'মেড ইন বাংলাদেশ'কে একটি সম্মানজনক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে হবে
ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ ও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড গত সপ্তাহে সজাগ- এর সঙ্গে যৌথভাবে এক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। সেখানে আলোচনার মূল বিষয় ছিল, "কোভিড-১৯ মহামারিকালে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় উৎকৃষ্ট চর্চাগুলোর আলোচনা।'
ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে আমি নিজেও বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কিছু উত্তম চর্চা তুলে ধরার সুযোগ পাই, যা এমনকি কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও অব্যাহত রাখা হয়েছে।
আয়োজনটিতে এ শিল্পের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের স্টেকহোল্ডাররাও যোগ দেন। তারা সকলেই এসব ইতিবাচক ঘটনা শুনে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাস্তবতা এই যে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার খবর সাড়া দুনিয়ার গণমাধ্যমকে আকর্ষণ করলেও, ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরবর্তীকালে এদেশের পোশাক শিল্পের রূপান্তর ও উন্নয়নের ঘটনা তারা তুলে ধরেনি; যদিও রানা প্লাজার আগে ও পরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পার্থক্য দিন ও রাতের মতোই স্পষ্ট।
অথচ তারপরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অধিকাংশ সময়েই আমাদের এ শিল্পটির এক মলিন চিত্র তুলে ধরে। কেউ যদি তাদের দৃষ্টিতে এ শিল্পের অবস্থা বুঝতে চান- তাহলে কয়েকটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে নিয়মিত চোখ রাখলেই তা বুঝতে পারবেন। আসলে নেতিবাচক সংবাদের প্রতি গণমাধ্যমের এ মনোযোগের কারণও আমাদের সবার জানা; কারণ দুঃসংবাদই বেশি বিকোয়।
এভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশি পোশাকশিল্পের এক সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল ও সংকটপূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয়। এমনকি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রেও সম্প্রতি সজীব গ্রুপের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্পের দুর্ঘটনার তুলনা করা হয়েছে।
বিখ্যাত দৈনিকটির এমন সংবাদ দৃষ্টিকোণ স্বপ্রণোদিত নাকি তাদের স্থানীয় সংবাদদাতাদের পাঠানো অতিরঞ্জন- তা আমাদের জানা নেই। নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, সকল কর্মপরিবেশই নিরাপদ হওয়া উচিত এবং যেকোনো প্রকার প্রাণহানির ঘটনাই অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। তবে প্রকাশিত সংবাদের ভুল ব্যাখ্যা এমনভাবে তুলে ধরা হয়, যা নিঃসন্দেহে 'মেড ইন বাংলাদেশ' পোশাক ক্রয়ে পশ্চিমা ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করার অভিসন্ধি নিয়ে করা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি পড়ে এদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে অনেকেই ভুল বুঝেছেন। এমন একজন ক্রেতা দৈনিকটির অনলাইন সংস্করণে সংবাদের নিচে মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, "আমরা যদি মেড ইন বাংলাদেশ পণ্য বয়কট শুরু না করি, তাহলে কিছুই পরিবর্তন হবে না। একমাত্র এ উপায়েই আমরা পরিবর্তন আনতে পারি।"
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রায়শই এমন ভুলের পুনরাবৃত্তি দেখছি আমরা- শিল্প সংশ্লিষ্টরা। অনেক সময় তারা কেরানীগঞ্জের স্থানীয় বাজার ভিত্তিক কারখানার দুর্ঘটনাকে আমাদের রপ্তানিমুখী কারখানার দুর্ঘটনা হিসেবে তুলে ধরে। অন্য শিল্পের দুর্ঘটনাকেও রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের ওপর চাপানো বিরল নয়। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি দেওয়া যাবে।
তাই বলে পোশাক শিল্প সম্পূর্ণ দোষহীন ও নিখুঁত আমি এমন দাবিও করতে চাই না। আমাদের সামনে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই এবং সামনে আরও অনেক অগ্রগতি অর্জন করতে হবে- একথাও আমরা বিশ্বাস করি। তারপরও বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ এ দাবি করাও অত্যুক্তি হবে না।
গত আট বছরে এ শিল্প বিপুল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও রিটেলাইরদের জোট, উৎপাদক কারখানা, সরকার, আইএলও, উন্নয়ন অংশীদাররাসহ স্থানীয় ও বৈশ্বিক শ্রম ইউনিয়নগুলোর সমন্বয়ে বাস্তবায়িত করা হয়।
এনিয়ে সম্প্রতি হংকং ভিত্তিক সাপ্লাই চেইন কমপ্লায়েন্স সলিউশন্স প্রোভাইডার সংস্থা কিউআইএমএ- এর জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে ৭.৭ পয়েন্ট স্কোর দিয়ে 'নৈতিক মান সম্মত' উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে ছিল শুধুমাত্র তাইওয়ান।
নৈতিকতা চর্চা নিরীক্ষণের এ প্রতিবেদনে কমপ্লায়েন্স ও নৈতিক উৎপাদন পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো বিষয় যেমন; পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শ্রম নীতি, শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব, কর্মঘণ্টা মজুরিসহ বহুবিধ বিষয় আমলে নেওয়া হয়। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পে শিশু ও অল্প বয়সী কর্মীর ব্যবহার হচ্ছে কিনা বা শ্রম শোষণের মতো ঘটনা ঘটছে কিনা- সেদিকটিও বিবেচনা করা হয়েছে।
নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো উন্নয়নের পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন টেকসই মান অর্জনেও ধারাবাহিক অগ্রগতি করছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশ বান্ধব বা সবুজ পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশেই অবস্থিত। দেশে বর্তমানে ১৪৪টি পোশাক কারখানা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের 'লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রোমেন্টাল ডিজাইন- লিড সনদপ্রাপ্ত।
এসব কারখানার ৪১টির আবার রয়েছে লিডের প্লাটিনাম রেটের সনদ। ৮৯টি কারখানা পেয়েছে লিড গোল্ড রেটেড ফ্যাক্টরির স্বীকৃতি।
এছাড়াও, বর্তমানে দেশের প্রায় ৫০০ কারখানাকে লিড সনদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে দুঃখের বিষয় এসব ইতিবাচক অর্জনের সংবাদ পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ না থাকায় তারা এ সম্পর্কে অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে এ শিল্পের ইতিবাচক দিক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুলে ধরতে পারি? সে প্রশ্নও জাগে।
আসলে দেশের জাতীয় গণমাধ্যমকেই এখানে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা রাখতে হবে। তারা এ শিল্পের ইতিবাচক দিকগুলোকে আলোকপাত করতে পারে।
ডিজিটালাইজেশনের যুগে প্রতিটি সংবাদই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অনলাইনের সুবাদে দেশীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদন পশ্চিমা পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও সংবাদ করার সময় জাতীয় গণমাধ্যম থেকে নেওয়া তথ্যকে কাজে লাগাবে।
জাতীয় মিডিয়ায় ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে বিপুল পরিমাণ সংবাদ প্রকাশ করা হলে, ডিজিটালাইজেশন ও সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পক্ষেও তাদের পাঠকদের ভুল বোঝানো মুশকিল হয়ে উঠবে।
তাই বলে দেশের গণমাধ্যমে এ শিল্পের গঠনমূলক সমালোচনা বন্ধ করে দেবে আমি এমন কথা বলছি না, বরং তাদের সেই ধারা অব্যাহত রাখা উচিত। তবে তার সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন পোশাক শিল্পকে রক্ষায় আমাদের সকলকেই যার যার জায়গা থেকে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বহির্বিশ্বে এ শিল্পের নেতিবাচক ভাবমূর্তি পরিবর্তনে আমরা সকলে মিলে কীভাবে বৈশ্বিক ভোক্তা শ্রেণির সামনে একটি একক ও অখণ্ড চিত্র তুলে ধরতে পারি- তা নিয়ে ভাবতে হবে। তাই আসুন সকলে মিলে 'মেড ইন বাংলাদেশ'কে বিশ্বে একটি সম্মানজনক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করি।
- লেখক: টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব। তিনি দেশের তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ- এর একজন পরিচালক।