোয়ার হোসেন জানান, ২৮টি পশু বিক্রি করতে পেরেছেন।
৭টি মহিষ ও ৩টি গরু বেঁচতে পারেন নি দোলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, "মহিষ কেনা ২ লাখ টাকায়, দাম বলে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবার ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা লোকসান হবে। গত তিন দিন পশুর দাম এত কম হবে বুঝতে পারি নি। আমরা বড় বিপদে পড়লাম । এই করোনার মধ্যে কত কষ্ট করে ঢাকা আসলাম, আবার ফেরত নিতে হবে"।
কুষ্টিয়া থেকে হাটে এসেছেন রফিকুল ইসলাম, ৩০ লাখ টাকা ঋণ করেছেন, এর সঙ্গে নিজের জমানো টাকা মিলিয়ে ৪০টি গরু কিনে এনেছিলেন। ৩৭টি বিক্রি করতে পেরেছেন। বলেন, "আমার ৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াবো কিভাবে তাই ভাবছি"।
গরুর ব্যাপারিরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত
১০০টি গরু বিক্রি করেছেন আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, "আমি বুঝতে পেরেছিলাম, গরুর বাজারে ধস নামবে তাই কিছুটা লস দিয়েই বিক্রি করে দিয়েছি"।
"সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা না করে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। ব্যাপারিরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রথমে ২০টি গরু ২ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভে গরু বিক্রি করেছি। কিন্তু এরপর ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লসে প্রতি গরু বিক্রি করতে হয়েছে। আমার ১৫ লাখ টাকার লস হয়েছে"।
মেহেরপুরে বাড়ি আব্দুল খালেকের, গরু কিনে বিক্রি করাই তার পেশা। তিনি বলেন, "আমাদের কাছে যে তথ্য আছে সে মতে, ঢাকায় যে গরু এসেছে তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। বাকিগুলো ফেরত নিতে হয়েছে। আর শেষ দিকে তো ব্যাপারিরা পানির দামে গরু বিক্রি করেছে"।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন (বিডিএফএ) এর সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ এমরান টিবিএসকে বলেন, "রাজধানীতে যে গরু বিক্রির জন্য নেয়া হয়েছিল তার ৫০ শতাংশই অবিক্রিত রয়েছে। প্রতি কেজি মাংসের উৎপাদন খরচ ৪০০ টাকার বেশি। অনেক খামারির উৎপাদন খরচই উঠেনি। সরকারকে এখন পশুখাদ্যের দাম কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি পতিত জমিতে খামারিরা যেন ঘাস লাগানোর সুযোগ পায় সেভাবে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এটা করতে পারলে খামারিদের উৎপাদন খরচ কম হবে । জনগণও কম দামে গরু কিনতে পারবে"।